জগথায় গণকবর
‘পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প ছিল পীরগঞ্জ হাসপাতালে। এক সকালে তারা হানা দেয় আমাদের বাড়িতে। ধরে নিয়ে যায় আমার বাবা দর্শন আলীকে। বাড়ির দক্ষিণ পাশে এক নির্জন জায়গায় বড় গর্ত খুঁড়তে হবে। তবেই মিলবে তার মুক্তি। এমন প্রতিশ্রুতিতে ধরে আনা হয় জগথা গ্রামের সিনদারু মোহাম্মদ, ইয়াসিন ওরফে অয়াসু মোহাম্মদ ও ইব্রাহীমকেও।
‘শুরু হয় মাটি খোঁড়া। দুপুরের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় বড় একটি গর্ত। কাজ শেষে ছেড়েও দেওয়া হয় সবাইকে। তবুও মনের ভেতর অজানা ভয়।
‘বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। একে একে সেখানে ধরে আনা হয় মুক্তিকামী বাঙালিদের। সবার হাত পেছনে বাঁধা। পালা করে তাদের গর্তের সামনে দাঁড় করানো হয়। অতঃপর গুলির শব্দ। রাতভর চলে এ হত্যা উৎসব। মানুষের আর্তচিৎকারে ওই রাতে ভারী হয়ে ওঠে জগথা গ্রামের বাতাস।
‘ভোর হতেই দেখি রক্তাক্ত মানুষে গর্তটা ভর্তি। দুই শতাধিক লাশ। অধিকাংশই যুবক বয়সী। আশপাশে ছোপ ছোপ রক্ত।
‘আমি কোদাল চালাই। লাশগুলো ঢাকতে এগিয়ে আসে আবদুল হামিদও। অচেনা লাশের ভিড়ে মেলে দুটি চেনামুখ। পয়েন্দা গ্রামের জামাল উদ্দিন ও ভেগদল সরকার। নিজ হাতে মাটিচাপা দিই তাদের। তিন দিন লেগেছিল লাশগুলো মাটিতে ঢাকতে।’ জগথা গণকবরের পেছনের কথা বলছিলেন হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষদর্শী মো. দরিমান আলী।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার ভেতরে জগথা গ্রামটি। ওই গ্রামের ফকিরপাড়া মোড়ের এক পাশে দরিমান আলীর বাড়ি। অন্য পাশে রাস্তার ধারঘেঁষা কলার খেত। তা পেরোলেই মাঠের এক পাশে বেগুনখেত। অন্য পাশে ধানখেত। দুই খেতের মাঝের আইল বরাবর মেলে নাম না-জানা গাছের জংলা। এ জংলা স্থানটিই শহীদদের গণকবর।
দরিমান আলীকে সঙ্গে নিয়ে এভাবেই আমরা খুঁজে পাই জগথার গণকবরটি। কোনো ঘের নেই। নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন। অবহেলা আর অশ্রদ্ধায় সেখানে পড়ে আছে শহীদদের গণকবরটি।
শহীদ জামাল উদ্দিনের ছেলে জালাল উদ্দিন। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছর। জানালেন তাঁর বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা।
জামাল উদ্দিন পয়েন্দা গ্রামের সবার কাছে জামাল চৌধুরী নামেই ছিলেন অধিক পরিচিত। সেই গ্রামে বিহারিদের তৎপরতা ছিল বেশি। লুটতরাজ ছাড়াও তারা পাকিস্তানি সেনাদের চিনিয়ে দিত বাঙালিদের বাড়িগুলো। একবার পয়েন্দা গ্রামে মুক্তিকামী বাঙালিদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় বিহারিদের। সে সময় জামাল উদ্দিন মানবতার খাতিরে রক্ষা করেন কয়েকজন বিহারিকে। কিন্তু বেঁচে যাওয়া ওই বিহারিরাই কাল হয়ে আসে তাঁর জীবনে।
২২ এপ্রিল, ১৯৭১। ফজরের সময়। পয়েন্দা গ্রামকে ঘিরে ফেলে বিহারি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মসজিদ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় জামাল উদ্দিনকে। যে বিহারিদের তিনি প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, তারাই তাঁর দিকে আঙুল তাক করে ওই দিন বলেছিল, ‘এ আদমি হামকো মারা হে।’ সে সময় বিহারিদের নেতৃত্ব দেন হাতেম আলী, নিজামুদ্দিন, মো. ঈশা, আবদুর রহমান, মজিদসহ কয়েকজন।
