ভ্রমণকথা

তামাবিলে এক বিকেল

পাহাড়গুলোর একটি অন্যটির সঙ্গে জোড় বেঁধে আছে। হাত ধরাধরি করা যেন। কোনোটি নজরে পড়ে। কোনোটি আবার মুখ লুকিয়েছে দূর মেঘের আড়ালে। লাল মাটিতে গড়া বড় একটি টিলার ওপর উঠে যাই। অগণিত চা-গাছ আঁকড়ে আছে টিলার দেহ। ছোট ছোট চা-ফুলে গাছগুলো ছাওয়া। আমরা খুব কাছ থেকে পাহাড় দেখি। মনে হয় পাহাড়গুলো গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে।

সবুজ সবুজ পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে। এক দৌড়ে ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পাহাড়গুলো যে  বিদেশি। তাই মনের বাড় আর বাড়তে দিই না। আমাদের সীমানা থেকেই চোখ মেলে দেখি।

মাস দেড়েক আগের কথা। শীত যাই যাই করছিল। চার বন্ধু সিলেট বেড়াতে এসেছি-জায়েদ, মুন্না, মনির আর এই অধম। দুপুরবেলায় হোটেলের বিছানায় শুয়ে গড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। জায়েদের ভারী গলা। ঝটপট তৈরি হয়ে নাও। বেড়াতে এসে গড়ানো চলবে না।

হোটেলের সামনেই অপেক্ষায় ছিল কালো একটি মাইক্রোবাস। সিলটি বন্ধু সিবি্বর প্রস্তুত হয়েই ছিল। বলল,  ‘চলো না ঘুরে আসি, অজানাতে’। আমরা বলি, তথাস্তু।

গাড়ির সামনে সিবি্বর, পেছনে আমরা চারজন। ড্রাইভারের নাম মামুন। দারুণ চটপটে। সুযোগ পেলেই মুখে খই ফোটায়। খই ফোটানো বন্ধ করতে সিবি্বর অডিও সিডি অন করে। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গলায় ভেসে আসে-‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে’। গাড়ি জাফলংয়ের পথ ধরেছে। হাওরের বুক চিরে পাকা রাস্তা।  দুই পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ। বকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে দলবেঁধে। বিলের মধ্যে খেয়াজালে মাছ তুলছে জেলেরা। গরু চরাচ্ছে এক রাখাল বালক। কাজের ফাঁকে সে মোবাইলে আলাপ জমিয়েছে। মুন্না বলে, ‘বাহ! এ দেখি এ যুগের রাখাল। বাঁশির বদলে মোবাইল হাতে।’

 তামাবিল
তামাবিল

দেড় ঘণ্টা পরে আমরা সারী নদীর ওপরের ব্রিজটি পার হই। ব্রিজ পেরোলে তামাবিলের পথ। চারপাশের দৃশ্যপট পাল্টে যায় দ্রুতই। রাস্তার দুই ধারে সবুজে ঢাকা বড় বড় টিলা। এক উঁচু টিলার ওপরে গিয়ে গাড়ি থামে। আমরা হুড়মুড় করে নামি। বাম দিকে বড় একটি চা বাগান। নাম শ্রীপুর চা বাগান। কাছেই তামাবিল কয়লার টিপো।

তখনো ডান দিকে চোখ যায়নি। হঠাৎ মনিরের চিৎকার, ‘এই দিকটা দেখ।’ ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দ। মনির ছোটে টিলার ওপর। আমরাও পিছু নেই। মেঘ সরিয়ে উঁকি দেয় বিশাল এক পাহাড়। সিবি্বর জানাল, বর্ষায় এ পাহাড় থেকে ঝরনাধারা নেমে আসে।
চারপাশের দারুণ প্রকৃতি সময় ভুলিয়ে দিয়েছিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলে আমাদের হুঁশ ফেরে। তামাবিল ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়েছিল। মনে পড়লে আজও আনমনা হয়ে যাই।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালের কন্ঠে, ১ এপ্রিল ২০১৩

© 2013 – 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button