আদিবাসী

আদিবাসী উৎসব ও মিথ

ভাদ্র মাস। তালপাকা গরম। এরই মধ্যে দিনাজপুর থেকে রওনা হয়েছি সীমান্তবর্তী গ্রাম ঝিনাইকুড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানে বাস করে কড়া জাতিগোষ্ঠীর মাত্র ১৬টি পরিবার। ‘কারমা পূজা’ কড়াদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম। প্রতি ভাদ্রে পূর্ণিমার চাঁদে এ পূজা পালন করে এরা। গ্রামটিতে যখন পৌঁছি তখন মধ্য বিকেল। আশপাশের গ্রামের অন্য জাতির মানুষেরাও ভিড় জমিয়েছে সেখানে।
কারমা মূলত একটি গাছের পূজা। বিরল প্রজাতির ‘খিল কদম’ গাছের ডাল কেটে এনে পূজা করে কড়ারা। আচারগত কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও ওঁরাও, সাঁওতাল, মুন্ডা, তুরি, ভুনজার ও মাহালিরাও ধুমধামের সঙ্গে এ উৎসবটি পালন করে।
এ উৎসবে গোত্রের মাহাতো (প্রধান) আগে থেকেই অবিবাহিত কোনো যুবককে ডাল কাটা ও বির্সজনের কাজে কয়েক বছরের জন্য মনোনীত করেন। ডাল কাটার দিন সে নদীতে স্নান সেরে গাছের গোড়ায় ধূপ জ্বালিয়ে, সিঁদুর দিয়ে, তিনটি তেলের পিঠা গাছের সঙ্গে বেঁধে দেয়। এরপর তিন কোপে কেটে নেয় একটি ডাল। ডালটি মাটিতে পড়ার আগেই সেটি ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া হয় পূজাস্থলে। সেখানে গোত্রের সবাই ঢাকঢোল বাজিয়ে ডালটিকে মাটিতে গেড়ে শাপলা ফুল দিয়ে সাজিয়ে নেয়। একই সঙ্গে দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়ে শুরু হয় কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা।

‘খিল কদম’ গাছ কেটে আনার আনুষ্ঠানিকতা
‘খিল কদম’ গাছ কেটে আনার আনুষ্ঠানিকতা

সারা রাতভর চলে নাচ, গান আর হাঁড়িয়া খাওয়া। ভোরবেলা দলের মাহাতো স্নান সেরে ভেজা শরীরেই প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেয় খিল কদম গাছের ডালের মাথায়। মাহাতোর পর পরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। এরপর যে যুবকটি ডাল কেটেছিল, সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে ডালটিকে কাঁধে তুলে ঢাকঢোলের তালে তালে সেটিকে বির্সজন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। কড়ারা বিশ্বাস করে এ পূজার মাধ্যমেই তাদের অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভ হয়।
এ ছাড়াও এ উৎসবের চারদিন আগ থেকে কড়াদের ধর্মের পরীক্ষা শুরু হয়। বাঁশের ডালার মধ্যে কালাই বীজ রেখে বালু ও মাটি দিয়ে যেদিন ঢেকে দেওয়া হয়, সেদিন থেকেই শুরু হয় উপাস (উপোস)। উপোস সময়ে খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। এ ছাড়া যে কয়জন উপোস থাকে, সে কয়টি ছোট কাঠি পুঁতে দেওয়া হয় ডালায় । সেখানে নতুন চারা গজালে তারা উপোস ভাঙে। উৎসবের সময় কড়ারা উপোসের ডালাটিকে রাখে খিল কদম ডালের সঙ্গেই।
