`হামরা বেলনিআলী পাপড় ডলি'
আশপাশে কোনো বন্দর নেই। তবু রাস্তাটির নাম বড় বন্দর রোড। রোডটি সোজা গিয়ে মিশেছে দিনাজপুরের রাজবাড়ির প্রধান ফটকে। রেলবাজারের ঠিক সামনে, ডান দিকে নেমে গেছে আরেকটি ছোট্ট পথ। গড়িয়ে পড়ার মতোই সে পথে নেমে পড়ে আমাদের মোটরসাইকেলটি। একটি খোলা মাঠের কাছে আসতেই থেমে যায় পথচলা। চালকবন্ধু পুলক জানাল, এটিই জগেন বাবুর মাঠ।
মাঠটির চারদিকে বেড়ার তৈরি ছোট ছোট খুপরিঘর। ভোর হতেই ঘরগুলো হয় জনশূন্য। পুরুষেরা জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরতে। আর নারীরা বেলনি ও পিঁড়ি নিয়ে মাঠে বসে গুটি বেলে।
কিসের গুটি? পুলক জানাল, পাঁপরের গুটি। দিনাজপুরের পাঁপরের খ্যাতি দেশময়। পাঁচ পুরুষ ধরে এখানে পাঁপরের ব্যবসা করছেন রমেশ, বীরেন, কিশোরসহ অনেকেই। প্রতি রাতে তাঁরা খেসারি আর মাষকলাইয়ের গুঁড়োর সঙ্গে কালিজিরা, লবণ আর খাওয়ার সোডা মিশিয়ে গরম জলে তৈরি করেন মণ্ড। মণ্ড লেপে মিহি করে সুতা দিয়ে কেটে তৈরি করা হয় ছোট ছোট গুটি। ভোর থেকেই গুটিগুলো চলে আসে জগেন বাবুর মাঠে। পাঁপর তৈরির জন্য গুনে গুনে গুটি বণ্টন করা হয় নারীদের মধ্যে।
মাঠের মধ্যে পুরোদমে চলছে গুটি বেলে পাঁপর তৈরির কাজ। রোদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে কাজ। একদল গুটিগুলোকে খানিকটা বেলে রোদে দিচ্ছে। একটু শুকাতেই আরেক দল তা বেলে পূর্ণ পাঁপর তৈরি করছে। এ যেন এক শিল্পকর্ম! গোটা মাঠে যেন হলুদের ফোঁটা পড়েছে।
গুটি বেলে খানিকটা ক্লান্ত অরুণা। বয়স পঞ্চাশের মতো। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। অরুণার বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে। কাজের সন্ধানে পরিবারের সবার সঙ্গে চলে আসেন দিনাজপুরে। সে ৩০ বছর আগের কথা। প্রথম প্রথম জাল বোনার কাজ করতেন। অরুণা জানালেন, তিনি গুটি বেলার কাজ করছেন ২৫ বছর ধরে। জগেন বাবুর মাঠে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ২৫০ জন নারী। তাঁদের অধিকাংশই অরুণার মতোই এসেছেন সৈয়দপুর, গাইবান্ধা আর রংপুর থেকে।
যাঁরা গুটি বেলেন, তাঁদের কী বলে? এমন প্রশ্নে অরুণা বলেন, ‘দাদা, হামরা বেলনিআলি, পাঁপর ডলি।’
গুটি বেলে পাঁপর বানাতে হয় রোদে শুকিয়ে। তাই যতক্ষণ রোদ থাকে, ততক্ষণ চলে গুটি বেলা। আকাশে মেঘ জমলেই অন্ধকার নামে বেলনিআলিদের মনে। একটানা বৃষ্টি হলে বন্ধ থাকে গুটি বেলা। বন্ধ হয় রোজগার। তাই পাঁপরই বেলনিআলিদের সুখ-দুঃখ।
প্রতিদিন কতগুলো পাঁপর ডলেন? অরুণা বলেন, ‘এমনি দিনে ৫০০টা, পূজা আর রোজায় ডলি ৮০০টা।’
কেমন কষ্ট? অরুণার উত্তর, ‘বেলতে তো কষ্ট অয়, কিন্তু টাকা পেলে ভালো লাগে।’ কত টাকা পান? খানিকটা আনমনে বলেন, ‘শতকরা ১০ টাকা।’
অরুণা জানালেন, গুটি বেলার টাকা সঠিক নিয়মেই পান তাঁরা। অরুণার ভাষায়, ‘যার ডেলি লাগে, ডেলি নেয়। সপ্তায় লাগলে সপ্তায় নেয়।’ গুটি বেলার বাড়তি আয় বেলনিআলিরা সংসারের কাজে লাগান। গুটি বেললে শরীরের কি ক্ষতি হয়?
