জীবনকথা

মানজুরের স্বপ্নে সেন্ট্রাল কিচেন

বন্ধু আরিফ থাকেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। কৃষি মার্কেটের পাশেই ভাড়া বাড়িতে। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই কর্মজীবী।

প্রতিদিন সকালে নাস্তা সেরে সবাই বেরিয়ে পড়ে যে যার কাজে। নিজের ব্যবসার ফাঁকে মেয়েকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজটিও আরিফকেই করতে হয়। স্ত্রী সাথী বাড়ি ফিরেন রাতে। ঢাকায় দুঃসহ যানজট। তা পেরিয়ে সে বাড়ি পৌঁছায় প্রতিদিন রাত আটটায়। অতঃপর নো- রেস্ট। শুরু হয় রান্নার কাজ।
পরদিন দুপুর পর্যন্ত সবার খাবার রান্না শেষে তবেই মিলে মুক্তি। কখনও কখনও বাজারের বোঝাও চেপে বসে তার ওপর। বাড়িতে নেই কাজের বুয়া। ফলে রান্নার নানা কাজে ছোট্ট ছোট্ট ভালবাসাটুকুও উবে যায় সাথী-আরিফের জীবন থেকে। এ মহানগরে আরিফ-সাথীর মতো পরিবারের সংখ্যাটি কত? তাও নেহায়েত কম নয়! জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত পরিবারের সংখ্যা রাজধানীতে ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

কিন্তু মোহাম্মদপুরে এই পরিবারের জীবনযাপন চিত্রটিই আজ বদলে গেছে। আরিফ-সাথীর সংসারের উনুন এখন প্রতিদিন জ্বলছে না। সাথী এখন রান্না করে শখের বসে। বন্ধের কয়েকটি দিন মাত্র। এ পরিবারের তিন বেলাতেই খাবার চলে বাড়ির পাশের মজা’তে। মজার খাবারে মজায় মজায় কেটে যাচ্ছে তাদের দিনগুলো।

এ শহরে হোটেলগুলোর চিত্র আসলে কেমন? তা কল্পনা করলেই যেন গ্যাসটিকের জ্বালা বেড়ে যায়। পোড়া তেলে রান্না, অপরিচ্ছন্ন উপস্থাপন আর পঁচা-বাশি খাবারের যক্কি যেমন আছে তেমনি আছে পকেটকাটা দামের আশফালন। অনেক হোটেলের রান্নাঘরটিও খুঁজে পাওয়া দায়। যদিও তা মিলে, তবে তার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ যে কোনো মানুষকেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলবে।

তাহলে কি পরিবারটি এমনি কোনো হোটেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে? এমনটাই প্রশ্নই ছিল আমাদের। উত্তরে আরিফ বলেন, ‘মোটেই না। ‘মজা’ সে রকম কোনো হোটেল নয়। এটি একটি ফ্রেশ কিচেনস। মজার খাবারের মান ও স্বাদ যেমন মুখোরোচর তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত। আর দামটাও আয়ত্বের মধ্যে। মজার রান্না ঘর ও রান্না পরিবেশন ঢঙ, এক কথায় অনন্য।’

    মজা, মোহাম্মদপুর, তাজমহল রোড, সি ব্লগ
মজা, মোহাম্মদপুর, তাজমহল রোড, সি ব্লগ

মজা’র কথায় আমরা মজে যাই। আগ্রহী হতেই এক বিকেলে আমাদের পায়ের ছাপ পড়ে মজাতে। কৃষি মার্কেটের দক্ষিণ পাশ্বের গলি পথেই ফ্রেস কিচেনস ‘মজা’-এর অবস্থান। মজায় নারী-পুরুষের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। একটি ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে চারটি ছোট্ট রুম নিয়ে গড়ে উঠেছে মজা। লাল-সাদার হাতছানি প্রায় সবখানে। প্রথম দর্শনেই চোখে পড়বে বাঁয়ের কিচেনটি। সেখানে পুরো দস্তুর চলছে রান্নার কাজ। যে কাউকেই মুগ্ধ করবে এর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ।

ঢুকতেই হাতের ডানে বসার জন্য নজরুল গ্যালারি, ভেতরে চার্লি চ্যাপলিন গ্যালারি, শেক্সপিয়র গ্যালারি আর পাশাপাশি আছে লালন ও রবীন্দ্রনাথ গ্যালারি।

