চিত্রগুরু এস এম সুলতান
শেখ মোহাম্মদ সুলতান, যিনি এস. এম. সুলতান নামে সমধিক পরিচিত । তিনি একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী।তাঁর জীবনের মূল সুর-ছন্দ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তাঁর শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাঁর ছবিতে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির হালও অনেকটা ফুটে উঠেছে। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এস. এম. সুলতান ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্টে যশোরের নড়াইলের মাছিমদিয়া নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শেখ মোহাম্মদ মেছের আলী, তিনি পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী।শৈশবে পরিবারের সবাই তাকে লাল মিয়া বলে ডাকতো। তাঁকে বিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো সামর্থ্য তাঁর বাবার ছিলো না। বহু কষ্ট হওয়াসত্ত্বেও তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। তিনি সেখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন। এরপর স্কুল ছেড়ে বাড়ি ফিরে রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন।
রাজমিস্ত্রীর কাজ করার পাশাপাশি তিনি সেই দালানগুলোর ছবি আঁকতেন। ১০ বছর বয়সে যখন তিনি স্কুলে পড়েন তখন ড: শাম্যপ্রসাদ মুখার্জি স্কুল পরিদর্শনে এসে তাঁর আঁকা ছবি দেখে প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিলো ছবি আঁকা শিখবেন, এজন্যে দরকার হলে কলকাতায় যাবেন। কিন্তু এরকম আর্থিক সঙ্গতি তাঁর পরিবারের কখনোই ছিলোনা। এসময় তাঁর এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। জমিদারের সাহায্য নিয়ে সুলতান ১৯৩৮ সালে কলকাতা যান।
তাঁর ইচ্ছা ছিলো অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করার পাশাপাশি চিত্রশিল্পের শিক্ষা চালিয়ে যাবার। এই ইচ্ছা নিয়েই তিনি প্রথমে ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের কলকাতার বাড়িতে উঠেন। এসময় তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং কলকাতা আর্ট স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সোহরাওয়ার্দী, সুলতানকে সব ধরণের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকেন। তাঁর গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য সব সময় উন্মুক্ত ছিলো। ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা না থাকাসত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় তিনি ভর্তি হতে পেরেছিলেন। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেন। পাশ করে একজন ফ্রিল্যান্স চিত্রশিল্পী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
আর্ট স্কুলে পড়লেও সেখানকার বাঁধাধরা জীবন এবং প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার কঠোর রীতিনীতি তাঁর জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলোনা। চেতনায় তিনি ছিলেন স্বাধীন এবং প্রকৃতিগতভাবে ছিলেন ভবঘুরে এবং ছন্নছাড়া। প্রকৃতিকে তিনি সবসময় রোমান্টিক কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন। আবার যান্ত্রিক নগর জীবনকে সেরকমই ঘৃণা করেছেন।
১৯৪৩ সালে তিনি খাকসার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর অব্যবহিত পরেই বেরিয়ে পড়েন এবং উপমাহাদেশের পথে পথে ঘুরে তাঁর অনেকটা সময় কেটে যায়। তখন ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্য ছিলো ভারতে। তিনি ছোট-বড় বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে ছবি এঁকে তা সৈন্যদের কাছে বিক্রি করতেন। এভাবেই তিনি সেসময় জীবনধারণ করেছেন। মাঝে মাঝে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনি শিল্পী হিসেবে কিছুটা পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু সুলতানের চরিত্রে পার্থিব বিষয়ের প্রতি যে অনীহা এবং যে খামখেয়ালীপনা ছিলো তাঁর কারণে সেই ছবিগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর কোনো আলোকচিত্রও এখন পাওয়া যায় না। এছাড়া তিনি কখনও এক স্থানে বেশি দিন থাকতেন না। তাঁর আঁকা ছবির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো ১৯৪৬ সালে সিমলায়।
পাকিস্তান ও ভারতের জন্ম হওয়ার পর এস এম সুলতান কিছু দিনের জন্য নিজ দেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এখানে কিছুদিন থেকেই করাচি চলে যান। সেখানে পারসি স্কুলের শিল্প শিক্ষক হিসেবে দুই বছর চাকুরি করেছিলেন। সেখানে চাকুরিরত থাকা অবস্থায় তাঁর সাথে পরিচয় হয় চুঘতাই এবং শাকের আলীর মত বিখ্যাত শিল্পীদের। এর কিছু আগে ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়। এরপর লন্ডনেও তিনি প্রদর্শনী করেছিলেন।১৯৫৩ সালে তিনি আবার নড়াইলে ফিরে আসেন।
এবার এসে তিনি শিশু শিক্ষার প্রসারে কাজ শুরু করেন যা নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন ছিলো। শেষ বয়সে তিনি নড়াইলে শিশুস্বর্গ এবং চারুপীঠ নামে দুটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড় তুলেছিলেন। এছাড়া সেখানে “নন্দন কানন” নামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং একটি উচ্চ বিদ্যালয় এবং “নন্দন কানন স্কুল অব ফাইন আর্টস” নামে একটি আর্ট স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন।
অনেকটা সময় তাঁর নড়াইলেই কেটে যায়। ঢাকায় আধুনিক চিত্রশিল্পের বিকাশের সময়টায় তিনি প্রায় সকলের অজ্ঞাতেই ছিলেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি শিল্পরসিকদের চোখের আড়ালেই থেকে যান। সত্তরের দশকের মধ্যভাগে তাঁর কিছু শুভানুধ্যায়ী তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এখানে এসে তিনি কিছু ছবি আঁকেন। তাঁর আঁকা এইসব ছবি নিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমেই তিনি নতুন করে শিল্পসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
আশির দশক থেকে তিনি আবার নড়াইলেই চলে আসেন। তাঁর কাছে যেসব মানুষ এবং শিশু আশ্রয় নিয়েছিলো তাদের জন্য তিনি নিজের ঘর ছেড়ে দেন। জীবজন্তুর প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেন এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি বড় আকারের নৌকাও তৈরি করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিলো শিশুরা সেই নৌকায় চড়ে সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে।আশির দশকের শেষদিকে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টোনে তাঁর সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সে বছরেরই আগস্ট মাসে নড়াইলে ঘটা করে তাঁর জন্মদিন পালন করা হয়। ১৯৯৪ সালেরই ১০ অক্টোবর তিনি যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
ছবি : নাসির আলী মামুন
তথ্য : সংগৃহীত
© 2012 – 2018, https:.