যখন লিখছি তখন পাহাড়ে চলছে ‘বৈসাবি’ উৎসব। চাকমারা এ উৎসবকে বিজুু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই, তংচঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু বলে। ত্রিপুরাদের বৈসুক থেকে ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাইং থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের বিজু থেকে ‘বি’ – এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয় ‘ বৈ-সা-বি’। বৈসাবি আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব। তবে এবারে সে প্রাণাৎসবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন আনন্দ।
কি সে আনন্দ? সে কথায় পরে আসছি। তার আগে জেনে নিই বৈসাবি উৎসবের সময়কালটি। কয়দিন চলে এ উৎসবটি? প্রথমে বলছি চাকমাদের কথা। এরা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে মূলবিজু, তার আগের দিনটিকে ফুলবিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে। এ তিনদিন ধরেই এরা বিজু উৎসব পালন করে থাকে। ত্রিপুরারাও একইভাবে চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে পালন করে এই উৎসবটি। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনটিকে এরা ‘হারি বুইসুক’ আর শেষ দিনটিকে বলে ‘বুইসুকমা’ আর নববর্ষের দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।
আবার মারমা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ‘তাইংখুং’ মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস। এ মাসেই উদযাপিত হয় তাদের নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। উৎসবের প্রথম দিনটিকে মরামারা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’। এর শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। উৎসবের দ্বিতীয় দিনটিকে এরা বলে ‘ সাংগ্রাইং রাইকু বা আইক্যা’। এরা মনে করে এ দিনটি সাংগ্রাইং দেবীর আগমন দিবস। আর ‘সাংগ্রাইং আপ্যাইন’ হচ্ছে উৎসবের তৃতীয় দিন। এটা দেবীর নির্গমন দিবস।
বৈসাবির সময়টাতে পাহাড়ের আদিবাসীরা জেগে ওঠে। দূর প্রবাসের আদিবাসীরাও ফিরে আসে তাদের আপনজনের কাছে। তারা প্রাণের উৎসব বৈসাবি পালন করে বিশ্বাসের নানা আচার আর আনন্দ আয়োজনের মধ্য দিয়ে।
পাহাড়ের আদিবাসীদের অনেকেই চাকুরি করে দূর-দুরান্তে, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দফতর ও সংস্থায়। বৈসাবি উৎসবটির জন্য তাদের ঐচ্ছিক ছুটি মিলে মাত্র দুই দিন। সেটি ছিল চৈত্রের শেষ দিন ও বৈশাখের প্রথম দিন। ফলে চাকুরিজীবি আদিবাসীরা প্রাণখুলে বৈসাবি আয়োজনে অংশ নিতে পারতো না। এ নিয়ে আদিবাসীদের মনে ছিল নানা ক্ষোভ, নানা কষ্ট। নানা সময়ে বৈসাবি উৎসবে সরকারিভাবে ছুটি বাড়ানোর দাবিও তোলে তারা। কিন্তু সে দাবি আলোর মুখ দেখেনি।
অতিসম্প্রতি পাহাড়ের আদিবাসীদের মনে দীর্ঘদিনের নানা দাবি আবারও পুঞ্জিভুত হতে চলেছে। ফলে অস্থির হচ্ছে পাহাড়। শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার রাজনীতি তো রয়েছেই। তার ওপর রয়েছে ভূমিকেন্দ্রিক নানা সমস্যা আর অবহেলা। শুধু পাহাড়ে বসবাসরত সেটেলার বাঙালিরাই নয়, সমতলের বহু প্রভাবশালি ব্যক্তিরাও আজ শত শত পাহাড় কিনেছে বনায়ন, হোটেল আর ইকো-ট্যুরিজমের নামে। পাহাড়ে তৈরি হচ্ছে লাভজনক ব্যবসা। ফলে ধীরে ধীরে আদিবাসীরা হারাচ্ছে তাদের ভূমির অধিকারটুকু।
ভূমির অধিকার প্রশ্নে সেটেলার বাঙালিদের সঙ্গে মিত্রতা তৈরি হচ্ছে দেশের প্রভাবশালী ব্যবসায়িদের। আবার আদিবাসীদের নিজস্ব সংগঠনগুলোর মধ্যে নানা কারণে তৈরি হচ্ছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, হত্যা ও খুনোখুনি। সে সুযোগে আদিবাসীরাই হারাচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকারটুকু। প্রশাসন ও রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি হচ্ছে সেটেলার বাঙালি ও ব্যবসায়িদের।