গ্যালারিগুলোতে কাঠের টেবিল ও চেয়ার পরিপাটিভাবে সাজানো। খাবার উপস্থাপন করা হচ্ছে কাসা ও পিতলের বাসনে একেবারেই অন্যরকম বাঙালি ঢঙে। মজার প্রতিটি কর্ণার এসএস দিয়ে মোড়ানো। আলো-আঁধারি পরিবেশে চমৎকার কিছু লাইটের ঝলকানি আমাদের আন্দোলিত করে।
মজা’তে ওয়েটারদের ‘মামু’ বলা নিষেধ। আমরা অর্ডার করি। গল্পে গল্পে কেটে যায় খানিকটা সময়। অতঃপর হাস্যোজ্জল মুখে এক যুবক কাসার কড়াইয়ে মজার হালিমটি পরিবেশন করে টেবিলে। চমৎকার উপস্থাপন ঢঙ আর ধোয়া তোলা হালিমের স্বাদে আমরা তৃপ্ত হই। খেতে খেতেই জেনে নিই মজার খাবারের ফিরিস্তিটি।

সকালে পরোটা ও নানের সঙ্গে ৬ ধরণের সবজি দিয়ে রান্না হয় ভাজি, কলিজা ভুনা, মুগের ঢাল, খাসির পায়া, গরুর কালো ভুনা প্রভৃতি। দুপুরে ও রাতে কাটারিভোগের সাদা ভাতের সঙ্গে পোড়া টমেটো ভর্তা, পোড়া চিংড়ি ভর্তা, পোড়া বেগুন ভর্তা, কাঁচকলা ভর্তা, রূপচাঁদা ফ্রাই, রুই ভুনা, পাবদা ভুনা, চিংড়ি, বাইন, কই ও টেংরা ভুনা, বাতাসি চচ্চড়ি, মলা ও কাচকি চচ্চড়ি, বিফ রেজালা, কোপ্তা ভুনা ও ঝাল চিকেন।

এছাড়াও আছে রূপচাঁদা কাচ্ছি, ইলিশ পোলাও, পিপুলি পোলাও ও বিফ পুদিনা পোলাও প্রভৃতি। মজায় তৈরি হয় ইলিশ মাছের কাচ্ছি, যা মিলবে না ঢাকার অন্যকোনে রেস্টুরেন্টে।  এসব খাবারের সঙ্গে মিলবে বরই আর তেঁতুলের আচারের মিশ্রণে তৈরি স্পেশাল সালাদ। খাবার শেষে মিলবে ঘরোয়া পায়েস ও দুধ বড়া। এছাড়া বিকেলে বিভিন্ন ধরণের কাবার ও গ্রিল পাওয়া যায় মজাতে।
রুচিশীল এই ফ্রেস কিচেনস এর উদ্যোগতার খোজ করি আমরা। কিচেনে অন্য সবার সঙ্গে কাজ করছিলেন মাঝ বয়সী এক লোক। হাতের কাজ সেরেই তিনি নিজেকে উপস্থাপন করলেন আমাদের কাছে।

মজার উদ্যোগতা সাদাফ হাসনাইন মানজুর। বাড়ি তাজমহল রোডেই। জীবনের অধিকাংশ সময়টাই কাটিয়েছেন দেশের বাইরে। জীবনের প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউকে, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া প্রভৃতি দেশে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সেখানকার রেস্তোরাগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা। রান্না ও রেস্তোরা বিষয়ক কাজের প্রতি ঝোক ছিল সবসময়।

মজার রকমারি খাবার
মজার রকমারি খাবার

সে আগ্রহ আর অভিজ্ঞতা থেকেই গড়ে উঠে মজা। মানজুরের ভাষায়, ‘দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতেই মাথায় আসে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যেন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারে- তা নিয়ে কিছু করার। তাই ২০১১ সালের ২৬ জানুয়ারি গড়ে তুলি মজা নামক ফ্রেস কিচেনসটি। স্লোগান দিই ‘ইওর টেস্ট, উই কেয়ার।’