কারমা উৎসবের একটি পর্বে কড়ারা এর মিথটি বয়ান করে গল্পের মতো করে। বলি পর্বের ঠিক পরেই গোত্রের মাহাতো জগেন কড়া কাহিনিটি বলেন। তাকে ঘিরে বসে নারীরা। সবার সামনে কাসার পেয়ালায় রাখা হয় প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা ও জুঁইফুল। কাহিনির মাঝে মাঝে দেবতার নাম উচ্চারণ করে তারা মুঠো মুঠো জুঁইফুল ছুড়ে দেয় কারমা ডালের দিকে। জগেনের মুখে শোনা কারমা পূজার মিথটি;
‘কারাম আর ধারাম ছিল দুই ভাই। কারাম বড়। ধারাম ছোট। পারাবেতী তাদের একমাত্র বোন । ভাদ্র মাসে একবার গ্রামের এক ধনী ব্যক্তি ঢোল পিটিয়ে তার জমিতে হাউলি’র (ধান গাড়ার) ডাক দেয়। অন্যদের সঙ্গে কারাম-ধারামও যায় সেখানে। কাজ শুরু হয় খুব ভোরে। কিছু চারা লাগানোর পরেই সকালের নাস্তা বা পানতার ডাক পড়ে। দু’ভাই তখন কলা পাতা বিছিয়ে বসে যায় লাইনে। কিন্তু তাদের কাছে এসেই তা শেষ হয়ে যায়। পানতা না পেয়ে বড়ই দুঃখ পায় তারা। নিজেকে সামলে নিয়ে দুপুরে খাবারের আশায় তারা আবার কাজে ফিরে। কিšত্ত এবারও ঘটে একই ঘটনা। তাদের কাছাকাছি এসেই খাবার শেষ! ব্যথিত হয় দুইভাই-ই। রাগে-কষ্টে তারা তাদের হাতে লাগানো রোয়া তুলে ফেলতে রওনা দিল।

কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে
কারমা পূজার আনুষ্ঠানিকতা চলছে

পথেই ছিল একটি বটগাছ। দুঃখের কারণ জানতে চাইলে- দুইভাই বটগাছকে সব খুলে বলে। সব শুনে বটগাছ বলে- ‘তোদের কারমা কপাল জেড় গেলে’ (তোদের কর্মভাগ্য পুড়ে গেছে)। সাত সমুদ্র লংকা পার হয়ে আনতে হবে কর্মভাগ্যকে।’
বটগাছের কথায় কারাম-ধারাম রওনা হয় কর্মভাগ্য ফিরিয়ে আনতে।
পথে তাদের সঙ্গে দেখা একটি কুল গাছের। কারাম-ধারাম এর কথা শুনে সেও জানায় তার দুঃখের কথা। তার ফল পেকে মাটিতে পড়ে থাকে কিন্তু কেউ সে ফল খায় না। তার ভাগ্যটিও জেনে আসতে দু’ভাইকে সে অনুরোধ করে। যেতে যেতেই কারাম-ধারাম এর দেখা হয় একটি ডুমুর গাছের সঙ্গে। তাদের লংকা পার হওয়ার কথা শুনে সে আফসোস করে বলে- ‘আমার এমন সুদৃশ্য ফল পেকে থাকে কিন্তু মানুষ ও পাখি সে দিকে ফিরেও তাকায় না।’ তাদের সে অনুরোধ করে তার ভাগ্যটিও জেনে আসার। কিছুদূর যেতেই কারাম আর ধারামের সামনে পড়ে একটি নদী । নদীর তীরে দুটি হাতি নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল। তাদের পুরো শরীর কাদায় ঢাকা। কারাম-ধারামের কথা শুনে তারা দুঃখ করে বলে, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে আর কত কাল কাঁদায় ঢাকা থাকব? তোমরা আমাদের ভাগ্যটিও জেনে এসো।
নদী পাড় হয়ে কিছুদূর যেতেই পড়ে লংকা সমুদ্র। কিন্তু বিশাল এ সমুদ্র কারাম-ধারাম কিভাবে পাড় হবে?
