জয় বাংলা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান
সাংবাদিকদের কাছে অনেক সাক্ষাতকার দিয়েছি। তা ছাপাও হয়েছে। সেই সাক্ষাতকার পড়ে অনেকেই যুদ্ধকালীন সময়ের ঘটনা বানিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে। এ পন্থায় কয়েকজন অমুক্তিযোদ্ধারাও হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। তাই এখন কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’ কথার শুরুতে এভাবেই কথাগুলো বললেন মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মোঃ গোলাম মোস্তফা। তিনি বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ উপাধি বীর বিক্রম ও একইসঙ্গে বীর প্রতীক সম্মাননা পেয়েছেন। এক সকালে তার হুমায়ুন রোডের বাড়িতে বসে আলাপ চলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা বিষয় নিয়ে।
গোলাম মোস্তফা ঢাকার দোহার উপজেলার ঝনকি গ্রামের সন্তান। তার বাবার নাম ফালু শেখ ও মা আমেনা আসিয়া। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কর্মরত ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে প্রথমে ল্যান্স কর্পোরেল ও পরে কর্পোরেল হন। সেনাবাহিনীর ব্যারাকের ভেতরের বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ ওদের কাছে আমরা ছিলাম বাঙাল। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদেরকে নানাভাবে উপহাস করতো। আমরা খেতাম ভাত, ওরা খেত রুটি। এ নিয়ে শুনতে হতো নানা কথা। প্রতিবাদ করলে উল্টো শাস্তি পেতে হতো।’
তার কাছে বঙ্গবন্ধু হলেন বাংলার অলি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে তিনি ব্যারাক থেকে গোপনে চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। গোলাম মোস্তফার কাছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিই স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। তার ভাষায়, ‘ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রুর মোকাবিলা কর। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কি হতে পারে।’ তিনি বলেন,‘জয় বাংলা স্লোগান- ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান। এই স্লোগান মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসকে বাড়িয়ে দিত কয়েকগুন।
২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নামে ঢাকার বুকে। গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। রক্তাক্ত হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হল। সারাদেশে শুরু হয় যুদ্ধ।
জয়দেবপুর থেকে বেড়িয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন অবস্থান নেয় ভৈরবে। এ রেজিমেন্টের অধীনে গোলাম মোস্তফা যুদ্ধ করেন ৩ নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল কে.এম শফিউল্লাহ। পরবর্তীতে এস ফোর্স গঠিত হলে তিনি একইসঙ্গে এ ফোর্সেরও নেতৃত্ব দেন। প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিয়ে সেসময় গঠিত হয় এক একটি কোম্পানি। আলফা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম। গোলাম মোস্তফা ছিলেন এ কোম্পানির একটি সেকশনের কমান্ডার।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এপ্রিল মাসে আমরা ঢাকা অভিমুখে ঢোকার চেষ্টা করি। নরসিংদী পর্যন্ত এসে আবার পিছু হটি। ব্রাক্ষবাড়িয়া, আশুগঞ্জ হয়ে মাধবপুরে গিয়ে ডিফেন্স নেই। আমাদের কাছে ছিল স্টেনগান, থ্রি ইন্চ মটার, হেবী মেশিন গান প্রভৃতি। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে ছিল আর্টিলারী, ফোর ইন্চ মটার, কামান ও ট্যান্ক। ফলে আমরা সেখানেও টিকতে পারি না। ভারতের তেলিয়াপাড়া হয়ে চাকলা মারা বাজারের কাছে পঞ্চভুটি পাহাড়ের কাছে অবস্থান নিই আমরা। সেখান থেকে মনতলা, নওয়াপাড়া, তেলিয়াপাড়া, গোপালপুর, মাধবপুর, ধর্মগড় প্রভৃতি এলাকায় আক্রমণ করে ফিরে আসতাম।’
