আদিবাসী কথকতা
রাজবংশীদের প্রাচীন বসতি ছিল তিব্বত ও ব্রহ্মদেশের পাহাড়ি ও মালভূমি এলাকায়। বর্তমানে এরা উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে বাস করে। এছাড়াও ভারতের কুচবিহার, বিহার, মুর্শিদাবাদ ও আসাম অঞ্চলেও বিপুল পরিমাণ রাজবংশী রয়েছে। এ আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে অগনিত রূপকথা, উপকথা ও পুরাকথা। যুগে যুগে এগুলো আদিবাসীদের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল এবং আছে। আদিবাসী বিশ্বাসের সেই কাহিনিগুলো বেশ চমকপ্রদ। রংপুরের একটি রাজবংশী গ্রামের আদিবাসীরা জানায় তেমনি কয়েকটি কাহিনি।
ধান গাছে ধান হয়। কিন্তু ধান গাছে কেন চাল হয় না? এমন ভাবনার উত্তরে পাওয়া যাবে একটি আদিবাসী কাহিনিতে।
এক সময় সকল মানুষই ছিল সত্যবাদী। তাই সে সময়কে বলা হতো সত্যযুগ। সত্যযুগে মানুষের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল ভগবান। সে সময় ধানগাছে ‘চাল’ হতো। মানুষ খুব সহজেই সরাসরি চাল তুলে রান্না করে খেত। একবার এক ব্যক্তি চালের জমিতে বসে মলত্যাগ করে। মলত্যাগের সময় সে গাছ থেকে চাল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল। তার এমন আচরণে ভগবান ক্ষিপ্ত হন। অতঃপর মানবকুলকে তিনি অভিশাপ দেন, ‘আমার সৃষ্টিকে তোরা মলত্যাগের সময় স্পর্শ করে অপবিত্র করেছিস! এখন থেকে তোদের সাতগুণ পরিশ্রম করে চাল বানিয়ে খেতে হবে, তার আগে নয়।’ সেই থেকে ধান গাছে ধান হওয়া শুরু। আর সেই ধান মাড়াই আর সেদ্ধ করে, বাতাসে শুকিয়ে, ঢেঁকিতে ছাঁটানো ও কুলোতে পরিষ্কার করে রান্নার উপযোগী করে খেতে হয়।
সাপের কেন কান নেই? এমন প্রশ্নে রাজবংশী আদিবাসীরা কাহিনির ঝুড়ি নিয়ে বসেন।
মা মনসা যখন সর্পকুলকে ডেকে বিষ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাল। তখন সর্পকুল দংশন করে পৃথিবীর বহু মানুষকে মেরে ফেললো। এ অবস্থা দেখে মানবকুল গেল মহাদেবের কাছে। তারা মহাদেবকে সার্পকুলের অত্যাচারের কাহিনি খুলে বলল। সব শুনে মহাদেব ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি অভিশাপ দিয়ে সাপদের এক চোখ কানা করে দিলেন। এতেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না। সাপরা যেন মানুষের কোন শব্দ শুনতে না পারে সে কারণে তাদের কানও তুলে নিলেন। অতঃপর পৃথিবীতে সাপদের অত্যাচার গেল কমে।
সাপের প্রসঙ্গ আসতেই রাজবংশীরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়- ‘ঢোঁড়া সাপের বিষ নাই কেন? উত্তর না মিলতেই আরেকটি কাহিনির শুরু-