প্রথমে পীরগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে নির্যাতন করা হয় এবং ওই দিন সন্ধ্যায়ই জামাল উদ্দিনকে হত্যা করা হয় জগথায়। একই সঙ্গে হত্যা করা হয় তাঁর ভাই মহির উদ্দিন, রশিদুর রহমান, আবদুল লতিফ, ভাতিজা নজরুল ইসলাম, মজির উদ্দিনসহ পরিবারের আটজনকে। হত্যা করা হয় বেগুনগাঁও ভাল্লি মসজিদের ঈমামসহ অনেককেই।
জালাল উদ্দিন দুঃখ করে বলেন, যাঁদের রক্তে দেশটা স্বাধীন হলো, তাঁদের কথা মনে রাখল না এ জাতি।
জামাল উদ্দিনের পাশেই শহীদ ভেগদল রহমানের বাড়ি। তাঁর ছোট ছেলে দরিমান রহমান। কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
সারা দেশে তখন যুদ্ধ চলছে। চলছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দোসরদের অত্যাচার। এসব দেখে ঠিক থাকতে পারে না ভেগদলের বড় ছেলে ফজলুর রহমান। এক রাতে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে।
এ খবর পৌঁছে যায় পীরগঞ্জ সেনা ক্যাম্পে। ওই দিন দুপুরেই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ভেগদলকে। সন্ধ্যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ধরা দিলে তবেই মিলবে তাঁর মুক্তি। পরিবারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের ছিল না কোনো যোগাযোগ। ফলে ছেলে না আসায় ওই দিন সন্ধ্যায় ভেগদলকে হত্যা করা হয় জগথায়।
কান্নাজড়ানো কণ্ঠে দরিমান রহমান বলেন, ‘যেখানে হত্যা করা হলো বাবাকে, সে গণকবরটি সংরক্ষণ করল না স্বাধীন দেশের কোনো সরকার। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।’ পাশ থেকে এ বিষয়ে জালাল উদ্দিন বলেন, প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি অদ্যাবধি।
কথা বলেন জালালের বড় ভাই আলাল উদ্দিনও। তাঁর ভাষায়, ‘মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের আটজনকে হারিয়েছি। এখন আল্লাহর ওপর বিচার দিয়ে চুপচাপ আছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে গণকবরের জায়গা কিনে নিয়ে হলেও আমরা চাই এটি সংরক্ষণ করতে।’
গণকবরটি নিয়ে কথা হয় পীরগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার মো. শেকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শহীদদের সম্মান পদদলিত হচ্ছে জগথায়। গণকবরটি সংরক্ষণের জন্য প্রশাসনের কাছে বহুবার আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
গণকবরের জায়গার মালিক সাবেক এমপি ইমদাদুল হক। স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহী হলে তিনিই পারেন গণকবরটি সংরক্ষণ করতে। এ বিষয়ে কথা হয় ইমদাদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু জগথাই নয়, ঠাকুরগাঁওয়ের প্রতিটি গণকবরই সংরক্ষণ করা উচিত।
শহীদদের গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা না হলে ধীরে ধীরে বিবর্ণ হতে থাকবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তাই পীরগঞ্জের শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, দ্রুত সংরক্ষণ করা হোক অশ্রদ্ধায় পড়ে থাকা জগথা গণকবরটি।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলো ৩ নভেম্বর ২০১২ তে
© 2012 – 2021, https:.