অন্যরকম ঈদ রীতি
‘১৯৭৮ সাল থেকে শীমুলতলাবাসী ঈদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। প্রায় ৩৮ বছর ধরে এ এলাকার মানুষেরা পবিত্র ঈদের দিনে সকলে মিলে সকলের বাসায় ভিন্নরকম এক আক্রমণ চালায়। না, এটি টিপু সুলতানের কোনো রাজ্য দখলের আক্রমণ নয়! ঈদুল ফিতরের দিন দলবেধে খাবার আর দেখা-সাক্ষাৎ করাকেই এরা বলেন ‘আক্রমণ’। তাই শিমুলতলার ভাতৃত্ববোধের এই রীতিটি বজায় থাকুক সব সময়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।’
ছুটে চলেছেন সবাই। দুর্ঘটনা, বিড়ম্বনা ও নানা শংকাকে তুচ্ছ করে। ঈদের আনন্দকে উপভোগ করতে হবে আপনজনদের সঙ্গে। কোনও বাধাই যেন আটকাতে পারছে না কাউকে। আপন মানুষদের সঙ্গে কোলাকুলি, মায়ের হাতের রান্না, ছেলেবেলার বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেস আড্ডা আরও কত কি! এ নাহলে কি ঈদে আনন্দে মিলে? নাড়ির টানে, প্রাণের টানে সবাই তাই গ্রামে ছুটে যায় প্রিয় মানুষের কাছে।
কিন্তু ঢাকার ঈদ, সেটিও কি কম আনন্দের?
আমার শৈশব ও কৈশর কেটেছে ঢাকা মহানগরের কাফরুল এলাকায়। ঈদ আসলেই মনে পড়ে যায় এখানকার শিমুলতলা এলাকার ঈদ আয়োজনটির কথা। যান্ত্রিকতার মাঝেও ঈদ সম্মিলনের এই স্মৃতি আজও মনে দোলা দিয়ে যায়।
১৯৭৮ সাল থেকে শীমুলতলাবাসী ঈদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। প্রায় ৩৮ বছর ধরে এ এলাকার মানুষেরা পবিত্র ঈদের দিনে সকলে মিলে সকলের বাসায় ভিন্নরকম এক আক্রমণ চালায়। না, এটি টিপু সুলতানের কোনো রাজ্য দখলের আক্রমণ নয়! ঈদুল ফিতরের দিন দলবেধে খাবার আর দেখা-সাক্ষাৎ করাকেই এরা বলেন ‘আক্রমণ’।
আক্রমণের সময় হাতিয়ার হিসেবে সবার সঙ্গে থাকে টেবিল চামচ, কাঁটাচামচ, টিস্যু পেপার, টুথপিক, ঘণ্টা, বাঁশিসহ এ ধরনের জিনিসপত্র।‘আ..ক্র..ম..ণ, আ..ক্র..ম..ণ, আ..ক্র..ম..ণ, ঝাঁপিয়ে পড়ো, সব খাবার শেষ করে দাও’- ঠিক এভাবেই শিমুলতলাবাসীর আক্রমণটা চলতে থাকে। প্রতি ঈদুল ফিতরে এলাকার লোকজন ঈদের নামাজের পর কোলাকুলি সেরে দলবেধে প্রতিটি বাসায় গিয়ে কুশল বিনিময় করেন এবং এভাবে হালকা আপ্যায়নে শরিক হন। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আক্রমণ’।
ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলির পর প্রথমে এলাকার মুরুব্বিদের দল ঈমাম সাহেবসহ শুরু করেন এ আক্রমণ। এক এক করে এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যেকের বাসায় যান তারা। সব বাসাতেই গৃহিণীরা খাবারের টেবিল সাজিয়ে প্রস্তুত থাকেন এমন আক্রমণের জন্য। সবাই যার যার পছন্দ মতো আইটেম একটু একটু করে খান। প্রত্যেক বাড়ির গৃহকর্ত্রীদের চেষ্টা থাকে একটি স্পেশাল আইটেম টেবিলে রাখার।
মুরুব্বিদের এ আক্রমণ শেষ হওয়ার পর শুরু হয় দ্বিতীয় দলের আক্রমণ। এই দলটি এলাকার দ্বিতীয় ও তার পরবর্তী জেনারেশনের সম্মিলিত দল। এ দলটিতে যোগ দেন চার পাঁচ বছর বয়সী শিশু থেকে শুরু করে চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশোর্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সীরা। এদের আক্রমণেরও ভিন্নতা রয়েছে। এরা বাঁশি হাঁকিয়ে,হই-হুল্লোড় করে অধিকতর আনন্দ উল্লাসের ভেতর দিয়ে আক্রমণ করে। কখনও কখনও আবার হেঁড়ে গলায় গানও ধরেন-ডিস্কো ফকির আইসাছে, দুয়ারে দাঁড়াইয়াছে, দিবেন্নিগো আম্মাজান, যাকাত ফিতরা কী আছে..। কিংবা, এই যে দুনিয়া, কিসে রো লাগিয়া, এতো যত্নে গইড়া আছেন সাঁই..। কারও কারও মুখে থাকে নানান ধরনের বাঁশি। আক্রমণ করার সময় বাজতে থাকে পুর..র..র..র..ত, পুর..র..র..র..ত, প্যাঁ.. পুঁ..। বাসায় বাসায় গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আর সালাম করে এরা আক্রমণ চালান খাবার টেবিলে। প্রতিবছর গৃহিনীরাও উৎফুল্ল মনেই প্রস্তুত থাকেন এ আক্রমণের জন্য। তৈরি করেন খাবারের এক একটি স্পেশাল আইটেম। আক্রমণের সময় ওই খাবারগুলোই নিমিষেই সাবাড় হয়ে যায়।
শিমুলতলা এলাকায় ঈদে এমন মিলনমেলার প্রচলন শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সে সময় ঈদের নামাজ পড়েই সবাই জমায়েত হতেন মোজাম্মেল হকের বাসায়। তার উদ্যোগেই মূলত এ আয়োজন শুরু হয়েছিল। তাঁর বাসায় সবাই সেমাই-পায়েস খেয়ে এক এক করে তারা আশপাশের অন্যদের বাসায় যেতেন। তখন এলাকায় বসতিও অনেক কম ছিল। পরবর্তীকালে আরও অনেকেই এতে যোগ দেন এবং এর বিস্তৃতি ক্রমশ পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
ঈদের এইদিনে সবার সাথে দেখা হবে, কথা হবে, পুরনো স্মৃতিতে জমবে হাসি-তামাশা। তাই এই দিনটার জন্যই সবাই অপেক্ষায় থাকেন। নানা কারণে কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেও ঈদুল ফিতরের দিনটিতে সময় মতো চলে আসেন শিমুলতলা এলাকায়। এ এক অন্যরকম নাড়ির টান।
যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততায় সারা বছর অনেকের সাথেই কথা হয় না, দেখা হয় না। কিন্তু ঈদ এলেই মনের পড়ে যায় দলবেধে ‘আক্রমণ’ করার কথা। পরস্পরের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ ও সম্পর্কের ঘনত্ব বাড়াতে শিমুলতলাবাসীর এমন ঈদ আয়োজন সত্যি অনন্য। এ আনন্দ আয়োজন পরস্পরের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কমায়, বাড়ায় আন্তরিকতা ও একাত্মবোধ।
তাই শিমুলতলার ঈদ রীতি ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। ভাতৃত্ববোধের এই রীতিটি বজায় থাকুক সব সময়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ট্রিবিউন-এ, প্রকাশকাল: দুপুর ০২:৩৭ জুলাই ২১, ২০১৫
© 2015 – 2018, https:.