সমুদ্রে ছিল বড় একটি কুমির। সাতদিন আগে তার গলায় বিধেছে কাটা। যন্ত্রণায় তার ঘুম হারাম। সে কারাম-ধারামের সাহায্য চাইল। সমুদ্র পাড় করা ও নিয়ে আসার শর্তে দুইভাই কুমিরের গলার কাটা বের করে দিল। অতঃপর কুমিরের পিঠে চড়ে লংকা সমুদ্র পাড় হতেই তারা দেখা পায় তাদের কর্মভাগ্যের। সারা শরীর তার পোকায় খাচ্ছিল। কারাম-ধারাম স্পর্শ করতেই সেটি গাছ হয়ে গেল। দুইভাইয়ের মনে তখন অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হলো। তারা সেই গাছ ঘাড়ে নিয়ে আবার বাড়ির দিকে রওনা দিল।
ফেরার পথে হাতি দুটো তাদের ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, কারাম-ধারাম বলে-এমন একজন লাগবে যে তোমাদের শরীর পরিস্কার করে দিবে। হাতি দুটি মিনতি করে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। দুইভাই তখন দুই হাতির পিঠে চড়ে বসে। এরপর ডুমুর গাছ তার ভাগ্যের কথা জানতে চাইলে, তারা বলেন- তোমার গোড়ার মাটির নিচে সাত কলসি ধন আছে। সেটি সরালেই তোমার ফল সবাই খাবে। ডুমুর গাছ কারাম-ধারামকে তা তুলে নেওয়ার অনুরোধ করে। তারা তখন সাত কলস ধন হাতির পিঠে তুলে নেয়। কুল গাছের সঙ্গে দেখা হতেই কারাম-ধারাম তাকেও একই কথা বলে। সেও মাটির নিচের সাত কলস ধন তুলে নেয়ার মিনতি করে। এভাবে দুইভাই কর্মভাগ্য নিয়ে আসে ওই বটগাছটির কাছে। বটগাছ কর্মভাগ্যরূপী ওই গাছটিকে মাটিতে গেড়ে তাদের বোন পারাবেতীকে দিয়ে পূজা করার নির্দেশ দেয়। কড়াদের বিশ্বাস সে সময় থেকেই পৃথিবীতে কারমা পূজার প্রচলন হয়।
হাজং, হৃদি, ডালু, হাজং, রাজবংশী প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর কাছে সাপ প্রজনন শক্তির প্রতীক। আদিম সমাজে মানুষ বৃদ্ধির জন্যই সাপকে পূজা করা হতো। সাঁওতাল, ওঁরাও, তুরি ও ভুনজারদের কাছে সাপ হলো মনসা, বিষহরি বা জিন্দাদেবতা।
ভুনজার ও তুরিদের সবচেয়ে বড় উৎসব- মনসা পূজা। প্রতি ভাদ্রের চাঁদের পুর্ণিমাতে তারা পালন করে এটি। তাদের বিশ্বাস, মনসার শক্তিতেই তারা সাপে কাটা ব্যক্তিকে মন্ত্র দিয়ে ভালো করতে পারে। মনসা বা বিষহরি পূজা তিন দিনের। প্রথমদিন গোত্রের সবাইকে উপোস থাকতে হয়। ওই দিন সবাই একত্রিত হয়ে পূজার মাধ্যমে বিষহরিকে জানায় মনের নানা ইচ্ছার কথা। দ্বিতীয় দিন তারা দেবীর সন্তুষ্টির জন্য হাঁস বলি দেয়। সারা বছর ভুনজাররা যে কয়টি সাপে কাটা রোগীকে ভালো করে, সে কয়জনকে এ পূজার সময় এক বা একাধিক হাঁস দান করতে হয়। এরপর হাঁসগুলোকে একে একে বলি দেওয়া হয়। পরে বলি দেওয়া হাঁসগুলো দিয়ে গ্রামপ্রধানের বাড়িতে রান্না হয় খিচুড়ি। রাতভর চলে ‘ঝুমটা নাচ’ আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। তৃতীয় দিন পরম ভক্তির সঙ্গে তারা নিকটস্থ নদী বা খালে বিসর্জন দেয় বিষহরিকে।
কবে থেকে শুরু হয় মনসা পূজা ? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে দিনাজপুরে লোহাডাংগা গ্রামের তুরি গোত্রের প্রধান লবানু সিংয়ের কাছে। তার মুখে শোনা মনসার আর্বিভাবের মিথটি;
‘সওদাগর বাড়ীর ছোট বউ ছিল পোয়াতী। একবার সে স্নান করতে যায় পুকুরপাড়ে। সেখানে কতগুলো মাছ মনের আনন্দে খেলা করছিল। তা দেখে ছোট বউ গামছা ছাঁকা দিয়ে মাছগুলো ধরে ফেলে। বাড়ি ফিরে সে মাটির হাঁড়িতে মাছগুলো ঝিইয়ে রাখল। পরদিন মাছগুলোকে কাটার জন্য সে হাঁড়ি খুলে দেখল, মাছগুলো সব সাপ হয়ে গেছে। ছোট বউ তো অবাক! সাপগুলোকে সে মারল না। অবহেলাও করল না। বরং দুধ-কলা দিয়ে তাদের পুষতে থাকল।
