মনকথা

সাফল্য মিলবে মন নিয়ন্ত্রণে

সৈয়দ হারুন
অর্থ প্রাচুর্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেই কি সাফল্য সুনিশ্চিত হয়? দারিদ্রতার মধ্যে জন্মগ্রহণ করলেই কি জীবন ব্যর্থতার যন্ত্রণায় পুড়ে যায়? মূলত কে কত বেশি বা কম শিক্ষিত তার ওপর সাফল্য নির্ভর করে না।
সমগ্র বিশ্বের এক নম্বর ধনী মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটস। অথচ শিক্ষাগত ক্ষেত্রে তিনি কলেজের গন্ডিই পেরোতে পারেননি। আবার কম্পিউটার প্রস্তুতকারী মাইকেল ডেল অন্যান্য ছাত্রদের জন্য কম্পিউটার তৈরিতে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি ইউনির্ভাসিটি অব টেক্সাস হতে বের হয়ে এসেছিলেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না এবং আলবার্ট আইনস্টাইন ও টমাস আলভা এডিসন ছাত্র হিসাবে ছিলেন অতটা ভালো ছিলেন না।

সাফল্য নিয়ে নানা চিন্তা ভর করেছিল ড. হোঁসে সিলভারের মনেও। তিনি জন্মেছিলেন আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের লারেডো শহরে।তার ছিল না তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। ৬ বছর বয়সে তাকে পরিবারের জন্য ছুটতে হয়েছে কাজে। যখন তার  বয়স চার বছর, তখন মেক্সিকান লিবারেশনে হোঁজের পিতা আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন। তার মা পুনরায় বিয়ে করে অন্য জায়গায় চলে যান। ফলে শিশুকালে বিশেষ কোনো সুবিধা পাননি তিনি।02সফলরা কীভাবে তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন ? হোঁজে সিলভা এ বিষয়ে আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকেন। মন কি করে কাজ করে ? এর কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রথমে তিনি মনোবিজ্ঞান বিষয়ক বই-পুস্তক পড়তে শুরু করেন।
শুধু তাই নয়, তিনি মন বিষয়ক নানা প্রশ্ন জানতে চেয়ে চিঠি লিখতে থাকেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে। তারা কেউ তার প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দিতে পারেন না। শুধুমাত্র বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড হোঁজে সিলভাকে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে কার্যকর কিছু উপায় বলে দেন। ফ্রয়েড সে সময় হিপনোসিস নিয়ে কাজ করছিলেন। তার পরামর্শে হোঁজে প্রথমেই হিপনোটিজম সর্ম্পকিত বইপত্র সংগ্রহ করেন এবং তার সন্তানদের উপর তা প্রয়োগ করতে থাকেন।
হিপনোসিস কি সকল সময়ে সঠিকভাবে কার্যকর থাকে ? এ বিষয়ে হোঁজে তার বড় মেয়ের ওপর পরীক্ষা চালালেন। একদিন তার বড় মেয়ে ইসাবেলাকে তিনি পড়া সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করতেই সে আশ্চর্যজনকভাবে প্রতিবারই সঠিক উত্তর দিতে থাকে।
