ভ্রমণকথা

মহারাজার দীঘির পাড়ে

অমরখানা ইউনিয়নটি একেবারে সামান্তঘেঁষা। রাজার আমলের একটি গড় ঘিরে রেখেছে ইউনিয়নটিকে। সবার কাছে এটি ভিতরগড় নামে পরিচিত। গড়ের একপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে শুধুই সবুজ চা বাগান। আর অন্যপাশে গ্রামের লোকজন সকাল-সন্ধ্যায় ব্যস্ত থাকে পাথর তোলায়। সাদা, লাল, বাদামি নানা রঙের পাথর।
জমি কেটে মাটির নিচের পাথর তোলাই এ এলাকার কৃষি। ভাগ্য যার সুপ্রসন্ন হয়, তার জমিতে মিলে নানা আকারের রঙবেরঙের পাথর। আর প্রতিদিনই সে পাথর ট্রাকে করে চলে যায় সারাদেশে।
ভিতরগড় ছাড়াও দেশের শেষ প্রান্তের এ জেলাতে রয়েছে প্রাচীন আমলের আরও চারটি গড়। নাম জানতে চাইলে বন্ধু মৃদুল হর হর করে বলতে থাকে_ হোসেইন গড়, মির গড়, রাজান গড় আর দেবেন গড়। প্রাচীন আমলের পাঁচটি গড় আছে বলেই জেলার নাম হয়েছে পঞ্চগড়।
পঞ্চগড় হতে ১৪ কিলোমিটার ভেতরে অমরখানা ইউনিয়ন। দুপুরের পরে একটি মোটরসাইকেলে চেপে দুই বন্ধু রওনা হই অমরখানা ইউনিয়নের দিকে।
পঞ্চগড় হতে তেঁতুলিয়া যাওয়ার প্রধান সড়ক ধরে খানিকটা এগোতেই হাতের ডানে একটি পাকা রাস্তা চলে গেছে ভিতরগড়ের দিকে। মাইলফলক দেখে দেখে আমরাও আগাতে থাকি সে পথে।
চা বাগান, ভিতরগড় কিংবা পাথর তোলার দৃশ্য দেখা নয়। সারাদেশে অমরখানা ইউনিয়নের পরিচিতি বাড়িয়েছে প্রাচীন আমলের এক দীঘি। কয়েকশ’ বছর আগের এই দীঘিটি সবার কাছে সুপরিচিত মহারাজার দীঘি নামে। আমরাও বের হয়েছি সেই দীঘি দেখতে।
আঁকাবাঁকা রাস্তার দু’পাশে সারি সারি তরমুজ ক্ষেত। শত শত তরমুজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ক্ষেতজুড়ে। মনে হচ্ছে, হালকা সবুজের বড় বড় পাথর যেন অলস পড়ে আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পেঁৗছে যাই কাপাড়া সীমান্ত ফাঁড়ির রাস্তায়। সীমান্ত ফাঁড়ির ঠিক পাশেই ছায়াঘেরা মহারাজার দীঘি।
এ এলাকাটিতে বর্তমানে কোনো রাজবাড়ীর স্মৃতিচিহ্ন না থাকলেও ধারণা করা হয়, মহারাজার দীঘি থেকে ১৩৫ মিটার ভেতরে কোনো এক সময় রাজা পৃথুরাজ্যের রাজবাড়ী ছিল।
শুধু নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দয্যের জন্যই নয়, ইতিহাসগত দিক দিয়েও মহারাজার দীঘির বেশ খ্যাতি রয়েছে। দীঘিতে ঢোকার মুখের বড় সাইনবোর্ডের নানান তথ্য দেখে তেমনটিই জানা যায়।

মহারাজার দীঘি
মহারাজার দীঘি

‘কামরূপ বুরুঞ্জি’তে রাজা জল্পেস্বরকে বলা হয়েছে পৃথুরাজা। এ এলাকাটি ছিল তার আমলের রাজধানী। ধারণা করা হয়, কয়েকশ’ বছর আগে এই পৃথুরাজাই দীঘিটি খনন করেন ।
সাইনবোর্ডকে পেছনে ফেলে আমরা এক দৌড়ে চলে আসি দীঘির কাছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দীঘির পানে। প্রায় ৫৪ একর জমির বুকে টলমলে জলরাশি নিয়ে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে নয়নাভিরাম এই দীঘিটি।
মহারাজার দীঘিটির চারপাশে উঁচু পাড়ে ঘেরা। পাড়জুড়ে সবুজ আবরণের শত শত গাছ। গাছগুলোর কোনো কোনোটির অবয়বই বলে দেয় এরা শতবর্ষী। গাছগুলোতে নানা পাখপাখালির বাঁধভাঙ্গা কণ্ঠ। তাদের কোলাহলে থেমে থেমেই যেন দীঘি পাড়ের নীরবতা ভাঙছে।
বিকেল হতেই মহারাজার দীঘিতে নামে পানকৌড়ির ঝাঁক। মাঝে মাঝেই ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নিচ থেকে ঠোঁট দিয়ে মাছ তুলে নিচ্ছে হরেক রঙের মাছরাঙ্গা। ঝাঁকভেদে পানকৌড়ির ডুব-সাঁতার চলে থেমে থেমে। এসব মন ভোলানো দৃশ্যে আমরা আনমনা হয়ে যাই।
প্রতিদিনের মতো মহারাজার দীঘিতে গোসল করতে এসেছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী আব্বাস আলী। দীঘির পাশের প্রধান পাড়ায় তার বসবাস। গল্পের মতো করে তিনি বলতে থাকেন মহারাজার দীঘি নিয়ে অজানাসব তথ্য।
মহারাজার দীঘির পানি নাকি কখনও শুকায় না। পৃথুরাজা একবার পরিবার ও ধনরত্নসহ আক্রমণের স্বীকার হন ‘কীচক’ নামক এক নিম্নশ্রেণীর দ্বারা। নিম্নশ্রেণীর সংস্পর্শে এলে জাত-ধর্ম নাশ হয়_ সে সময় এ রকম ধর্ম বিশ্বাস চালু ছিল। ফলে পৃথুরাজা নিজের জাত ধর্ম রক্ষায় এই দীঘিতে আত্মহনন করেন। সে থেকেই দীঘিটির নাম মহারাজার দীঘি। কোনো এক সময় এ দীঘির ঘাটে এসে যা চাওয়া হতো, তাই নাকি মিলত।
রাজার আমল থেকেই প্রতি বৈশাখে দীঘির পাশেই বসে বৈশাখী মেলা। এক সময় সীমান্তের ওপারের বাঙালিদেরও সমাগম ঘটত এ মেলাতে।
দীঘির ঘাটের পাশে মাছ ধরার অনেক আধুনিক হুইল ছিপ নজরে এলো। জানা গেল, বন্ধের দিনে টিকিটের বিনিময়ে দীঘি ঘিরে চলে মাছ ধরার ধুম। শহর থেকে দল বেঁধে চলে আসে শৌখিন লোকেরা। দেড় মণ ওজনের রুই মাছও নাকি পেয়েছে অনেকে! মাছ ধরার কথা শুনে আমাদের আফসোস বেড়ে যায়।
এরই মধ্যে মহারাজার দীঘি প্রাঙ্গণে জড়ো হয়েছে বেশ কয়েকটি মাইক্রোবাস। ছেলেমেয়েদের চিৎকারে খেয়াল ফিরে পাই আমরা। তাদের প্রাণখোলা অট্টহাসিতে দীঘির পানি যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ফেরার জন্য আমরা যখন বের হই, তখন ভ্রমণপিয়াসী মানুষের পদধূলিতে মুখরিত দীঘির চারপাশ। হাসি-ঠাট্টার সঙ্গে চলছে পৃথুরাজার গুণকীর্তন। পৃথুরাজা অমর হয়ে আছে মহারাজার দীঘির মাঝে। ভ্রমণপিয়াসীদের কাছে মহারাজার দীঘি আজও ইতিহাসনন্দিত।

ছবি: সালেক খোকন

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সমকালে ৪ জুন ২০১০

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button