অরুণার দীর্ঘশ্বাস, ‘বয়স যখন হবি, কোমরে ব্যথা হবি।’
অরুণার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন ভালো ঘরে। ছেলে বিষ্ণু পত্রিকার হকার। ছেলেমেয়েরা মায়ের পেশায় না এলেও কোনো আক্ষেপ নেই অরুণার। তাঁর ভাষায়, ‘মেয়েগুলা বিয়া হইয়া চলে যাচ্ছে, বউগুলা আসি বেলতেছে।’
অরুণাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আলাপ জমাই কয়েকজন বেলনিআলির সঙ্গে। ভরাট সিঁদুর দেওয়া এক নারী একের পর এক গুটি বেলে যাচ্ছেন। ক্লান্তি কাটাতে গুনগুনিয়ে গান গাইছেন মাঝেমধ্যে। আমাদের পায়ের শব্দে তাঁর গান থেমে যায়। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নাম দিয়া কাম কী?’ তার পরই মুচকি হেসে জানালেন নামটি। নাম তাঁর সরু বালা। পাঁপর বেলছেন ১৫ বছর ধরে। জগেন বাবুর মাঠে হিন্দুধর্মাবলম্বী বেলনিআলিদের সংখ্যাই বেশি। আছেন বেশ কয়েক জন মুসলমানও। সরু বালা বলেন, ‘আমাদের কোনো সমস্যা নেই, আমরা একজন আরেকজনের বিপদে আগাই।’
বাড়িতে যখন মেহমান আসে, তখন বেলনিআলিরা দাদাদের (পাঁপরের ব্যবসায়ী) কাছ থেকে চেয়ে নেন কয়েকটি পাঁপর। কেউ যখন তাঁদের সামনেই পাঁপরের প্রশংসা করেন, তখন আনন্দে তাঁদের বুক ভরে যায়। কয়েক দিন আগে রেলবাজারে ঢাকা থেকে আসা এক সাহেব দিনাজপুরের পাঁপরের সুনাম করছিলেন। পাশ থেকে শুনে অরুণার মনে অন্য রকম আনন্দ দোল খায়। অরুণার ভাষায়, ‘তখন মনে আনন্দ হচ্ছিল।’
কখনো এই কাজ ছেড়ে দেবেন কি না, জানতে চাইলে অরুণা বলেন, ‘কেন ছাড়ি দেব? এটা আমাদের ভালো, আমাদের বাড়তি কামাই।’
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মাঝেমধ্যে ধর্মঘটও ডাকেন বেলেনিআলিরা। অরুণা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়ে, আমাদের বেলনিআলির দাম বাড়ে না।’
আগে তাঁদের দেওয়া হতো শতকরা সাত টাকা। মাস তিনেক আগে সাত দিন ধর্মঘটের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ টাকায়।
কথায় কথায় হাঁকডাক বেড়ে যায় দাদাদের। মাঠের সবাই একে একে জমা দিতে থাকেন পাঁপরগুলো। দাদাদের গুটি বেলনিআলিদের হাতের স্পর্শে হয়ে যায় পাঁপর। গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সেগুলো। একেকটি পাঁপরে মিশে থাকে একেকজন বেলনিআলির সুখ আর দুঃখগুলো।
ছবি : সালেক খোকন
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোতে ১০জুন ২০১১
© 2011 – 2018, https:.
Thank you for new post.