মা মনসা একদিন সকল সর্পকুলকে ডেকে বিষ প্রদান করলেন। সে সময় তিনি লক্ষ্মীন্দরকে কামড়ানোর নির্দেশ দিলেন ঢোঁড়া সাপকে। এ কারণে তাকে সবার চেয়ে বেশী বিষও দেয়া হলো। বিষ পেয়ে লক্ষ্মীন্দরকে কামড়াতে ঢোঁড়া সাপ যাত্রা শুরু করলো। পথিমধ্যে পড়ল গঙ্গা। এই গঙ্গা পার হতে হবে। গঙ্গায় ছিল অনেক মাছ। মাছ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলো না ঢোঁড়া সাপ। সে কচুপাতায় বিষ রেখে মাছ খেতে খেতে গঙ্গা পার হতে থাকলো। এদিকে কচুপাতায় রাখা বিষ পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া খেয়ে সাবার করল। ঢোঁড়া সাপ ফিরে এসে দেখে, কচুপাতায় বিষ নেই। বিষ হারিয়ে সেই থেকে ঢোঁড়া বিষহীন সাপ। তার এই লোভের কর্মে মনসাদেবী হন মনঃক্ষুন্ন। মনসা অভিশাপ দেন, ‘এখন থেকে সমস্ত লোক তোকে পায়ে মাড়াবে।’ সে থেকে তাই ঘটে আসছে। ঢোঁড়া সাপের বিষ খেয়েছিল বলেই পিঁপড়ে, শিংমাছ, টেংরামাছ, কাঁকড়া ইত্যাদির কাটায় আজো বিষ রয়েছে।
আদিবাসীদের কাছে সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক। আদিম সমাজে মানুষ বৃদ্ধির জন্যই সাপকে পূজা করা হতো। সাঁওতাল, ওরাও, ভুনজারদের কাছে সাপ হলো মনসা, বিষহরি বা জিন্দা দেবতা। দিনাজপুরের বহবলদীঘির ভুনজার আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে মনসার আর্বিভাবের একটি গল্প বা কাহিনি। গোত্র প্রধান বা মহত লবানু সিংয়ের মুখে শোনা কাহিনিটি অনেকটাই এ রকম:
সওদাগর বাড়ীর ছোট বউ ছিল পোয়াতি। একবার সে স্নান করতে যায় পুকুরপাড়ে। সেখানে কতগুলো মাছ মনের আনন্দে খেলা করছিল। তা দেখে ছোট বউ গামছা ছাঁকা দিয়ে মাছগুলো ধরে ফেললো। বাড়ি ফিরে সে মাটির হাঁড়িতে মাছগুলো জিইয়ে রাখলো। পরদিন মাছগুলোকে কাটার জন্য সে হাঁড়ি খুলে দেখলো, মাছগুলো সব সাপ হয়ে গেছে। ছোট বউ তো অবাক! সাপগুলোকে সে মারলো না। অবহেলাও করলো না। বরং দুধ-কলা দিয়ে তাদের পুষতে থাকলো।
ছোট বউয়ের আপ্যায়নে সাপেরা খুশি হলো। তারা তাদের মা মনসার কাছে আবদার করলেন ছোট বউকে যেন তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। মনসা বাচ্চাদের কথা ফেলতে পারলেন না।
একদিন মনসা ছোট বউয়ের মাসী সেজে সওদাগরের বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে ঢুকতেই সাওদাগরের গিন্নি বললেন, ‘কে গো তুমি?’। শাঁখা, সিঁদুর, চুপড়ী, নোয়া, নথাদিপরা মাসী রূপিনী মনসাদেবী বললেন, ‘বেয়ানঠাকুরন, আমাকে চিনবেন না, আমি আপনার ছোট বউয়ের মাসী। বোনঝিকে যত্নাদি করতে কয়েক দিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।’
অনুমতি পেয়ে মাসী বোনঝিকে রথে চড়ালেন এবং চোখ বন্ধ রাখতে বললেন। ছোট বউ তাই করলো। এক সময় সে চোখ খুলে স্থির হয়ে গেল। মস্তবড় এক বাড়ি আর চমৎকার সব আসবাব। সেই বাড়িতে খেলা করছে ওই সাপগুলো, যেগুলোকে সে দুধ দিয়ে পুষেছিলেন।
কয়েকটা দিন ভালোভাবেই কেটে গেল। একদিন কোন এক কারণে সাপেরা রেগে গেল ছোট বউয়ের ওপর। তারা তাকে কামড়াবার জন্য ধাওয়া করলো। সে সময় মনসাদেবী এসে ছোট বউকে বাঁচালো। তাকে ফিরিয়ে দেয়ার সময় মনসা বলল, ‘আমি তোর মাসী নই। আমি মনসা। থাকি ফনীমনসা গাছে। তুই পৃথিবীতে গিয়ে আমার পূজার কথা বলবি। শ্রাবণ মাসের পুরো সময়টা আমার মঙ্গল কাহিনি গাইবি। পূজা দিবি। তাহলে আর সাপের ভয় থাকবে না। সন্তানের জন্যও কষ্ট পেতে হবে না। কেউ কখনও বন্ধ্য হবে না। এই ব্রত যে করবে সে পরম সুখে থাকবে।’
ফিরে এসে ছোটবউ সবকথা সবাইকে খুলে বললো এবং নিজে মনসা পূজা শুরু করে দিলো। মনসার আর্শিবাদে যথাসময়ে তার সুন্দর একটি পুত্র সন্তান হলো। পরম সুখে দিন কাটতে থাকলো তার। ক্রমে সারা দেশব্যাপী এভাবেই মনসার পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠিত হতে থাকলো।
আদিবাসী সমাজে এক সময় লোকচিকিৎসাই ছিল প্রধান। মন্ত্রপাঠ, পানিপড়া, তাবিজ, ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি ছিল রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায়। এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর প্রতি আদিবাসীদের যেমন বিশ্বাস ছিল। তেমনি এ নিয়ে প্রচলিত ছিল নানা মুখরোচর গল্প, যা থেকে আদিবাসী সমাজে রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কোচ আদিবাসী সমাজ থেকে জানা যায় তেমনি একটি হাস্যরসাত্মক কাহিনি।
এক গ্রামে এক যুবক বাস করতো। তার নাম ছিল ডুংগা। বয়স বাইশ বছর। সে নিজেকে খুবই চালাক মনে করতো। কিন্তু তার ছিল একটি বিশ্রি রোগ। কি সেই রোগ? ছোটবেলা থেকে প্রতিরাতেই সে বিছানায় প্রস্রাব করতো। এ নিয়ে ডুংগার বাবার দুচিন্তার অন্ত নেই। অনেক কবিরাজ দেখিয়েও কোন ফল হয় না। একবার এক নামকরা কবিরাজের কাছে ডুংগাকে নিয়ে যাওয়া হলো। কবিরাজ ডুংগাকে দেখে বললো, ‘ওকে বিয়ে করিয়ে দিন। তাহলে এ রোগ আর থাকবে না।’ ডুংগার বাবা তাই করলেন।
কিন্তু বিয়ের পরও ডুংগার সমস্যা গেল না। বুদ্ধিমান ডুংগা নিজেকে বাঁচাতে বুদ্ধি আঁটল। সে বিছানায় প্রস্রাব করে তার স্ত্রীর ওপর দোষ চাপাতে থাকলো। লজ্জা আর অপমানে ডুংগার স্ত্রী রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল।
ডুংগার বাবা ছেলের হাল ছাড়লেন না। তিনি ছেলেকে নিয়ে গেলেন আরেক কবিরাজের কাছে।
কবিরাজ আতপচাল ও তুলসী দোয়া পানি ডুংগার গায়ে ছিটালেন। অতঃপর একটা তাবিজ ও পাঁচটি বড়ি দিলেন। নির্দেশনা প্রতিরাতে বড়ি খেয়ে ঘুমাতে হবে। কবিরাজ ডুংগাকে প্রশ্ন করলো কেন তুমি স্বপ্নের মধ্যে প্রস্রাব কর?একরাতের কথা জানালো ডুংগা- ‘ঘুমের মধ্যে আমি খেলছিলাম। হঠাৎ দলনেতা খেলা বন্ধ করে সবাইকে প্রস্রাব করে আসার নির্দেশ দিলেন। আমি তাই করলাম। এভাবে…।’
শুনে কবিরাজ ডুংগাকে বললো, ‘ওই দলনেতাই হলো শয়তান। এরপর তোমার দলনেতা বা অন্যকেউ যখনই এটা বলবে তুমি তার কাছ থেকে টাকা চাইবে। স্বপ্নে তো সে টাকা দিতে পারবে না। ফলে তোমাকেও আর বিছানায় প্রস্রাব করতে হবে না।’