তিনি মনে করলেন যেহেতু তারা একসঙ্গে থাকেন তাই মেয়ে হয়তো বুঝতে পারছিল পিতা কী চান। কিন্তু তিনি তাকে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করলেন যার উত্তর হোঁজের নিজেরই জানা ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইসাবেলা ওই প্রশ্নগুলোরও সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল।হোঁজে ইসাবেলাকে নিয়ে র্দীঘসময় ধরে কাজ করতেন। হিপনোসিস অবস্থায় তিনি কবিতা ও অন্যান্য বিষয় পাঠ করে শুনাতেন এবং তাকে মনের ওই অবস্থানে পৌঁছে দিতেন যেন পরবর্তীতে প্রয়োজনের সময় সে তা মনে করতে পারে। ইসাবেলা অনেক সময়ে এমন সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে দিত, যার উত্তর তাকে শিখানো হয়নি। যখন সে মনের ওই লেভেলে থাকতো, তখন যে সমস্ত তথ্য হোঁজের কাছে রক্ষিত ছিল সে তা শনাক্ত করতে পারতো। এমনকি অন্যান্য মানুষের মস্তিষ্কে যে তথ্যসমূহ রক্ষিত ছিল তাও সে ধরতে পারতো।
জীবনে সাফল্য পেতে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কাছে যদি সঠিক তথ্য থাকে, তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। হোঁজে সিলভা বলতেন, “এই পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নাই, যার সমাধান নাই । শুধুমাত্র সেই সমস্ত সমস্যার সমাধানই আমাদের জানা নাই যার সম্পর্কে আমাদের  কাছে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নাই।”
মেয়ের বিষয়টি গভীরভাবে অনুভব করে হোঁজে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তিনি তৎক্ষণাৎ ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিষ্টার জে.বি.রাইনকে লিখে জানালেন যে, তিনি তার কন্যাকে সাইকিক হিসাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
সাইকিক শক্তি বলে দুনিয়াতে সে কিছু একটা আছে, তার সত্যতা প্রতিষ্ঠায় জন্য ড.জে.বি. রাইন – অনেক বৎসর ধরে গবেষণা করছিলেন। যাকে অনেকেই “অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়” নামে অবহিত করেন। যদিও তিনি এটাকে এক্সট্রা শেনসরী প্রজেকশন বা সংক্ষেপে “ইএসপি” হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
হোঁজের চিঠির উত্তরে ড. রাইন জানান যে, কাউকে সাইকিক হিসাবে প্রশিক্ষিত করা সম্ভব নয়।এই সাইকিক সক্ষমতা শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে সামান্য কিছু মানুষের মাঝে থাকে এবং বেশির ভাগ মানুষেরই তা থাকে না। তিনি আরো লিখেন যে, হোঁজে একজন সৌভাগ্যবান পিতা, যে তার বিশেষ সাইকিক সক্ষমতা সম্পন্ন একটি  সন্তান আছে।
হোঁজে রাইনের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। কেননা যতদিন তার মেয়েকে তিনি হিপনোটিসের মাধ্যমে মনের বিভিন্ন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, ততদিন পর্যন্ত ইসাবেলার মধ্যে কোনরূপ সাইকিক ক্ষমতা তিনি দেখতে পাননি। কিন্তু পরবর্তীতে সচেতন অবস্থা সে ইচ্ছা করলেই এমন কিছু তথ্য শনাক্ত বা পেতে পারতো যার সাফল্যকে সে কখনো জানত না। হোঁজে সিলভা বলেন, “আমি মনে করি না সৃষ্টিকর্তা কিছু লোককে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যা তিনি অন্যদেরকে দেননি। আমাদের সকলেরই এক বিশেষ ক্ষমতা আছে এবং কি করে সেটি ব্যবহার করতে হবে তা আমাদের শিখতে হবে”। হোঁজে  বিশ্বাস করতেন যদি কেউ কোন কাজ করতে পারে, তবে প্রত্যেকেই সেই  কাজটি শিখে করতে পারবে। বিশেষ মানুষের পক্ষে যদি কোন কিছু করা সম্ভব হয়, তবে যে কেউই তা শিখে করতে পারে। এ নিয়ে তিনি দীর্ঘ প্রায় বাইশ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে মেডিটেশনের একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।

