তিস্তা ব্যারাজে একদিন
হিমালয়ের চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারীর খড়িবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে। নদীটির নাম আসলে ত্রি-স্রোতা। লোকমুখে হয়ে গেছে তিস্তা।
দারুণ নীলে আকাশ মাখামাখি। সাদা মেঘ তার ওপর ভেলা ভাসিয়ে চলেছে দূরে কোথাও। কিছু মেঘ যেন বেশি দূরের আকাশ পাড়ি দিয়ে সীমানার ওপারে চলে গেল।
হঠাৎ ব্যারাজের ওপর গমগম শব্দ। তাকিয়ে দেখি একটি ট্রাক ছুটে যাচ্ছে এপার থেকে ওপারে। খোলা ছিল ব্যারাজের তিনটি স্লুইস গেট। ঢেউ তুলে সেখান দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে ভারত থেকে আসা পানি। পানির খেলা দেখতে জটলা করেছে অতিথিরা।
ভোরবেলায় বন্ধু অরণ্যকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি নীলফামারীর ডোমার। বন্ধু কাজিমের বাড়ি এখানেই। সকাল সকাল আমাদের দেখতে পেয়ে বন্ধুপত্নীর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। নাশতায় বেশ বাহারি সব পদ মিলল। নাশতা সেরে আমি আর অরণ্য গা এলিয়ে দিই।
চার ঘণ্টা টানা ঘুমিয়ে নিলাম। পরিকল্পনা ছিল দুপুরের খাবার সেরে বেরিয়ে পড়ব।
এরই মধ্যে একটি মাইক্রোবাস জুটিয়ে ফেলে কাজিম। প্রথম কোথায় যাব? কাজিম ভারী গলায় বলে, ‘অবশ্যই তিস্তা ব্যারাজ।’ অরণ্য ‘ওয়াও’ বলে সায় দেয়। ডোমার থেকে ব্যারাজ প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা হয়েও ব্যারাজে যাওয়া যায়।
তিস্তা ব্যারাজ লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানীকে যুক্ত করেছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিসা চাপানী ইউনিয়নের ডালিয়া গ্রামের সঙ্গে।
পৌঁছাতে বিকেল ৩টা বেজে গেল। বড় একটি গেট পেরিয়ে মূল ব্যারাজের পাশেই থেমে যায় আমাদের গাড়ি।
ব্যারাজ এলাকায় দোকানপাট বেশি নেই। ভ্যানে একটি চলন্ত দোকান নিয়ে ঘুরছে এরশাদ। তার কাছ থেকে আমরা কয়েক প্যাকেট চিপস কিনে নিই।
চলতে চলতে কাজিম বলতে থাকে তিস্তা নদীর কাহিনী-হিমালয়ের চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারীর খড়িবাড়ী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়ে মিশেছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে। নদীটির নাম আসলে ত্রি-স্রোতা। লোকমুখে হয়ে গেছে তিস্তা।
অরণ্য এর মধ্যে গান ধরেছে, ‘আমার একটা নদী ছিল জানলো না তো কেউ, এইখানে এক নদী ছিল জানলো না তো কেউ।’ ঘোরাঘুরির একপর্যায়ে একটি চমৎকার রেস্ট হাউসের দিকে চোখ যায়। নাম অবসর। শুনেছি বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা এখানে অবসর কাটাতে আসেন। ভেতরে ঢুকতে গেলে বাধা পাই-সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। কেয়ারটেকার জানালেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনুমতি ছাড়া মাছিও ঢুকতে পারবে না। আমরা তাই আর ওপথ মাড়াই না।
এরপর কাজিম ব্যারাজের ইতিহাস মেলে ধরল-একসময় সেচের অভাবে উত্তরবঙ্গে বহু আবাদি জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিল। জমিগুলোকে সেচের মাধ্যমে চাষের উপযোগী করার লক্ষ্যেই ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়। ব্যারাজের কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। শেষ হয় ১৯৯০-তে। ব্যারাজের দৈর্ঘ্য ৬১৫ মিটার। বাইপাস ক্যানেলের ওপর নির্মিত গেটসহ মোট স্লুইস গেট রয়েছে ৫২টি।
তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে প্রথম দিকে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর জেলার ১.১১ লাখ হেক্টর জমিকে সেচ সুবিধার আওতায় আনা হয়। পরিকল্পনা ছিল দিনাজপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া আর জয়পুরহাটকেও সেচের আওতায় আনার। কিন্তু পরে তা আর সম্ভব হয়নি।
তিস্তা ব্যারাজের ঠিক দক্ষিণ পাড়ে একটি বটগাছ। গাছের নিচে বসে গল্প করছেন কয়েকজন মাঝি। বেশ কয়েকটি জেলে নৌকা ভাসছে তিস্তার বুকে। জাল টেনে নৌকার ওপর হরেকরকম মাছ তুলে আনছেন জেলেরা। হালিম মাঝি জানালেন এ সময় নাকি তিস্তায় মেলে বড় বড় বোয়াল। শুনেই লকলক করে ওঠে জিহ্বা।
আমরা যাই ব্যারাজের পশ্চিম পাশের ক্যানেলে। এদিকটা অন্য রকম। সবুজে ঘেরা। অচিন পাখির ডাকে নির্জনতা ভাঙে। মনে হয় যেন চলে এসেছি অন্য কোনো ভুবনে। এখানেই পরিচয় হয় ঢাকা থেকে আসা সাংবাদিক মৃদুল আহমেদের সঙ্গে। আলাপ জমতেই বললেন, এত সুন্দর জায়গা কিন্তু থাকার তেমন বন্দোবস্ত নেই।
সূর্যটা হেলে পড়তেই চারপাশে অন্ধকার নামে। পুবের আকাশে ওঠে চাঁদ। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ে তিস্তার বুকে। সে এক অন্য রকম দৃশ্য।
সন্ধ্যার পর তিস্তা ব্যারাজে থাকতে মানা। তাই আমরা ফিরতি পথ ধরি। একে একে জ্বলে ওঠে ব্যারাজের ল্যাম্পপোস্টগুলো। নিয়ন আলো বুকে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তিস্তা ব্যারাজ।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ১৯ নভেম্বর ২০১২
© 2012 – 2018, https:.