কবিরাজের কথা মতোই ডুংগা প্রস্তুতি নিল। রাতে বড়ি খেয়ে সে ঘুমাতে গেল। স্বপ্নে এবার শয়তান মামা হয়ে আসল। সে ডুংগাকে প্রস্রাব করার প্রস্তাব করতেই সে টাকা চাইল। মামা বললো আমারও কিছু টাকা দরকার। চল একটা কাজ করি। পাশের বাড়ির মন্ডলের বাড়িতে চুরি করতে যাই। ডুংগাও প্রস্তাবে রাজি হলো। দুজন ঘরের জানালা কেটে মন্ডলের ঘরে যেই ঢুকলো, অমনি চোর চোর বলে সে চিৎকার করতে থাকলো। ভয়ে দুজনেই মন্ডলের বাড়ির আমগাছে আশ্রয় নিল। কিন্তু মন্ডল তো আমগাছের নিচ থেকে সরেই না! চোর ধরতে সে গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।
মামারূপী শয়তান এবার ডুংগাকে বললো, ‘মামা তুমি মন্ডলের মাথায় মলত্যাগ কর। তাহলে সে তা ধুতে পুকুরপাড়ে যাবে। আর সে সুযোগেই আমরা নেমে পালিয়ে যাবো।’
ডুংগা ভাবল জীবন বাঁচাতে এর চেয়ে ভালো বুদ্ধি আর কি হতে পারে ? সে মামার কথামতো মন্ডলের মাথায় মলত্যাগ করলো। আর অমনি শয়তান হাততালি দিতে থাকলো।
ডুংগার ঘুমও গেল ভেঙ্গে। সজাগ হয়ে সে দেখলো বিছানাতেই সে মলত্যাগ করেছে। সে হতভম্ভ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, ‘হায় হায় একি হলো। আগে তো বিছানায় প্রস্রাব করতাম। এখন দেখি পায়খানা করে ফেলেছি।’
এভাবেই কবিরাজের পরামর্শ মাঠে মারা গেল। যুগে যুগে দাদি-নানিদের মুখে শোনা এই কাহিনিগুলোই কোচ আদিবাসী শিশুদের নির্মল আনন্দ দিয়ে আসছে।
তুরি, মুন্ডা, কড়া ও ওরাওদের কাছে বৃক্ষ দেবতাতুল্য। এ স¤প্রদায়ের আদিবাসীরা ‘কারমা পূজার’ আনুষ্ঠানিকতা পালন করে ধুমধামের সঙ্গে। কড়াদের কাছে এটি কর্মভাগ্য লাভের পূজা। মূলত এটি একটি গাছের পূজা। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের পূজা করে কড়ারা। এ পূজা নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কাহিনি। দিনাজপুরে হালজায় গ্রামে রয়েছে কড়াদের একমাত্র গ্রাম। কারমা পূজা নিয়ে সে গ্রামের মাহাতো জগেন কড়ার মুখে শোনা কাহিনিটি;
কারাম আর ধারাম ছিল দুই ভাই। কারাম বড় আর ধারাম ছোট। তাদের একমাত্র আদরের বোনের নাম পারাবেতী। একবার ভাদ্র মাসে গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে ধান গাড়ার ‘হাউলি’র (কাজের বিনিময়ে খাওয়ার) ডাক দেয়। গ্রামের অন্যদের সঙ্গে কারাম আর ধারামও যায় সেখানে। ভোর বেলা কিছু চারা লাগিয়ে সকালের নাস্তা বা পনতা (পানতা) খেতে দু’ভাই কলা পাতা নিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু কারাম আর ধারামের কাছে এসেই শেষ হয়ে যায় পানতা। পানতা না পেয়ে দু’ভাই বড়ই দুঃখ পায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বড় ভাই কারাম ছোটকে সান্ত¦না দেয়। নিশ্চয়ই দুপুরে খাবার পাওয়া যাবে। সে আশায় দু’ভাই আবার কাজে ফিরে যায়।
তাদের ধান গাড়া শেষ হয় দুপুরে। কলাপাতা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে তারাও বসে পড়ে লাইনে। কিšত্ত এবারও ঘটল একই ঘটনা। তাদের পর্যন্ত এসেই খাবার শেষ হয়ে গেল। এবার তারা খুবই কষ্ট পেল। প্রচন্ড রাগে ও কষ্টে ছোটভাই চাইল তার গাড়া ধানের চারাগুলো তুলে ফেলতে। বড়ভাই কারাম তাকে শান্ত করে বাড়ির দিকে রওনা হলো।
