দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অট্টালিকা বানাইছে
বাড়ির নাম আসমা কটেজ। সাইনবোর্ডে তেমনটাই লেখা। মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিংয়ের এ বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের মেয়ে আসমা উল হুসনার। চিকিৎসা করাতে মেয়ের বাড়িতে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধা বাবা। এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে মিলে এমন খবর। সেই সূত্র ধরে এক সকালে আমরাও হাজির হই সেই বাড়িতে।
দখিনা জানালার ছোট্ট একটি রুম। খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান। বয়স আটান্ন। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। দৃষ্টি তার জানালার ওপাশে। আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছেন তিনি। আমাদের উপস্থিতিতে ফিরে আসেন চিন্তার রাজ্য থেকে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের ডান পায়ের গোড়ালিতে চোখ পড়ে আমাদের। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজের একাংশ রক্তে ভেজা। দু-এক দিন আগের কোনো ক্ষত হবে হয়তো। কিন্তু না, মুক্তিযোদ্ধা হান্নান যা জানালেন তা শুনে আমরা স্থির হয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্প্লিন্টার এখনো রয়ে গেছে তার পায়ের গোড়ালিতে। এ পর্যন্ত সাতবার অপারেশন হয়েছে। তবু মুক্তি মেলেনি। গোড়ালির ভেতরটায় এখন ইনফেকশন হয়ে গেছে। ফলে এক দিন পর পরই চলে ড্রেসিং। দিনের পর দিন এভাবে পায়ের ব্যথা আর ড্রেসিংয়ের যন্ত্রণা সহ্য করেই কেটে যাচ্ছে এই বীরের জীবনপ্রবাহ। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কেটে যাচ্ছে একচল্লিশটি বছর। অথচ আজও পায়ের গোড়ালিতে স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান।
আব্দুল হান্নানের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মিরাশনি গ্রামে। পিতা আব্দুল খালেক ভূইয়া ও মাতা বাদশার মায়ের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। খানিকটা দুরন্ত হলেও সবার কাছে তিনি আদর পেতেন। ১৯৭১ এ তিনি ছিলেন মিরাশনি পলিটেকনিক একাডেমি হাইস্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী। এপ্রিলের ২২ তারিখ ছিল পরীক্ষার তারিখ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সে পরীক্ষা আর দেওয়া হয় না আব্দুল হান্নানের।
১৯৭০ সালের শেষের দিকের কথা। সিঙ্গার বিল ইউনিয়নের উজিরবাড়ি স্কুল মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আয়োজন করে মুজাহিদ ট্রেনিংয়ের। আব্দুল হান্নান সে সময় তাদের কাছ থেকে তিন মাসের সশস্ত্র মুজাহিদ ট্রেনিং নেন। কিন্তু তখনো তিনি বুঝতে পারেননি, ওই ট্রেনিং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই লড়াই করতে কাজে লাগবে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মিরাশনি রেললাইনের পশ্চিমে ক্যাম্প বসায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। একটি বাড়ি দখল করে তাতে ক্যাম্প করে তারা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বাঙালি নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো ক্যাম্পে। এই কাজটির দায়িত্ব ছিল রাজাকারদের ওপর।
মা-বোনকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতেন রাজাকার সিদ্দিকুর রহমান ও হুমায়ুন কবীর। চোখের সামনে মা-বোনদের অপমানের কষ্ট সহ্য করতে পারেন না আব্দুল হান্নান। গোপনে সংঘবদ্ধ হতে থাকেন আরও তিন বন্ধু আ. মালেক, মিজানুর রহমান ও আব্দুল আলিম। একদিন সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার।
১ মে ১৯৭১। পরিবারকে না জানিয়ে তিন বন্ধুসহ আব্দুল হান্নান নওয়াবাদী বর্ডার হয়ে চলে যান ভারতের নরসিংহগড় ক্যাম্পে। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুনুর রশিদ। ট্রেনিং থাকায় তাদের যুক্ত রাখা হয় নাইন বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে।
মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান যুদ্ধ করেন ২ নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আব্দুল হান্নান যুদ্ধ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাশিমপুর, বিষ্ণুপুর, কালারো টি গার্ডেন, হিরাতলা শ্রীপুর, কাঞ্চনপুর, কাশিমনগর, নোয়াগাঁও প্রভৃতি এলাকায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অপারেশনে তিনি আহত হন, সে অপারেশনটির কথা শুনি আব্দুল হান্নানের জবানিতে। তিনি বলেন, ‘আগস্টের ২ তারিখ। রাত ২টা। নরসিংহগড় ক্যাম্প থেকে আমরা পজিশন নিই নোয়াবাদী রেললাইনের পাশে। আমরা ছিলাম দশজন। আমার সাথী ছিলেন হাবিলদার নবী। টার্গেট ছিল পূর্বপাশের পাকিস্তান সেনাবাহিনীদের একটি ক্যাম্পে আক্রমণ করা। গোলাগুলি শুরু হতেই আমি ও হাবিলদার নবী টুইন্স মর্টারের গুলি আরম্ভ করি। এই মেশিনটা চালাতে লাগে দুজন। আমরা ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত গুলি চালাই। হঠাৎ পাকিস্তান সেনাদের ছোড়া একটি টুইন্স মর্টার এসে পড়ে আমাদের থেকে ৩০ হাত দূরে। সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গাটি বিরাট গর্ত হয়ে যায়। বিকট শব্দে সেখান থেকে স্পিøন্টার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। বেশ কিছু স্প্লিন্টার ঢুকে যায় আমার পায়ে। আমি তখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শুধুই গুলি চালাচ্ছিলাম। বরং মনে হচ্ছিল, ডান পায়ে কেমন যেন আরাম লাগছে। সেখান থেকে তখন রক্ত বেরোচ্ছিল। খেয়াল করতেই দেখলাম, ডান পায়ের গোড়ালি চূর্ন-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ওই পা অবশ হয়ে যায়। দৃষ্টিটাও ঝাপসা হয়ে আসে।