কথা উঠে এদেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপযোগী খাবার হোটেলগুলো প্রসঙ্গ। মানজুর তুলে ধরেন নিজের অভিমতটি। তিনি বলেন, ‘যারা হোটেল ব্যবসায় যুক্ত তাদের অধিকাংশই হয়তো একসময় হোটেলেই কাজ করতেন। ফলে নতুন নতুন হোটেল গড়ে উঠলেও খাবারের মান ও পরিবেশের তেমন কোনো উন্নয়ন ঘটেনি।’

তিনি আরো বলেন, ‘সম্ভাবনা থাকলেও এ পেশায় শিক্ষিত যুবকের অভাব রয়েছে। রুচিশীল ও শিক্ষিত উদ্যোগতা বাড়লে হোটেলগুলোর মান ও পরিবেশ আরো উন্নত হবে।’

মজায় প্রতিদিন ৮শ থেকে ১ হাজার লোক আসে খাওয়ার জন্য। যাদের ৮০ শতাংশই সপরিবারে। এখানে দুই শিফটে কাজ করে ৪০ জন যুবক। কাস্টমার সেবা সম্পর্কে তাদের নিয়মিত কাউন্সিলিং করান মানজুর নিজেই।

তার কাছে প্রশ্ন ছুড়ি, ‘কেনো পরিবারগুলো মজায় খেতে আসবে?’ মুচকি হেসে তিনি উত্তরে বলেন, ‘এখানকার খাবার মানসম্মত। পরিবেশ অসম্ভব পরিচ্ছন্ন, যা অন্য কোথাও খুঁজে পাবেন না। প্রতি দুই ঘন্টা পর পর ফ্লোর ও টেবিল সাবান ও ডেটল দিয়ে পরিস্কার করা হয়। মজার রান্নায় রাইস ব্র্যান্ড অয়েল ব্যবহার করা হয়। যা কোলেস্ট্ররল মুক্ত। এছাড়া মজায় তেলের কোনো রি-ইউজ হয় না। এ কারণেই মজায় সমুচা, সিংগারা ও পুরি তৈরি হয় না।’
খানিক থেমে তিনি আরো বলেন, ‘মজার কিচেন যে কেউই ভিজিট করার ক্ষমতা রাখেন। প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিনই শেষ হয়ে যায়। কোনোদিন খাবার বেচে গেলে তা রাতেই গরিব শ্রমজীবীদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়। খুব ভোরে পাখিদের খাবার দিয়ে শুরু হয় মজার বিক্রয়। মজায় সবকিছুই অন্যরকম। একেবারে জীবন ছোয়া।’
খাবারের দাম ও লাভের কথা উঠতেই মানজুর অকপটে বলেন, ‘ কম লাভ কিন্তু অধিক লোক খাওয়ানোটাই উদ্দেশ্য। সেবা অনুসারে খাবারের খরচ খুবই ন্যায়সংগত। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত যে কোনো পরিবারের একেবারে আয়ত্ত্বের মধ্যে।’
ব্যাপক চাহিদার কারণে ঢাকায় মজার আরো কয়েকটি শাখা খোলার পরিকল্পনার কথা জানান মানজুর। তিনি স্বপ্ন দেখেন এদেশে সেন্ট্রাল কিচেন গড়ে তোলার।
যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শত শত পরিবারের জন্য রান্না হবে এক হাড়িতে। সেন্ট্রাল কিচেনের মানসম্মত রান্না পৌঁছে যাবে সবার ঘরে ঘরে। শত শত পরিবার যুক্ত হবে এক পরিবারে। বাড়বে মানুষে মানুষে যোগাযোগ ও আন্তরিকতা। পরিবারে থাকবে না রান্নার জক্কি ঝামেলা। আর খরচও থাকবে আয়ত্ত্বের মধ্যে।
মানজুরের ভাষায়, ‘এ রাজধানীতে মানুষের জীবনযাপন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। মানুষ শুধু ছুটছে মানুষের প্রয়োজনে। এক সময় মানুষের এই ব্যস্ত জীবনকে সহজ করবে সেন্ট্রাল কিচেন। ফলে সহজ হবে প্রত্যেকেরই পারিবারিক জীবন। আর কর্মসংস্থান তৈরি হবে শত শত যুবকের।’

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে  জানুয়ারি ১৯, ২০১৩

© 2013 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button