পথের কাছে ছিল একটি বটগাছ। তাদের দুঃখের কথা শুনে সে বলল,‘তোদের কারমা কপাল জেড় গেল’ (তোমাদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে)। সে উপদেশ দেয় সাত সমুদ্র লংকা পার হয়ে কর্মভাগ্য নিয়ে আসার। বটগাছের কথা বিশ্বাস করে কারাম আর ধারাম বাড়ি এসে রওনা হয় কর্মভাগ্য আনতে।
কিছুদূর যেতেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় একটি কুল গাছের। কারাম-ধারাম এর কথা শুনে সেও জানায় তার দুঃখের কথা। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসার জন্য দু’ভাইকে সে অনুরোধ করে। যেতে যেতেই কারাম-ধারাম এর দেখা হয় একটি ডুমুর গাছের সঙ্গে। ডুমুর গাছ তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে আফসোস করে বলে, ‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে কিন্তু মানুষ ও পাখি সে দিকে ফিরেও তাকায় না।’ এ নিয়ে তার অনেক দুঃখ। সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী । নদীর তীরে দুটি হাতি মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে, ‘আমরা জানি না আর কতদিন আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে কাঁদায় ঢাকা থাকবো।’ দুই ভাইকে তারা অনুরোধ করে তাদের ভাগ্যটিও জেনে আসার। নদী পার হয়ে কিছুদূর যেতেই কারাম-ধারাম লংকার সমুদ্রের কাছে এসে পৌঁছায়। বিশাল সমুদ্র কিভাবে পাড় হওয়া যায়? সে চিন্তায় তারা সমুদ্র তীরে বসে থাকে।
সে সমুদ্রে ছিল একটি বড় কুমির। কুমিরের গলায় কাটা বিধেছে সাতদিন আগে। যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কাটা বের করতে সে কারাম-ধারামের সাহায্য চায়। সমুদ্র পাড় করানো ও নিয়ে আসার শর্তে কারাম-ধারাম কুমিরের গলার কাটা বের করে দেয়। অতঃপর কুমিরের পিঠে চড়ে দুইভাই লংকার সমুদ্র পার হতেই দেখা পায় কর্মভাগ্যের। কর্মভাগ্যের সারা শরীর তখন পোকায় খাচ্ছিল। কারাম ধারাম যখনই তা স্পর্শ করলো তখনই সেটা গাছ হয়ে গেল। কারাম-ধারামের মধ্যে অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হল। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে ফিরতে থাকলো।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে কারাম ধারাম বলল, তোমাদের এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিস্কার করে দিবে। হাতি দুটি তাদেরকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মিনতি করলো। তারা তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসলো। এরপর ডুমুর গাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে তারা বলল, তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলসি ধন আছে সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুর গাছ কারাম-ধারামকে সাত কলস ধন তুলে নেয়ার অনুরোধ করলো । তারা সাত কলস ধন হাতির পিঠে তুলে নিল। কুল গাছের সঙ্গে দেখা হতেই কারাম-ধারাম তাকেও একই কথা বলল। সেও তার গোড়ার মাটির নিচের সাত কলস ধন তুলে নেয়ার মিনতি করলো। কারাম-ধারাম তাই করলো। এভাবে তারা কর্মভাগ্য নিয়ে সেই বটগাছের কাছে চলে আসলো।
বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে এনে পূজা করার নির্দেশ দিলো। সে সময় থেকেই কারমা পূজার প্রচলন হয় এবং গাছটির নামকরণ হয় কারমা গাছ। আদিবাসীরা আজো বিশ্বাস করে কারমা পূজা তাদের অভাবমুক্তি আর সৌভাগ্য লাভের পূজা।
পাহাড় ও নদী নিয়েও আদিবাসী সমাজে প্রচলিত আছে নানা কাহিনি। চমৎকার সে কাহিনিগুলো অনেক রূপকথাকেও হার মানায়। এরকম লোককাহিনিগুলোর মাধ্যমেই আদিবাসী শিশুরা আত্মত্যাগের শিক্ষা পেয়ে আসছে। প্রখ্যাত লেখক আব্দুস সাত্তারের লেখায় পাওয়া যায় সে রকম কয়েকটি লোককাহিনি।
লুসাই পাহাড় থেকে উদ্ভুত কর্ণফুলী নদীরই একটি শাখা তুইচং নদীটি। লুসাই সমাজে এ নদীর জন্ম নিয়ে প্রচলিত আছে একটি কাহিনি এমনই-
তুইচংগী ও নোয়েংগী নামে ছিল দুই বোন। দুই বোনে ছিল খুব ভাব। একদিন দুই বোন মিলে গেল গহীন অরণ্যে। তাদের ইচ্ছে জুম চাষ করার। চৈত্র মাস ছিল। হঠাৎ ছোট বোনের প্রচন্ড পিপাসা পায়। কিন্ত অরণ্যের কোথাও জলের দেখা নেই। জল না হলে তো তাকে বাঁচানো দায়।
বড় বোন তুইচংগী যাদুমন্ত্র জানতো। ছোটবোনকে বাঁচাতে তিনি মন্ত্রবলে নদী হয়ে গেলেন। সে নদীর জলে ছোটবোন নোয়েংগী পিপাসা মিটিয়ে জীবন বাঁচাল। কিন্তু বড় বোনকে না পেয়ে তার দুঃখের সীমা রইলো না। সে নদীর পাড়ে বসে কান্নাজুড়ে দিল।
বোনের কান্নায় নদীর জল গেল বেড়ে। সে জলে ভাটির দেশ গেল ডুবে। ভাটি অঞ্চলের রাজা অসময়ে এমন প্লাবন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি পানসী সাজিয়ে বের হলেন নদীর উৎস সন্ধানে। দীর্ঘদিন চলার পর রাজা এসে পৌঁছালেন এক পাহাড়ের পাদদেশে। সেখান থেকেই জল গড়িয়ে চলছে ভাটির দেশে। আর নদীর উৎসমুখে বসে কাঁদছে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা।
রাজা নোয়েংগীকে দেখে মুগ্ধ হলেন। তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন নিজ বাড়িতে।
নোয়েংগী ছাড়াও রাজার ছিল আরো তিন রানী। তাকে দেখে তারা হিংস্র হয়ে উঠলেন। কিন্তু নোয়েংগী ছিলেন ধর্মপরায়ণ। সে অন্য রাণীদের বেশ শ্রদ্ধা করতো।
এভাবেই দিন কাটতে থাকলো। নোয়েংগীর ঘরে এলো এক সুন্দর ছেলে। কিন্তু অন্য রানীরা ছিলেন আটকুড়ে। তারা ভাবল এই ছেলেকে মেরে ফেলতে হবে। তা না হলে রাজার নজর থাকবে শুধুই নোয়েংগীর ওপর। তারা তাই করল। ছেলেটিকে চুরি করে ফেলে দিল নদীতে।
নদী হলো তার মায়ের বোন। বোনের ছেলেকে নদী লালন-পালন করতে থাকলো। এভাবে নোয়েংগীর ঘরে পর পর আরও তিনটি ছেলে হলো। সবাইকেই সতীনেরা নদীতে ফেলে দিলো। কিন্তু এতো অত্যাচারের পরও নোয়েংগী কোন কথাই রাজাকে জানালো না।