ভোর পাঁচটার পর বন্ধু আ. মালেক, মিজানুর রহমান ও আব্দুল আলিম আমাকে উদ্ধার করে। প্রথমে চিকিৎসা হয় আগরতলার জেবি হাসপাতালে। তিন-চার দিন আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। হাসপাতালেই আমাকে দেখতে আসেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। পরবর্তীকালে আমার চিকিৎসা হয় কলকাতা, গুয়াহাটি এবং সবশেষে রামগড়ে। হাসপাতালে বসেই খবর পাই দেশ স্বাধীনের। ওই দিন ভারতীয় সৈন্যরা এসেছিল কোলাকুলি করতে। কী যে আনন্দ লেগেছিল সেদিন। আজও মনে পড়ে দিনটির কথা।
আব্দুল হান্নান কেন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন, এই অপরাধে রাজাকাররা লাঠিপেটা করে হান্নানের শতোর্ধ্ব বাবাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘এহন যারা মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাচ্ছে তারা অনেকেই তো মুক্তিযোদ্ধা না। এ কথা বললে তো পরের দিনই আমারে মেরে ফেলবে। এটা কিন্তু সরকারের দোষ না। এটা আমাদের নিজের দোষ। আমরা টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধা বানাচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যুদ্ধের পর পরই করা উচিত ছিল।’
তার মতে, একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা আরেকজন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধাকে হিসেবে শনাক্ত করতে পারে না। অথচ বিভিন্ন সরকারের আমলে এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা ও কামান্ডার হয়েছে অনেকেই।
স্বাধীন দেশে একজন রাজাকার হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি, এমন উক্তি করে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে কথোপকথনের একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আবদুর রহমান বিশ্বাস তখন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বঙ্গভবনে এক অনুষ্ঠানে ডাকা হয় আমাদের। হাত মেলাতে তিনি কাছে এলে আমি প্রশ্ন করি, ‘একটা রাজাকার হইয়া আপনি কীভাবে প্রেসিডেন্টের পদ দখল করলেন, উনি উত্তরে বললেন, ‘এগুলো কি আপনারা ভুলে যেতে পারেন না।’ আমি বলি, ‘আপনি যে রাজাকার ছিলেন মরবার আগ পর্যন্ত ভুলব না।’ উনিও প্রশ্ন ছুড়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষ যদি আমারে বানায়, তাহলে আপনারা কী করবেন?’ সেদিন আমরা তার সঙ্গে হাত মেলাইনি। বলেছিলাম, ‘জিয়ার স্ত্রীর সঙ্গে তবু হাত মেলানো যায় কিন্তু একজন রাজাকারের সঙ্গে নয়।’ কিন্তু তার কথা শুনে আমরা সত্যি কষ্ট পেয়েছিলাম। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন না হয়ে দেশটা ভিয়েতনামের মতো যদি ৬ বছরে স্বাধীন হতো, তা হলে এ দেশের মানুষ বুঝতে পারত, স্বাধীনতার মানে কী।’
মুক্তিযুদ্ধের পরের বাংলাদেশ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই যোদ্ধা। তার মতে, ‘রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু কই, এ দেশের সাধারণ ঘরের একজন শিক্ষিত ছেলে তো চাকরি পাচ্ছে না। তদবির আর টাকা ছাড়া এখন চাকরি হয় না। তা হলে এ স্বাধীনতার কী মূল্য আছে।’ তিনি বলেন, ‘এ দেশের জন্য একটা পতাকা আমার এনে দিয়েছি। এ পতাকা রক্ষা করার মালিক জনগণ। জনগণ যত দিন সচেতন হবে না তত দিন দেশ ঠিক হবে না।’
চোখের কোণে জল ভিজিয়ে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান আক্ষেপ করে বলেন, ‘পায়ে স্প্লিন্টার নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলি। বিবর্ণ কাপড় দেখে অনেকেই মনে করেন ভিক্ষুক যাচ্ছে। ধার-কর্জ করে পায়ের চিকিৎসা চালাচ্ছি। আর দুই নম্বর মুক্তিযোদ্ধারা অট্টালিকা বানাইছে। এসব দেখে নিজের পরিবারও আজ প্রশ্ন করে তুমি কেমন মুক্তিযোদ্ধা? তুমি কী করতে পেরেছ?’
আমাদের সঙ্গে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের সহধর্মিণী জহুরা বেগমের। তিনি জানালেন ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একবার চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল আব্দুল হান্নানের। মহাখালীর হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত যথেষ্ট সম্মান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। হাসপাতালে তার অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে নাম কাটিয়ে আমরা চলে আসি। বলেছি, এ চিকিৎসার দরকার নেই।’
পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলে না মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নানের। তবু বুকভরা আশা নিয়ে তিনি বললেন, ‘এ দেশটা তো স্বাধীন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষার পবিত্র দায়িতটুকু নিশ্চয়ই পালন করবে পরবর্তী প্রজন্ম।’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক কাগজে, ৭ অক্টোবর ২০১২ তে
© 2012 – 2021, https:.