মেডিটেশন। যার অর্থ গভীর চিন্তা বা ধ্যান। ধ্যান শব্দটি শুনলেই সবার মনে যে ধারণাটির জন্ম নেয় তা হলো, ধ্যান সনাতন ধর্মের ঋষিরাই করেন। ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। বৌদ্ধ  ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ ধ্যান করতেন। হযরত মুসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) সহ যে সকল নবী বা রাসুলের কথা আমরা জানি তারাও ধ্যান করতেন। বাল্মিকি কিংবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ধ্যানের কথা উপমহাদেশের প্রায় সব মানুষের জানা। যে সকল পীর, দরবেশ, অলি, আওলিয়ার কথা আমরা শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করি তাঁরাও ধ্যান করতেন। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পঁচিশ বছর বয়স থেকেই ‘হেরা’ পর্বতের গুহায় ধ্যান করতেন। বোখারী শরীফে তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় তাঁর কাছে প্রথম ওহি নাজিল হয়েছিল।
ধ্যান গুরু কেন্দ্রীক বিদ্যা। একজন গুরুর কাছেই ধ্যান করতে শেখাটাই উত্তম। কিন্তু বাংলাদেশে এমন অনেক গুরু রয়েছেন যারা মেডিটেশনের নামে হিপটোনাইজ করেন। হিপনোটিজম অর্থ সম্মোহন। যিনি সম্মোহন করেন তিনি হিপনোটিস্ট এবং যার উপর এই বিদ্যা প্রয়োগ করা হয় তিনি হিপনোসিস। এটা অত্যন্ত প্রাচীন একটি বিদ্যা। একজন হিপনোটিস্ট দীর্ঘ কঠিন সাধনায় অর্জন করেন এই অলৌকিক ক্ষমতা। এই ক্ষমতা দিয়ে যেমন মানুষের কল্যাণ করা যায়, মানুষকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা যায় তেমনি বিপথগামীও করা যায়।
১৯৭০ এর দশকে আমেরিকায় একজন ভারতীয় তথাকথিত ভগবান গুরু এমন ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করেছিলেন। শিষ্যদের হিপনোটাইজ করে নির্দেশ দিয়েছিলেন একটা বড় ড্রামে রাখা তরল বিষ এক গ্লাস করে পান করতে। শিষ্যরা সম্মোহিত অবস্থায় তাই করেছিলো। একসঙ্গে মারা গিয়েছিলো প্রায় সত্তর জন নারী ও পুরুষ। এই ব্যাপক গণ আত্মহত্যায় বিচলিত হয়ে তৎকালীন আমেরিকান সরকার এ ধরণের আশ্রম গড়ে তোলা বা এর চর্চা করার উপর বিধি নিষেধ আরোপ করেছিলো।
সম্প্রতি “ডিসকভারী” চ্যানেল একটা গবেষণামূলক প্রতিবেদন প্রচার করেছে। আমেরিকা ও ব্রিটেনের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী এক দল মানুষের উপর সম্মোহনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে বেশ সময় নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তাদের বিষয়বস্তু ছিল “একজন ভাল মানুষকে প্রোগ্রাম করে খুনী বানানো সম্ভব কিনা?” এতে দেখানো হয়েছে একজন সাধারণ মানুষকে হিপনোটাইজ করে তাকে দিয়ে মানুষ খুন করানো সম্ভব। এমন কি ঘটনার পর বিষয়টি খুনীর একদমই মনে থাকবে না।

সৃষ্টিকর্তা আপনাকে দেহ ও মন নামক যে মহামূল্যবান সম্পদ দিয়েছেন সেই ভান্ডারের চাবি আপনি অন্য কারো কাছে নির্দ্বিধায় দিয়ে দেবেন না। আপনি আপনার নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছেই রাখুন। আপনার জন্য বা সকল মানুষের জন্য, সমগ্র সৃষ্টির জন্য যা মঙ্গলজনক- সেই সঠিক সিদ্ধান্তটি আপনি গ্রহণ করুন।

সৈয়দ হারুন : কান্ট্রি ডাইরেক্টর, সিলভা আল্ট্রামাইন্ড ইএসপি সিসটেম
ছবি : এমকিউ মিশন
অনুলিখন : নুরুল আমিন
silvabangladesh@yahoo.com

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে, আগস্ট ২৮, ২০১৩

© 2013 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button