ছোট বউয়ের আপ্যায়নে সাপেরা খুশি হলো। তারা তাদের মা-মনসার কাছে আবদার করলেন ছোট বউকে যেন তাদের দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। মনসা বাচ্চাদের কথা ফেলতে পারলেন না।
একদিন মনসা ছোট বউয়ের মাসী সেজে সওদাগরের বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে ঢুকতেই সাওদাগরের গিন্নি বললেন, ‘কে গো তুমি?’ মাসী রূপিনী মনসাদেবী বললেন, ‘বেয়ানঠাকুরুণ, আমাকে চিনবেন না, আমি আপনার ছোট বউয়ের মাসী। বোনঝিকে যত্নআতি করতে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।’
অনুমতি পেয়ে মাসী বোনঝিকে রথে চড়ালেন এবং চোখ বন্ধ রাখতে বললেন। এক সময় সে চোখ খুলে স্থির হয়ে গেল। মস্তবড় এক বাড়ি আর চমৎকার সব আসবাব। সেই বাড়িতে খেলা করছে ওই সাপগুলো, যেগুলোকে সে দুধ দিয়ে পুষেছিলেন।
কয়েকটা দিন ভালোভাবেই কেটে গেল। একদিন কোনো এক কারণে সাপেরা রেগে গেল ছোট বউয়ের ওপর। তারা তাকে কামড়াবার জন্য ধাওয়া করল। সে সময় মনসাদেবী এসে ছোট বউকে বাঁচাল। তাকে ফিরিয়ে দেয়ার সময় মনসা বলল, ‘আমি তোর মাসী নই। আমি মনসা। তুই পৃথিবীতে গিয়ে আমার পূজার কথা বলবি। শ্রাবণ মাসের পুরো সময়টা আমার মঙ্গল কাহিনি গাইবি। পূজা দিবি। তাহলে আর সাপের ভয় থাকবে না। সন্তানের জন্যও কষ্ট পেতে হবে না। কেউ কখনো বন্ধ্যা হবে না। এই ব্রত যে করবে সে পরম সুখে থাকবে।’ফিরে এসে ছোটবউ সবকথা সবাইকে খুলে বললো এবং নিজে মনসা পূজা শুরু করে দিল। মনসার আর্শীবাদে যথাসময়ে তার সুন্দর একটি পুত্র সন্তান হল। পরম সুখে দিন কাটতে থাকল তার। ক্রমে সারা দেশব্যাপী এভাবেই মনসার পূজা ও ব্রত অনুষ্ঠিত হতে থাকল।
নতুন ফসল ঘরে তোলার পূর্বে পাহাড়ি ও সমতলের বিভিন্ন জাতির মানুষরা নানা উৎসব ও পূজার আয়োজন করে থাকে। তুরি, পাহান, সাঁওতাল, মাহালি, মাহাতো, কড়া, মুসহর প্রভৃতি জাতির মানুষ একে ‘লবান’ উৎসব বলে। মূলত সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ প্রকাশই এর মূল লক্ষ্য।
লবানের দিন যে আরোয়া ধান (নতুন ধান) কাটবে ওইদিন তাকে থাকতে হয় উপোস। উপোস অবস্থায় সে মাঠ থেকে কেটে আনে এক গোছা পাকা ধান। বাড়িতে ঢোকার পূর্বেই বাড়ির নারীরা তাকে প্রণাম করে উলুধ্বনি দিয়ে তার পা ধুয়ে দেয়। অতঃপর দুর্বাঘাস, প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে তাকে বরণ করে নেয় বাড়ির ভেতরে। এদের বিশ্বাস এভাবে ফসলরূপী দেবী লক্ষ্মীই তাদের বাড়িতে আসে। অতঃপর ধান থেকে চাল করে, ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলসী দেবতাকে ভক্তি দিয়ে একটি মোরগ বলি দেওয়া হয়। পরে তা দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে উপোসকারী উপোস ভাঙে। ওইদিন এরা কিছু চাল বেটে গোটা বাড়িতে ছিটায় ও দেয়ালে আলপনা আঁকে।
লবান উৎসব ও লক্ষ্মীপূজার প্রচলন নিয়ে কড়াদের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি মিথ। দিনাজপুরে কড়া গ্রামের সেড়তির মুখে শোনা মিথটির ভাবার্থ অনেকটাই এরকম;
‘এক গ্রামে ছিল উচ্চবংশীয় দুই ভাই। বড় ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো ছোট ভাই। তার নির্দেশেই ছোট ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয় পাশের গ্রামের মেয়ের লক্ষ্মীর সঙ্গে। মেয়ের বাবা জানালেন বিয়েতে আছে একটি শর্ত। মেয়ে লক্ষ্মী প্রতি অগ্রাহয়ণে পালন করে বিশেষ এক ব্রত। বিয়ের পরও কোনভাবেই বাধাগ্রস্থ করা যাবে না ব্রতটির। শর্ত মেনেই বিয়ে হলো লক্ষ্মীর।