বেসরকারি এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের চেয়ে সেটেলার বাঙালির সংখ্যাই বেশি। ফলে ভূমিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভূমিকমিশন আইন এখনও আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিনিয়ত বাড়ছে পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব। পাহাড়ে আদিবাসী নারী ধর্ষণও এক বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। পাহাড়িদের অধিকার আদায়ের সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব, পাহাড়িদের প্রতি স্থানীয় প্রশাসনের উদাসিনতা এবং পাহাড়ে উগ্র মৌলবাদিদের আধিপত্য পাহাড়ের শান্তি বিনষ্ট করছে চরমভাবে। সব মিলিয়ে প্রশাসনের প্রতি পাহাড়ি আদিবাসীদের আস্থার জায়গাটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে পাহাড়ি আদিবাসীরা ডাক দিচ্ছে নানা কর্মসূচির।
সম্প্রতি এমন খবরগুলোই আমাদের আশাহত করে তুলেছিল। কিন্তু বৈসাবির এই সময়টাতে সরকারের একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত সবার মনে আশার আলো জাগিয়েছে। ১৩ এপ্রিল, সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠাকে সিদ্ধান্ত হয় বিভিন্ন দফতরে কর্মরত আদিবাসীরা ২৯ চৈত্র থেকে ২ বৈশাখ পর্যন্ত ৪দিন ঐচ্ছিক ছুটি ভোগ করতে পারবেন। যা বর্তমান সময় থেকেই কার্যকর হবে। এর মাধ্যমে বৈসাবির ছুটি নিয়ে আদিবাসীদের দীর্ঘ দিনের দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটল।
ছুটির সংবাদে বৈসাবি উৎসবে আদিবাসীদের আনন্দে যেন নতুন মাত্রা যোগ হলো। আমরা আশা করি, একইভাবে এ সরকার দৃষ্টি দিবে তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রতি। পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটবে পার্বত্য শান্তি চুক্তির। দ্রুতই পাস হবে ভূমি কমিশন আইনটি। পাহাড়ে কোনও গুলির শব্দ নয়, বরং পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
বৈসাবি উৎসব আসলেই গণমাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে। দলবেধে সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক আর বিভিন্ন পেশাশ্রেণির মানুষেরা ভিড় জমায় পাহাড়ে। আদিবাসী নারীদের বৈসাবির নানা আচার ও জলকেলির পানি ছোড়ার ছবি ও দৃশ্য দেখানো হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। প্রতিযোগিতা চলে কে কত ভালোভাবে তুলে আনতে পারে আদিবাসী সংস্কৃতিটাকে। কেউ কেউ আদিবাসীদের উৎসবে গিয়ে মুগ্ধ হন। আনন্দ পান। আদিবাসীদের সঙ্গে নানা আচারে অংশ নিয়ে নানা ঢংয়ে ছবি তোলেন। কিন্তু অবাক হতে হয় তখনই যখন দেখি আদিবাসীদের যৌক্তিক অধিকার আদায়ের পক্ষে, আদিবাসী নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে কিংবা নির্ভয়ে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালনের দাবির কর্মসূচিগুলোতে খুব কম সংখ্যক বাঙালিই যুক্ত রয়েছেন। তাই শুধু সরকার নয়, আদিবাসীদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাও বদলাতে হবে। মানুষ হিসেবেই তাদের পাশে থাকতে হবে।
তাই শুধু উৎসব-আনন্দেই নয়। আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে হাতে হাত রেখে। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। অধিকার ও মানবতার পক্ষে। তবেই এদেশে প্রতিষ্ঠা পাবে সব জাতির মৌলিক অধিকারগুলো।
ছবি : ডেনিম চাকমা
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউনে, প্রকাশকাল: দুপুর ০২:০২ এপ্রিল ১৫, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.
দারুণ অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ।