গল্পে গল্পে গারো বিদ্রোহ
বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙ্গল তার। আমরাও অপেক্ষায় ছিলাম। জলপান আর নাস্তা সেরেই শুরু হলো কথোপকথন। প্রশ্নের পিঠে মিলে উত্তর। ধীরতালে, থেমেথেমে।
বয়স তার ১০৩ বছর। চামড়ার পরতে পরতে যেন ইতিহাস লুকানো। ডামুকী রিছিল ও কৃষ্ণ মোহন সাংমার দুই ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। গারো রীতিতে মায়ের টাইটেল লাভ করায় তার নাম হরিপদ রিছিল।
হরিপদ রিছিল বেশ নিবেদিতপ্রাণ। চিকিৎসা আর লেখাপড়ার সাহায্য চাইলে কোনো আদিবাসীকেই তিনি না বলেন না। সাহায্য করেন সাধ্যমতো। দেশভাগ, রায়ট, স্বাধীনতা আর বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কালের সাক্ষী এ গারো আদিবাসীর সঙ্গে দেখা করতে আমরা এসেছি হালুয়াঘাটে, তার আচকিপাড়ার বাড়িতে।
ধারা ইউনিয়নের মাইজিয়াল গ্রামে হরিপদের জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে। ছোটবেলাতেই হারান বাবা-মাকে। ফলে হরিপদ বেড়ে ওঠেন তার জেঠিমার বাড়িতে। শৈশব ও কৈশোর কাটে দুর্গাপুরের আমড়াতলা গ্রামে। হরিপদ পড়াশোনা করেছেন মাইনর ক্লাশ পর্যন্ত।
ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত হন আচিক সংঘের সাথে। ১৯৩৩-৩৪ সালে আচিক সংঘের প্রেসিডেন্ট মারা গেলে তিনিই তা পুনর্গঠিত করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৪ সালে রায়ট বাঁধলে অধিকাংশ আদিবাসীই চলে যান ভারতে। কিন্তু হরিপদ সাহসিকতার সঙ্গে এদেশে থেকেই প্রতিকুলতা মোকাবেলা করেন।
১৯৭১ সালে তার ছেলে প্রদীপ চিসিম অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। আইজান চিসিম ও গেন্দা রিছিলের প্রথমা কন্যা প্রতিভা চিসিম এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয়া কন্যা প্রেমলতা চিসিমের সঙ্গে বিবাহ হয় হরিপদ রিছিলের।
কথা শুরু হয় হালুয়াঘাটে বাঙালিদের আগমণ নিয়ে। হরিপদ উদাহরণ টেনে বলেন, “এই ভবনকুড়া ইউনিয়নে তিন বাড়ি ছিল বাঙালি। গোটা এলাকাটি ছিল গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু আদিবাসীদের। ১৯৫০ ও ১৯৬৪ তে রায়ট হয়। সে সময় ট্রাক ভরে ফুলপুর, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, ভালুকা, গফরগাওঁ থেকে পাকিস্তানি সরকার লোক এনে হালুয়াঘাটের রাস্তার ফেলে যায়। ওরা তখন হাজং, বানাই ও ডালুদের বাড়ি দখল করে নেয়। ফলে বহু আদিবাসী জীবন বাঁচাতে চলে যায় মেঘালয়ে।”
হরিপদ দীর্ঘদিন তামাক ব্যবসা করেন তার বাঙালি বন্ধু লাল মাহমুদ ও তার পুত্র হক সাহেবের সঙ্গে। তাদের গ্রামের বাড়ি ছিল রংপুরের হারাগাছ পৌরসভায়। তার ভাষায়, “সব বাঙালি তো খারাপ নয়। সাম্প্রদায়িক মনোভাব যাদের মধ্যে থাকে তারাই সকলের জন্য ক্ষতিকর।”
হরিপদ মনে করেন, এ অঞ্চলে কৃষক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা ছিল আদিবাসীদের। তিনি বলেন, “ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল আদিবাসীদের দ্বারাই। অথচ আজ আদিবাসী যুবকরাই তো জানে না তাদের পূর্বপুরুষদের সংগ্রামের কাহিনিগুলো।”
আমরা আগ্রহি হতেই হরিপদ গল্পের মতো করে শোনান ময়মনসিংহে গারো জাগরণের ইতিহাসটি।
গারোরা ছিল বেশ নির্জনতাপ্রিয়। গারোপাহাড়ের দুর্গম এলাকায় ছিল তাদের বাস। কিন্তু অহরহ গোষ্ঠীসংগ্রামের কারণে তারা চলে আসে বর্তমান বাংলাদেশের সমভূমিতে। সেসময় এসব এলাকায় জনবসতি ছিল বিরল। প্রথমদিকে গারোরা ঝুমচাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করলেও পরবর্তীতে তারা স্থায়ী চাষাবাদ পদ্ধতি রপ্ত করে নেয়। আর এভাবেই বিস্তীর্ণ এলাকা বসবাসের উপযোগী করে গারোরা স্বাধীনভাবে বসবাস করতে থাকে।
গারোরা ছোট ছোট স্বাধীন গারোরাজ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত। মুসলমানরা যখন বঙ্গ বিজয় করে তখন হতে স্বাধীন গারো রাজত্বের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে সুসং রাজ্য পতনের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে গারোদের স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব লোপ পায়।
হঠাৎ হরিপদ থেমে যান। চা আর মুড়ি হাতে ঘরে ঢোকেন তার ছোট মেয়ে তুলি চিসিম ও জামাতা রঞ্জিত রুগা। কাপা কাপা গলায় হরিপদ আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “ছপাতি নকমা কে ছিলেন?” কোনো উত্তর মিলে না। অতঃপর হরিপদ বলতে থাকেন…
ছপাতি নকমাই প্রথম গারোদের সশস্ত্র সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। সুসং দুর্গাপুরের শঙ্করপুর গ্রামের ‘আকিং নকমা’ বা গ্রাম প্রধান ছিলেন ছপাতি। তার ছিল অসীম সাহস আর তীক্ষ্ম বুদ্ধি। তার স্বপ্ন ছিল এ অঞ্চলের আদিবাসীদের নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করা। সে লক্ষে তিনি সুসং, শেরপুর, কড়ইবাড়ি প্রভৃতি জমিদারী এলাকার গারো, হাজং, কোচ, হদি, বানাই প্রভৃতি আদিবাসীদের মাঝে গণসংযোগও শুরু করেন।
কিন্তু তার এই পরিকল্পনা জমিদাররা টের পেয়ে যায়। ফলে নানাভাবে তারা ছপাতির বিরুদ্ধে আদিবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় ছপাতির স্বপ্ন।
১৮০২ সালের কথা। সে সময় ব্রিটিশরা শেরপুর ও সুসং জমিদারদের পার্বত্য অঞ্চল থেকে কোনো রাজস্ব পেত না। এ নিয়ে জমিদারদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। ছপাতি তখন ময়মনসিংহ গিয়ে দেখা করেন তদানীন্তন জেলা কালেক্টরের সঙ্গে। প্রস্তাব করেন, জমিদারদের কবলমুক্ত করে আদিবাসীদের পার্বত্য এলাকাকে ভিন্ন একটি জেলায় রূপ দিলে তিনিই ওই অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব নেবেন। ছপাতির প্রস্তাব কালেক্টর মঞ্জুর করলেও বোর্ড অব রেভিনিউতে গারোরাজ্য স্থাপনের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
তবুও হাল ছাড়েন না ছপাতি নকমা। তিনি সুসং দুর্গাপুর হতে শেরপুর পর্যন্ত গারোদের মাঝে গণজাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করতে থাকেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে খানিক থামেন হরিপদ। অতঃপর শুরু করেন টিপু গারোর সংগ্রামের কাহিনী।
কর আদায়ের জন্য ক্রমেই আদিবাসীদের ওপর জমিদারদের শোষণ ও নির্যাতন বেড়ে যেতে থাকল। এদিকে, দশসালা বন্দোবস্তে ব্রিটিশরা ময়মনসিংহের পার্বত্য এলাকার বার্ষিক রাজস্ব ধার্য করে দেয় মাত্র বারো টাকা। কিন্তু জমিদারগণ নিরীহ আদিবাসী প্রজাদের কাছ থেকে নানাবিধ বে-আইনী করের অজুহাতে আদায় করতো বিশ হাজার টাকারও বেশি।এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা আদিবাসীরা একসময় জমিদারদের বিরুদ্ধে একজোট হয়। তারা খাজনা প্রদানও বন্ধ করে দেয়। তাদের নেতৃত্ব দেন টিপু গারো।
আমাদের প্রশ্ন, কে এই টিপু গারো? মুচকি হেসে হরিপদ বলতে থাকেন, ১৮০২ সালের পরের কথা। করম শাহ্ নামক এক ব্যক্তির বাউল ধর্মমতে বিশ্বাসী হতে থাকে শেরপুরের গারোরা। এ ধর্মমতের প্রধান ভিত্তি ছিল সাম্যবাদ। সেসময় সুসং দুর্গাপুরের লেটিয়াকান্দা গ্রামের টিপু গারোও সাম্যবাদী মতে বিশ্বাসী হন। করম শাহ্’র মৃত্যু হলে টিপুই করমের বাউল ধর্মমত প্রচারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে একবার শেরপুরের গারোদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় জমিদার বাহিনীর। সেসময় টিপুর নেতৃত্বে প্রায় সহস্রাধিক বিদ্রোহী গারো শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে এক নতুন গারোরাজ্য স্থাপন করে। কিন্তু গারোদের ওই স্বাধীন রাজত্বকাল মাত্র দু’বছরের মতো স্থায়ী হয়।
১৮২৬ সালের শেষের দিকের কথা। ইংরেজদের একটি সৈন্যদল রংপুর থেকে আসে জামালপুরে। ওই সৈন্যদলের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয় টিপু গারোদের। সে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শেরপুর ছেড়ে দেয় গারোরা। টিপুকে বন্দী করা হয় গড়দলিফা থেকে। ইংরেজদের বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কারাবাসকালেই ১৮৫২ সালের মে মাসে টিপু মৃত্যুবরণ করেন।
টিপুরা কি পরাজিত হয়েছিলেন? হরিপদের উত্তর, “অবশ্যই না!”
বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর আঘাত ব্রিটিশ সরকারকে নাড়িয়ে দেয়। ফলে ইংরেজরা আদিবাসীদের করের বোঝা আংশিক মওকুফ করে দেয়। কিন্তু তবুও গারোদের পুঞ্জিভূত অসন্তোষ দূর হয় না।
এরপর কে নেতৃত্ব দিল?
টিপুর দুই অনুসারী গুমানু সরকার ও উজির সরকার। টিপুর মৃত্যুর কয়েক বছর পর এরা শেরপুর জমিদারবাড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তবে তার পূর্বেই তাদের বন্দী করা হয়।
হরিপদ বলেন, এরপরও গারোদের গণজাগরন বন্ধ থেমে থাকেনি।
শুরু হয় জানকু পাথাং ও দুবরাজ পাথাং’র নেতৃত্বে নকমা বিদ্রোহ। বিদ্রোহী গারোদের একটি দল নিয়ে জানকু শেরপুরের পশ্চিম কড়ইবাড়িতে এবং অপর একটি দল নিয়ে দুবরাজ নালিতাবাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। সেসময় বিদ্রোহীরা শেরপুর থানা জ্বালিয়ে দেয়।
সংবাদ পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট গেরেট ময়মনসিংহ থেকে সৈন্য নিয়ে আসেন নালিতাবাড়িতে। রাতের আঁধারে দুবরাজ সদলবলে আক্রমণ চালায় তাদের ওপর। এতে প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে যায় গেরেট। নিহত হয় ইংরেজদের বহু সৈন্য।
এই ‘দুঃসংবাদে’ কেঁপে ওঠে ব্রিটিশরা। বিদ্রোহ দমন করতে এরপর আরও অস্ত্র-শস্ত্রে বলীয়ান সৈন্যবাহিনীসহ পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন সিলকে। বিদ্রোহী গারোরা আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত ও অস্ত্রসজ্জিত ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালায় প্রায় দু’মাস। সেসময় ইংরেজ সৈন্যরা নির্মমম অত্যাচার চালায়। তারা জ্বালিয়ে দিতে থাকে গারো গ্রামগুলো। ফলে নিরুপায় গারো নকমাদের অনেকেই আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু জানকে ও দুবরাজ পাথাং এর আর কোনো সন্ধান মেলেনি।
আমরা আনমনে শুনছিলাম। প্রশ্ন করি, গারোদের বিদ্রোহ কি থেমে গিয়েছিল? হরিপদের উত্তর, “না!”
ব্রিটিশ শাসক ও জমিদারদের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে গারোরা বিভিন্ন সময়ে জমিদারী এলাকাসমূহে সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। ১৮৭১ সালের দিকে একদল গারো ইংরেজ জরীপ-দলের কয়েকজনকে হত্যাও করে। এরপর ১৮৮২ সালে গারোরা পুনরায় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিলে ব্রিটিশ শাসকরা তা থামিয়ে দেয়।
চারদিকে অন্ধকার নামতেই আমাদের আসর ভাঙ্গে। বিদায় নিই একজন কালের সাক্ষীর কাছে থেকে। বিদায় বেলায় জড়ানো কন্ঠে হরিপদ শুধু একটিই অনুরোধ করেন, “আদিবাসীদের গৌরবময় সংগ্রামের কথা যেন ইতিহাস থেকে হারিয়ে না যায়।”
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তে
© 2012 – 2018, https:.