ওদিকে নদী নোয়েংগীর চার সন্তানকেই লালন পালন করে বড় করে তুলল। তারাও যোগ্য মানুষ হিসেবে বড় হলো।
একদিন নদী তাদেরকে রাজদরবারে পাঠিয়ে দিলো। রাজা তাদের সুন্দর চেহারা, নাচগান ও মধুর কথাবার্তা শুনে অবাক হলেন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কে?’ চার ছেলে একসঙ্গে উত্তর দিল, ‘আমরা আপনার ছেলে।’ অতঃপর তারা রাজার কাছে সব খুলে বলল।
সব শুনে রাজা তো অবাক। রাজা স্ত্রী নোয়েংগীকে ডেকে পাঠালেন। তার কাছে সব শুনলেন। সব শুনে রাজা প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি তিন রানীকে কেটে অরণ্যে পুঁতে ফেলার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর রাজা তার চারপুত্রসহ আনন্দে দিন কাটাতে লাগলেন।
এই কারণে তুইচংগী কেবল মাত্র নদী নয় লুসাই আদিবাসী সমাজের কাছে পরম শ্রদ্ধার স্থান।
লুসাইদের মতো চাকমা আদিবাসীদের কাছে গোমতী নদী অতি পবিত্র। এই নদীর জন্ম নিয়ে চাকমা সমাজে প্রচলিত রয়েছে একটি লোকগল্প।
এক ছিল এক বৃদ্ধ। সে এত অলস ছিল যে কলার খোসা পর্যন্ত ছাড়িয়ে খেতে পারতো না। তার ছিল দুই কন্যা। বৃদ্ধ তাদের ওপর জুমের ভার দিয়ে নিজে কিছুই করতো না।
বৈশাখ মাসে একদিন দু’বোন গেল জুমচাষ করতে। কাজ করতে করতে বেলা শেষ হয়ে গেল। চারদিকে নামলো অন্ধকার। চারপাশ থেকে বইছে বাতাস। কোন আশ্রয় না পেয়ে দুই বোন কপাল চাপড়ে কাঁদতে লাগলো।
বড়জন বলল, সাপ-ব্যাঙ, দেবতা-দানব, ভূত-প্রেত রাজা বা প্রজা যেই আমাকে এখানে একটি ঘর তুলে দিবে আমি তাকেই বিয়ে করবো। এ কথা শুনে এক বিরাট সাপ বাঁশ বহন করে এনে ঘর তুলে দিলো। বড়বোন তখন ওই সাপকেই বিয়ে করলো।
সকাল হতেই এ খবর পৌঁছালো তার পিতার কানে। সে ওই সাপটিকে ধরে এনে কেটে ফেললো। বাবার এমন আচরণে বড় মেয়ে কষ্ট পেলো। মনের দুঃখে বড় মেয়ে কেঁদে দু’চোখ পানিতে ভাসিয়ে দিলো। এই পানি জমে তৈরি হলো একটি নদী। সে নদীতেই সে ডুবে মরলো। এই নদীই গোমতী নদী নামে খ্যাত। কথিত আছে, সাপের বেশে টিপরা রাজপুত্র বড় মেয়েকে ঘর তুলে দিয়েছিল।
পাহাড়, বন ও প্রকৃতিই আদিবাসীদের জীবন। কিন্তু এদেশে দখল হচ্ছে পাহাড়, উজাড় হচ্ছে বন, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। ফলে দেশ, সমাজ ও গোত্র ছাড়া হচ্ছে প্রকৃতজনেরা। পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণান্তর চেষ্টা চলছে আদিবাসী সমাজে। দারিদ্র্য, ভূমিদস্যুদের সঙ্গে লড়াই আর ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভনে আদিবাসীরা হারিয়ে ফেলছে নিজস্ব আচার আর রীতিনীতিগুলোকে। কিন্তু এখনও হারায়নি তাদের সমৃদ্ধময় রূপকথা ও উপকথাগুলো। বরং আদিবাসীদের মুখে মুখে প্রচলিত এই কাহিনিগুলো বেঁচে থাকবে যুগ যুগ। ছড়িয়ে পড়বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক মানবজমিন, ঈদ সংখ্যা- ২০১২ তে
© 2012 – 2018, https:.