সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহ
সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু রাজার বাড়ি নাকি গিরিডোবা গ্রামে! এ গ্রামেই হয়েছিল পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহেরও পূর্বের ঘটনা এটি। ইতিহাসে প্রায় উপেক্ষিত পাঁড়ু রাজার সংগ্রামের কাহিনী শুনে আমরা উদীপ্ত হই। এক দুপুরে দিনাজপুর থেকে রওনা হই গিরিডোবা গ্রামের দিকে।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নে গিরিডোবা গ্রাম। গিরিডোবাসহ রানীপুকুরের আশপাশের গ্রামগুলোতে মূলত নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস। এখানে ছোট ছোট পাড়া করে দলবেধে বাস করছে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কড়া, ভুনজারসহ নানা সম্প্রদায়। তবে গিরিডোবা গ্রামটিতে পূর্ব থেকেই সাঁওতালদের আধিক্যই বেশি। গিরিডোবা গ্রামে ঢুকতেই সত্তর ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধের দেখা মেলে। প্রচন্ড শীতে জড়সড় সে। রোদের সন্ধানে রাস্তার পাশে মাটির দেয়ালে আয়েশ করে বসে আছে সে। তার চোখের চাহনি যেন অন্য কোনো কথা বলছে। নাম জানতে চাইলে আনমনা দৃষ্টিতে নাম জানায়। নাম তার রাগদা হেমব্রম। আমাদের কথার শব্দে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে রাগদার ছেলের বউ দুলালি মার্ডি। ভক্তি নিয়ে বলে ‘জোহার’ (নমস্কার)। দুলালি জানালো রাগদা নাকি জন্মান্ধ। শুনে আমরা খানিকটা স্থির হয়ে যাই। কথার ফাঁকে কথা চলে আমাদের। দুলালির আহ্বানে রাগদাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি আমরা।
চারপাশ মাটি দিয়ে ঘেরা আর ওপরে ছনে ঢাকা বেশ কয়েকটি ঘর এ বাড়িতে। কিন্ত কোনো জানালার দেখা মিলল না। সাঁওতালদের ঘরগুলো নাকি এ রকমই হয়ে থাকে। রাগদা থেকে জানা যায় সাঁওতালী ভাষায় এরা দেবতাকে ‘বোঙ্গা’ বলে। এদের বিশ্বাসে বোঙ্গার সংখ্যা অসংখ্য। এরা মনে করে দৈত্য দানব প্রেতাত্মাদের মতো দুষ্ট বোঙ্গারাও সব সময় তাদের অনিষ্ট করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। দুষ্ট বোঙ্গারা নাকি রাতেরবেলায় তাদের ঘরের ভেতর উঁকি মেরে দেখে। আর এতে অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সাবধান থাকতে হয় বোঙ্গারা যেন তাদের দিকে কোনো কুনজর দিতে না পারে। সে কারণেই সাঁওতালরা তাদের শোয়ার ঘরে কোনো জানালা রাখে না বা রাখলেও বেশ উঁচুতে রাখে।
আমরা নিবিষ্ট মনে রাগদার কথা শুনছিলাম। তার বাড়ি থেকে বের হয়ে পশ্চিমমুখো রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতে থাকি। গন্তব্য পাঁড়ু রাজার বাড়ি। আগ্রহের সঙ্গে আমাদের পথ দেখিয়ে নেয় দুলালি। কয়েকটি বাড়ি পার হয়ে একটি জায়গায় এসে আমরা থমকে দাঁড়াই। রাস্তার পাশেই উঁচু করে তৈরি করা হয়েছে চারকোণা একটি জায়গা। উপরে টিনের শেড। কিছু বোঝার আগেই দুলালি জানায়, এটি ‘জাহের’ বা ‘মাঝির থান’। আদিবাসীদের নিয়মিত পূজার স্থান। জাহের এর স্থান নির্বাচন ও সেখানে কল্পিত দেবতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত আছে প্রাচীন এক পদ্ধতি। দুলালি আপন রীতিতে বলতে থাকে পদ্ধতিটি।
যখন নতুন গ্রামে সাঁওতালরা বসবাস শুরু করে তখন ঐ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘জাহের’ বা ‘মাঝির মন্দির’। এর জায়গা নির্বাচনের জন্য চারজন ভালো লোককে মনোনীত করা হয়। তারা গ্রামের মাঝি বা মন্ডলের বাড়িতে সমবেত হয়। মাঝি তাদের পা ধোয়ার পানি দেয়। তারা কিছু পানি দিয়ে পা ধুয়ে বাকিটা মাথায় দেয়। অতঃপর চারটা কুলাতে চারজনকে কিছু চাল দেয়া হয়। ডান হাত দিয়ে তারা বসে বসে চাল ঘষতে থাকে। এ সময় মাঝি উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। মন্ত্র শুনে চারজনই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এবং তাদের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সাঁওতালী ভাষায় এ অবস্থাকে ‘রুম’ বলে। রুম অবস্থায় তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় নতুন গ্রামে কোথায় বোঙ্গা আছে ? তখন তারা বাইরে গিয়ে পাথর নুড়ি কুড়িয়ে আনে এবং মাঝি, মন্ডল ও গোসাইয়ের স্ত্রী প্রমুখের নামে পাথর নুড়িগুলো মহুয়ার গাছ বা শালগাছ বা বটগাছ কিংবা মন্ডলের বাড়ির সামনে পুঁতে ফেলে। এভাবে জাহের বা মাঝির থানের জায়গা নির্ধারণ করা হয়।একইভাবে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কে পূজারীর পদ লাভ করবে? তখন তারা যার মাথায় ঘটির পানি ঢেলে দেয় প্রথা অনুসারে সেই ‘নাইকো’ বা ‘ঠাকুর’ নিযুক্ত হয়। এভাবে নিযুক্ত ঠাকুর তখন পাথর নুড়িগুলো সাজিয়ে নতুন স্থানে গ্রাম দেবতার পূজার প্রবর্তন করেন।
গিরিডোবা গ্রামে জাহেরের পাশেই দালু সরেনের বাড়ি। গ্রামের সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ সে। পাঁড়ু রাজার কথা জানতে চাইলে প্রথমে নীরব থাকে সে। অতঃপর বলতে থাকে। দালুর স্মৃতিতে পাঁড়ু রাজা এখনো প্রায় জীবন্ত। ‘এ গ্রামের পূজার স্থান বা ‘জাহের’ এক সময় ছিল পাঁড়ু রাজার ভিটায়’ – এভাবেই তিনি শুরু করেন। কাঁপা কাঁপা গলায় নিজ ভঙ্গিতে বলতে থাকেন পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহের কাহিনী।
গ্রামের এক ক্ষুদে কৃষক ছিল পাঁড়ু। তার ছিল জমিজমা আর বিশাল পশুসম্পদ। পাঁড়ুর ছোট ভাইয়ের নাম ‘চারু’। আশপাশের সাঁওতালরা পাঁড়ুকে বেশ ভক্তি করত। সে সময় পাঁড়ুর বাড়িতেই ধুমধামের সঙ্গে চলত সাঁওতালদের নানা পূজা পার্বণের আনুষ্ঠানিকতা। আশপাশের গ্রামের সাঁওতালরা মনের আনন্দে যোগ দিত সে সব অনুষ্ঠানে। এ সব কারণে স্থানীয় সাঁওতালরা পাঁড়ুকে মানত রাজা হিসেবে। আর এভাবেই সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ু হয়ে যায় ‘পাঁড়ু রাজা’।
নাচোল বিদ্রোহের দেড় দশক পূর্বের ঘটনা এটি। নিজের জমির কর ব্রিটিশদের দেয়া নিয়ে পাঁড়ুর মধ্যে বিদ্রোহ জেগে ওঠে। সে সময় পাঁড়ু ব্রিটিশ আনুগত্য অস্বীকার করে রাজস্ব প্রদান বন্ধ করে দেয়। তার নির্দেশে আশপাশের কয়েক হাজার সাঁওতালও রাজস্ব না দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর বিদ্রোহ করতে থাকে। বিদ্রোহীদের থামাতে এগিয়ে আসে স্থানীয় দারোগা-পুলিশ। কিন্ত সাঁওতালদের দুঃসাহসিক কর্মকান্ড দেখে বাধা দেয়া তো দূরের কথা নিজেকে বাঁচাতে তারা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। ক্রমেই পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহের ঘটনাটি জেলা প্রশাসন হয়ে কলকাতার লাট সাহেবের দরবার পর্যন্ত পৌঁছায়। হুঙ্কার দিয়ে ওঠে ব্রিটিশ লাট। সৈন্য পাঠিয়ে প্রচন্ড গোলাবর্ষণে উড়িয়ে দেয় পাঁড়ু রাজার ভিটাবাড়ি। বন্দি করা হয় সাঁওতাল সর্দার পাঁড়ুসহ অন্যান্য বিদ্রোহীদের।