বিয়ের পর আসে প্রথম অগ্রাহয়ণ। লক্ষ্মীর ব্রত পালনের সময়। ওইদিন সে খুব ভোরে গ্রামের পথে হেঁটে বেড়ায়। লক্ষ্মী দেখে অধিকাংশ লোক তখনও ঘুমাচ্ছে। বাড়িঘরের দরজা জানালা বন্ধ। উঠান নোংরা ও আবর্জনাময়। গ্রামের মানুষদের এহেন অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় সে।
গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে বাস করত নিচু বংশীয় একটি পরিবার। লক্ষ্মী দেখল ঐ বাড়িটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোবরের ছিঁটা দিয়ে উঠোন লেপা। আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে বাড়ির দেয়ালে আলপনা আঁকা। পূজোর ঘরে নতুন ধানের শীষ, ফুল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে দেবতার আরাধনা করছে বাড়ির কর্ত্রী। এ দৃশ্য দেখে লক্ষ্মী মুগ্ধ হয়। বাড়িতে ঢুকে সে গৃহকর্ত্রীকে আর্শীবাদ করে।
এ খবর রটে যায় চারদিকে। নিচু বংশের বাড়িতে যাওয়ার অপারধে বড় ভাইয়ের নির্দেশে লক্ষ্মীর স্বামী গ্রহণ করে না তাকে। স্বামীর আচরণে লক্ষ্মী দুঃখ পায়। স্বামীর বাড়ি থেকে বের হয়ে সে চলে যায় দূরের কোনো গ্রামে।
এরপর দুভাইয়ের সংসারে নামে চরম অশান্তি। তারা গরিব হয়ে এক সময় ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘোরে মানুষের দ্বারে দ্বারে। একবার তারা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে যায় দূর গ্রামে, লক্ষ্মীর বাড়িতে।
বাড়ির দাসীরা দুভাইকে খেতে দেয় প্রসাদ। কিন্তু তারা বলে, ‘আমরা উচ্চ বংশীয়। তাই তোমাদের হাতের খাবার খেতে পারি না।’ তারা অনুরোধ করে রান্নার সামগ্রী দিতে। দাসীরা তাই করল। কিন্তু তাতেও দুইভাই রান্না করতে পারল না। চাল তো সিদ্ধ হয়ই না, আবার তরকারিও পুড়ে ছাই। নিরুপায় হয়ে ক্ষুধার্র্ত দুভাই তখন দাসীদের হাতের নানা পদের খাবার খেতে বসে।
ভেতর থেকে সবকিছু দেখছিল লক্ষ্মী। তারা যেই খাবার মুখে নেবে, অমনি সেখানে হাজির হয় সে। তাদের উদ্দেশ্যে লক্ষ্মী বলে, ‘আপনারা তো উচ্চবংশীয়। এসব নিচু জাতের স্ত্রীদের হাতের ছোঁয়ায় কি আপনাদের জাত থাকবে? আপনারা তো সমাজচ্যুত হবেন।
লক্ষ্মীর কথায় দুভাই লজ্জিত হয়। বুঝতে পারে সংসারে জাত বলতে কিছু নেই। বড় ভাই তখন নিজের ভুলের জন্য লক্ষ্মীর কাছের ক্ষমা চেয়ে ছোট ভাইকে নির্দেশ দেন তাকে গ্রহণ করে বাড়ি ফিরতে। এবারও লক্ষ্মী জুড়ে দেন একটি শর্ত। ‘প্রতিবছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি বৃহষ্পতিতে ঘরে ঘরে মেয়েরা লক্ষ্মীর ব্রত করবে। ব্রতের সময় তিনি বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যাবেন। জাতপাতের ভেদ ভুলে সবাই একত্রে বসে খাবে।’ দুই ভাই লক্ষ্মীর শর্ত মেনে নিল।’ এভাবেই লক্ষ্মী পূজার সুত্রপাত ঘটে।
এদেশে বসবাসরত নানা জাতিগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন উৎসবগুলো যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি এর পেছনে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসের চমৎকার সব গদ্যগুলো। যুগে যুগে যা সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে ঈদসংখ্যা, দি রিপোট২৪.কমে, ২০১৪ জুলাই ২৭ ১৪:২৪:৪৯

WARNING :
If anyone wants to share this content, please contact me. If any unauthorised use or reproduction of salekkhokon.me content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.

© 2014 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button