বিরুলিয়ার বটতলীতে
সময় তখন বিকেল ৩টা। পেটে টান পড়ে। পেট শান্ত করতে আবার বটতলীতে ফিরি। বটের ছায়ায় গরম গরম মোরগ পোলাও। অমৃতের মতো লাগে। খাবারের ব্যাপারে নোমান কখনোই না বলতে পারে না। টপাটপ দুই প্লেট চালান করে দেয়। খাবার শেষে বটতলী ঘুরে দেখি। ফেরার সময় শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে তাকে পাওয়া গেল বটতলীর পেছনের দিকটায়। বটের ডালে পা ঝুলিয়ে মুঠোফোনে নববধূর সঙ্গে গল্প জমিয়েছে। কখন বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই তার !
আকাশটা মুখ গোমরা করে আছে। এই বৃষ্টি নামবে! তবু আমরা নৌকা ভাসাই। ইঞ্জিনচালিত বড় নৌকা। যাত্রা শুরু হয় ভটভট শব্দে। ঢেউ কেটে এগিয়ে চলে নৌকা। শুরু হয় হৈচৈ। খানিক যেতেই চারপাশের দৃশ্য বদলে যায়। দৃশ্যগুলো ছবির মতো।
তুরাগে স্রোত তেমন নেই। তবে ভরা বর্ষায় তার রূপ খোলে। নদীর বুকে অনেক নৌকা। কোনোটি বালুভর্তি, কোনোটি সবজির, কোনোটিতে আবার মাটির তৈরি তৈজসপত্র। একটি অন্যটির পেছন পেছন চলেছে। হঠাৎ একটি ছুটে যায় পাশ দিয়ে। স্রোতের তোড়ে আমরা দুলে উঠি।
নদীর বুকে সারি সারি বৈদ্যুতিক খুঁটি। খুঁটি জড়িয়ে তারগুলো চলে গেছে দূর শহরে। দেখতে অন্য রকম লাগে। একটি খুঁটিতে একঝাঁক চিল। বসে বসে বুঝি সভা করছে। সুমন বলল, ‘আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ হাসির রোল ওঠে।
নদীর এক জায়গা বালুচর। চরের বুকে সাদা সাদা কাশফুল। বাতাসে দুলছে। দূর থেকে মনে হয় আঁকা ছবি। চরে নামার আবদার করে সবাই। কিন্তু মাঝি গা লাগায় না। অগত্যা নৌকা যেমনকে তেমনই চলতে থাকে। আমাদের আজকের গন্তব্য বিরুলিয়ার বটতলী।
এরই মধ্যে আকাশ ঝকঝকে হয়ে উঠেছে। বাতাস তাড়িয়ে দিয়েছে মেঘ। নৌকার ছইয়ে শুয়ে রাজিব গান ধরে- ‘ও নদী রে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…’।
গানের সুরে সবাই উদাস হয়। চুপচাপ নদীর দুই ধার দেখতে থাকে। এ সুযোগটিই নেয় মনির। তার ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক শব্দ। একে একে অনেকেরই ছবি তোলা হয়ে যায়।
ঘণ্টাখানেক পেরোলে আমরা দূরে কয়েকটি গাছ দেখতে পাই। কাছে গেলে স্পষ্ট হয়- তিনটি গাছের দুটি দাঁড়িয়ে, একটি প্রায় নুয়ে পড়া। গাছগুলোয় ছোট ছোট কচিপাতা। গাছের পেছন দিয়ে একটি ছোট্ট কোষা নৌকা ছুটে চলেছে। গল্পে গল্পে খেয়াপার হচ্ছে নৌকার দুই যুবক।
আমাদের দলের নবীনরা আড্ডা জমিয়েছে নৌকার একবারে গোড়ায়। হঠাৎ হৈচৈ শুরু করে। তাদের দেখাদেখি আমাদের দৃষ্টিও তখন সামনে।
নদীর মাঝে ছোট্ট একটি উঁচু জায়গা। সেখানে বন্ধুহীন ঠায় দাঁড়িয়ে একটি বটগাছ। তার কয়েকটি ডাল হেলে পড়েছে নদীর পানিতে। মোটা ডালগুলো দেখলেই বোঝা যায় গাছটির বয়স আছে। গাছের মাথায় সবুজের সমারোহ।
বটগাছের কাছে আসতেই নৌকা থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়ে সোহরাব ও অনু। সবাই গাছটির মায়ায় পড়ে যায়। গাছের ডালে গাঢাকা দিয়ে ডাকছে নাম না-জানা পাখিরা। তাদের ডাক আমাদের মনকে আরো ভারী করে দেয়। সবুজে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে অনু বলে- আহা, ভারি চমৎকার!