১৪ আগষ্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ওইদিন বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা এক অনুষ্ঠানে সমবেত হয় সিলেটের মাধবপুরে। অনুষ্ঠান শেষে তারা ফিরবে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। আলফা কোম্পানির কমান্ডারের নির্দেশে গোলাম মোস্তফারা মাধবপুরের গোপালপুর সড়কের মোড়ে অ্যামম্বুশ করেন। তখন মধ্যরাত। কেউ গাছের ডাল জড়িয়ে কেউবা ঝুপড়ির নিচে অপেক্ষায় রইলেন। সবার দৃষ্টি রাস্তার দিকে।
পরিকল্পনা ছিল একসঙ্গে পাকিস্তানিদের অনেকগুলো গাড়িকে আক্রমণের। এ সিদ্ধান্ত তাদের বিপদ ডেকে আনে। সেসময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিল দুজন অপরিচিত লোক। তারা ছিল পাকিস্তানিদের অনুচর। গোলাম মোস্তফারা তা বুঝতে পারে না। তারা লোক দুটিকে পেছন দিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সকাল হতেই তারা দেখল তাদেরকে তিনদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পাকিস্তানিরা। প্রাণ নিয়ে পালানোর কোনো পথ নেই। ফলে তারা অবস্থান নেয় পাটখেতে। কয়েকঘন্টা চলে গুলি বিনিময়। পরে বহুকষ্টে তারা ধর্মগড় দিয়ে চলে আসে নিরাপদ স্থানে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চান্দুয়ায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আহত হন গোলাম মোস্তফা। পাকিস্তানিদের ব্রাশ ফায়ারের গুলি লাগে তার দুই পায়ে। পরে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্যই গোলাম মোস্তফা দুটি খেতাব পেয়েছেন। সেদিনের ঘটনার কথা উঠতেই তিনি বলেন, ‘ আমি তখন সেভেন প্লাটুনের কমান্ডে ছিলাম। মাধবপুরের চান্দুয়া ডাকবাঙ্গলোর কাছে আমরা অবস্থান নিই। উদ্দেশ্য শাহবাজপুর ব্রিজ ও আশপাশের এলাকায় আক্রমণ করা। সেখানে ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালি ঘাটি। পরিকল্পনা হয়, বি কোম্পানি থাকবে কাট-আপ পার্টি হিসেবে। অন্যদিক থেকে আক্রমণ আসলে তারা তা প্রতিহত করবে।
বেলা তখন সোয়া চারটা। আমরা ডাক বাংলো থেকে সিএমভির রাস্তা দিয়ে চান্দনা ব্রিজের পাশে অবস্থান নিই। হঠাৎ গুলির শব্দ। তাকিয়ে দেখি ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি সৈন্য ভর্তি ট্রাক ও পেছনে একটি আর্মির জিপগাড়ি। তারা আমাদের দিকে তাক করে গুলি চালাচ্ছিল। আমি তখন ব্রিজের ওপর উঠে পড়ি। জয় বাংলা স্লোগান তুলে চালাই গুলি। গুলির তোড়ে ছিটকে পরে পাকিস্তানিদের ট্রাকটি। ট্রাক থেকে নেমে পাকিস্তানিরা অবস্থান নেয় ব্রিজের পাশের বান্কারে।
ব্রিজের পার্শ্ব থেকে এক পাকিস্তানি সৈন্য এলএমজি চলাচ্ছিল। তার কারণে আমরা এগোতে পারছিলাম না। আমাদের এলএমজি ম্যান ছিল ফজলু। তার কাছ থেকে এলএমজিটা নিয়ে আমি সোজা উঠে যাই ব্রিজের ওপর। ওই পাকিস্তানির দিকে তাক করে গুলি চালাই। কিন্তু তার আগেই কয়েকটি গুলি আমার শরীরে এসে লাগে। আমি প্রথমে টের পাইনি। শীরের রক্ত টগবগ করছিল। পাশ থেকে আদম আলী চিৎকার দিয়ে ওঠেন, ‘স্যার গো, স্যার আপনার পেটে গুলি লাগছে।’ আমি তখন বাম পাশে উপুর হয়ে পড়ে যাই। আমার হাত-পা চলছিল না। মনে মনে নিই আল্লাহর নামÑ লা ইলাহা আল্লাহু… ।
সবাই আমার চারপাশে ভিড় করে। আমি নির্দেশ দিই আগে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পন করাও। ওরা তাই করে। মাত্র আধ ঘন্টার ওই অপারেশনে শহীদ হন হাবিলদার রফিক ও সিপাহী নজরুল। আমি সহ আহত হয় ১৭-১৮ জন। প্রথমে আগারতলা হাসাপাতালে এবং পরে ধর্মদহ, গোহাটী ও লাকনো ট্রমা হাসপাতালে চিকিৎসা চলে আমার।’
সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চাকুরী পূর্ণ করেই অবসর নিতে পারবেন – এমন নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনের পর সরকারিভাবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গোলাম মোস্তফা তাই স্বাধীনের পর যোগ দেন সেনাবহিনীতেই। কিন্তু পচাঁত্তরের পর সে নির্দেশনা বাতিল হয়। ফলে ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসর দেয়া।
মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা জানান সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধার অনেকটাই অবহেলিত। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেনাবাহিনীর বাঙালী অফিসার ও জোয়ানরাই। অথচ সেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা পাননা কোনে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তাদের দেয়া হয় শুধুই তাদের চাকুরির অবসরভাতা। অথচ সরকারি অন্য বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম বদবৎ নেই। অন্যরা অবসরভাতার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাভাতাও পেয়ে থাকেন। এ নিয়ম প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘আমি নিজে ইনেস্ট্রাকটর ছিলাম। ট্রেনিং করিয়েছি প্রায় ২৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে। সেনাবহিনীর লোকেরাই মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করেছে। অথচ স্বাধীন দেশে তাদের দেয়া হয়না কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভাতা।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘ ৭২ এ একটি নির্দেশনা ছিল যারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শুধু তারাই থানা কমান্ডার হতে পারবেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়মটিও বাতিল হয়। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবে কিছু অমুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার হওয়ায় তাদের হাত ধরেই অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকাররা তালিকায় আসে।’ তিনি মনে করেন তালিকা করার উপযুক্ত সময় ছিল ১৯৭২-৭৩ এ। তার ভাষায়, ‘৭৩ এ খেতাব প্রাপ্তদের তালিকার গেজেট প্রকাশিত হয়। চাইলে তখনই সম্ভব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা।’
মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্ণবাসনের বিষয়ে কথা বলেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘ এদেশে সুইপারদেরও একটি কলোনী আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের নেই।’ মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণবাসনের কথা উঠলেই সরকারের ভেতর থেকে নানা টালবাহানা শুরু হয়। বরাদ্ধ ছাড়ে চলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। তিনি সরকারের কাছে দাবী জানিয়ে বলেন, ‘ মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক সম্মান দিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, তাদের আবাসনের ব্যবস্থাকরণ ও তাদের সম্মানজনক ভাতাও প্রদান করতে হবে।’
স্বাধীন দেশে ভাললাগা জানতে চাইলে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘খেলার সময় অন্যদেশে যখন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। আমার দেশের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন সারা বিশ্বে¦ মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়।’ কষ্টের অনুভূতি কি? প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না -এমন দেশ চাননি বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার একচল্লিশ বছরেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন আজো বাস্তবায়িত হয়নি এদেশে। এটাই কষ্ট।’
নতুন প্রজম্মের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ আমরা বীরের জাতি। নয়মাসে দেশে স্বাধীনতা এনেছি। সেই স্বাধীন দেশকে এগিয়ে নিবে তোমরাই। দুর্নীতির হাত থেকে রক্ষা করে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে।’
প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
ঘরে বসে বইটি পেতে চাইলে : click here
© 2013 – 2021, https:.