ইতিহাস মতো নাচোল বিদ্রোহের পূর্বে পাঁড়ু রাজার বিদ্রোহটি ছিল একটি দুর্দান্ত সাঁওতাল অভ্যুত্থান। অবশেষে পাঁড়ু রাজার কি পরিণতি হয়েছিল ইতিহাসে তা পাওয়া যায় নি। পাঁড়ুর বিদ্রোহের গল্পশেষে ইতিহাসের নির্মম সত্য জানতে আমরাও এগোতে থাকি তার ভিটার দিকে।
কয়েকটি বাড়ি পার হয়ে দুলালি দেখিয়ে দেয় মাটির দেয়ালঘেরা একটি ছিমছাম বাড়ি। কিন্ত খেয়াল করেও বাড়ির আশপাশে কোনো বোঙ্গার দেখা মিলল না। দরজার কড়া নাড়তেই যুবক বয়সী এক ছেলের দেখা। বাড়ির ভেতরে নিয়ে আমাদের সে বসতে দেয়। বাড়ির এক কোনায় গরুকে খাওয়ানোয় ব্যস্ত লক্ষ্মী মুরমু। জানা গেল লক্ষ্মী মুরমু পাঁড়ু রাজার বেঁচে থাকা একমাত্র নাতি জাগনা মার্ডির স্ত্রী। পাঁড়ু রাজার কথা জানতে চাইলে সবাই অবাক হয়। মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পাঁড়ু রাজার ছিল এক ছেলে। নাম ছিল তার ‘দুবায় মার্ডি’। আবার দুবায় মার্ডির ছিল দুটি ছেলে। তার মধ্যে যাগতু মার্ডি মারা যাওয়ায় জাগনা মার্ডিই বর্তমানে পাঁড়ু রাজার বেঁচে থাকা একমাত্র বংশধর।
গল্পের আসর জমে ওঠার আগেই বাড়িতে প্রবেশ করে জাগনা মার্ডি। বয়স আনুমানিক ৭০ বছর। পাঁড়ুর কোনো স্মৃতি চিহ্নের খোঁজ নেই তাদের কাছে। পাঁড়ুর বিদ্রোহের ইতিহাস তাদের কাছে গল্পমাত্র। সময়ের আবর্তে পাঁড়ু রাজার সংগ্রামের ইতিহাসটির মৃত্যু ঘটেছে তারই বংশধরদের কাছে।
সাঁওতাল সরদার পাঁড়ু রাজা এক সময় সাম্রাজ্যবাদ, শোষণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্ত আজ তার বংশধররাই নানা সুবিধা লাভের প্রলোভনে নিজের জাতিসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করেছে খ্রিস্টান ধর্ম। ফলে পাঁড়ুর ভিটায় আজ আর ঢাক-ঢোল-মন্দিরা বাজে না। সাঁওতালী নৃত্যের উল্লাসে হয় না কোনো পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস আর ঐতিহ্যের ‘বোঙ্গা’ পাঁড়ুর হাল আমলের বংশধরদের কাছে শুধুই কুসংস্কার।
সংগ্রামী পাঁড়ু রাজার ভিটা থেকে বের হই মলিন মুখে। একজন সংগ্রামীকে স্মরণ করে অন্যরকম কষ্ট অনুভব করি আমরা। ফেরার পথে দেখা হয় পাঁড়ুর ভাই চারুর নাতি জাকব মার্ডির সঙ্গে। সে জানাল পাঁড়ু রাজার শেষ পরিণতির কথা।
বন্দি হওয়ার পর পাঁড়ুর সকল জায়গা-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ লাট। এক সময় পাঁড়ুকে ছেড়েও দেয়া হয়। কিন্ত সংগ্রামী এই সাঁওতাল সর্দারকে মৃত্যুবরণ করতে হয় নির্মমভাবে। পূর্ব শত্রুতার কারণে স্থানীয় হাকিম সর্দার নির্জন রাস্তায় পাঁড়ুকে একা পেয়ে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। পাঁড়ু রাজার মৃত্যুর পর নিস্তব্ধ হয়ে যায় গিরিডোবাসহ আশপাশের আদিবাসী গ্রামগুলো। সময়ের স্রোতে ইতিহাসের পাতা থেকে এভাবেই ম্লান হয়ে যায় পাঁড়ুর মতো বিদ্রোহী সৈনিকের নাম।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ৬ মে ২০১০
© 2011 – 2018, https:.