ঢাকার উত্তর কাফরুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন এসাকস এক নৌভ্রমণের আয়োজন করেছিল গত বর্ষায়। মিরপুর দিয়াবাড়ী ঘাট থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল নদীর পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি আর বিরুলিয়ার প্রকৃতি দর্শন। যুবক-যুবতী আর বাচ্চাকাচ্চাসহ আমরা ছিলাম ষাটজন। সবাই পুরনো বন্ধুবান্ধব হওয়ায় ছেলেবেলা ফিরে এসেছিল। একেক ব্যাচের আড্ডা জমেছিল নৌকার একেক কোণে। মশিউর ছিলেন দলের ব্যবস্থাপক। শুরুতেই গলা খুললেন, জানিয়ে দিলেন নিয়মকানুন। নৌকা ছাড়তেই নাশতা পাওয়া গেল- পরোটা, সবজি আর সিদ্ধ ডিম। জাকির আর সুমন ছিল খাওয়ানোর দায়িত্বে। ডিম নিয়ে তাদের বেদিশা অবস্থা। মেয়েরা ডিম নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলছিল। এ নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত অবস্থা। অবশেষে বটতলীতে পৌঁছে রান্নার আয়োজন শুরু হয়। নৌকা গিয়ে ভিড়ে সাদুল্যাপুর ঘাটের পাশে। এখানটায় স্রোত অনেক কম। ছেলেরা ছইয়ের ওপর চড়ে বসে। হাফপ্যান্ট পরে ঝাঁপ দেয় নদীতে। ঝাঁপাঝাঁপি চলতে থাকে।
নিটু ভাই পরিবারের সঙ্গে নৌকায়। কিছুতেই পানিতে নামবেন না তিনি। অন্যরা তাঁকে না ভিজিয়ে ছাড়বে না। পানি ছোড়াছুড়ি চলতে থাকে। অগত্যা তাঁকে নামতেই হয়। পানিতে আমরা ওয়াটার পোলো খেলি। বিবাহিত ও অবিবাহিত- দুই দলে খেলা চলে। অবিবাহিতরা চার গোলে জয়ী হয়। কিন্তু বিবাহিতরা চাতুরীর অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। রেফারি না থাকায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়।
পানি থেকে উঠে আমরা বিরুলিয়া গ্রাম দর্শনে বের হই। একদল যায় পোড়াবাড়ি দেখতে, অন্যদল গোলাপবাগান। বিরুলিয়া আমাদের মুগ্ধ করে অল্প সময়েই ।
সময় তখন বিকেল ৩টা। পেটে টান পড়ে। পেট শান্ত করতে আবার বটতলীতে ফিরি। বটের ছায়ায় গরম গরম মোরগ পোলাও। অমৃতের মতো লাগে। খাবারের ব্যাপারে নোমান কখনোই না বলতে পারে না। টপাটপ দুই প্লেট চালান করে দেয়। খাবার শেষে বটতলী ঘুরে দেখি।
ফেরার সময় শরীফকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে তাকে পাওয়া গেল বটতলীর পেছনের দিকটায়। বটের ডালে পা ঝুলিয়ে মুঠোফোনে নববধূর সঙ্গে গল্প জমিয়েছে। কখন বিকেল হয়ে গেছে খেয়ালই নেই তার!
সূর্যটা তখন ডুব দিতে চলেছে। আমরা ফিরতি পথে নৌকা ভাসাই। জোয়ারের পানিতে ছলাৎ ছল শব্দ তুলে ছুটে যায় আমাদের নৌকা। প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে নৌভ্রমণের ওই স্মৃতি আজও মনে বসে আছে। ভাবছি, এবারও যাব বিরুলিয়ার বটতলী।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক কালেরকন্ঠে, ২ জুলাই ২০১৩
© 2013 – 2019, https:.
Feeling great as I was one of the fortunates to have participated in such a great event!!!
Yes Vaiya, we are still eagerly waiting to have such trip once again with our ESAUKHS Family…..
…. and thanks for the writing Vaiya…. it really makes me nostalgic!!!
ধন্যবাদ নোমান।