কড়াদের স্বপ্নযাত্রা
গ্রামের নাম হালজায়। দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম এটি। গ্রামটির পূর্বপাশে বিশাল এক শালবন। এক সময় এই বনটি ছিল হালজায় পর্যন্ত বিস্তৃত। এ শালবনে বাঘ শিকারের গল্প এখনও এখানকার বৃদ্ধজনদের মুখে মুখে। সেটিও বৃটিশ আমলেরও পূর্বের কথা। ভারতের ঝারখন্ড থেকে কাজের সন্ধানে এখানে চলে আসে নানা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক। পাড়া ভেদে বাস করতে থাকে সাঁওতাল, মুন্ডা, তুরি, ওরাও, মুসহর, কড়া, মাহালীসহ নানা ভাষাভাষি আদিবাসীরা। এরা জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসলী জমি তৈরি করে। শুরু হয় চাষাবাদ। চাষাবাদের ফাঁকে ফাঁকে আদিবাসীরা তীর ধনুক নিয়ে চলে যায় গহীন শালবনে। শিকার শেষে যা মিলে তাই সমবন্টন করে বাড়িপ্রতি। শিকার দিয়ে রান্না চলে খিচুরী। রাতভর চলে নাচ-গান আর হাড়িয়া খাওয়া। ব্রিটিশ আমলে সারাদেশে বসানো হয় রেললাইন। এই রেল লাইনের মাটি কাটার কাজ করতে করতেই সে সময়ে এদেশে চলে আসে কড়াদের পূর্বপুরুষরা। বসতি গড়ে অবসান ঘটায় নিজেদের যাযাবর জীবনের। কড়া পাড়ার বাড়িগুলো বেশ ভাঙ্গাচোরা। এনজিওদের দেয়া পাকা ল্যাট্রিন আর একটি টিউবওয়েলই এখানে আধুনিকতার একমাত্র চিহৃ। স্থানীয়দের সাথে কড়াদের ভূমি বিরোধই প্রধান। এই ভূমি বিরোধের কারণেই কড়ারা অধিকাংশই চলে গেছে ভারতে। এই পাড়ার অনেকের আপনজনেরাও থাকে সেখানে। এক সময় যাতায়াত ছিল তাদেরও। কিন্ত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া বসতেই সব থেমে যায়। এখন কড়ারা অনেকেই জানে না তাদের আপন জনেরা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। ১৯৭১ এ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত হয় কড়া সম্প্রদায়ের দুজন আদিবাসী। তাদের একজন খোপাল কড়া। অন্যজন সাতান কড়া। তারা স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের যুদ্ধে যেতে উৎসাহিত করে। কড়া ভাষায় বলতে থাকে, ‘চালা দেশ স্বাধীন কারোওয়ে, সবইন মিলকে দেশ স্বাধীন কারোওয়ে’। মুক্তিযুদ্ধের সময় থোপাল ও সাতান যুদ্ধ করে ৭ নং সেক্টরে। বাঙালিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেও স্বাধীনের পর এরা হয়ে যায় সংখ্যালঘু আদিবাসী। এখনও তার পায়নি মুক্তিযুদ্ধের কাগুজে সনদ। দিনমজুরি করে কোন রকমে টিকে আছে এই দুই আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। কড়াদের কাছে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব এসেছে বার বার। পরিবারের স্বচ্ছলতা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আর চিকিৎসা সেবাসহ নানা সুবিধা মিলবে খ্রীস্টান হলে। কিন্ত কড়ারা সে প্রস্তার ফিরিয়ে দিয়েছে বার বার। শত কষ্টের মাঝেও নিজেদের জাতধর্ম টিকিয়ে রেখেছে তারা। অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মতো দারিদ্রতা আর অবহেলা থাকলেও কড়ারা আজ জেগে উঠেছে ভিন্নভাবে। কড়াদের স্বপ্নযাত্রায় যে যুবকটি অনন্য ভূমিকা রাখছে তার নাম কৃষ্ণ কড়া। শিতা কড়া আর কোলো কড়ার আদরের সন্তান কৃষ্ণ কড়া। কৃষ্ণ একটু বড় হতেই সন্তানকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন বেড়ে যায়। ছেলে বাবার সাথে কাজে যাবে, পরিবারের আয় বাড়বে। সবাই ভালো থাকবে। কিন্ত বাবার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন করে মা কোলো কড়া কৃষ্ণকে পাঠায় স্কুলে। ছেলে শিক্ষিত হলে কড়াদের কেউ ঠকাতে পারবে না। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে আদিবাসীরা। ছেলেকে নিয়ে কোলোর স্বপ্ন ছিল তেমনটাই। রাঙ্গন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম দিনেই কৃষ্ণ যেন সাগরে পড়ে। কৃষ্ণ দেখলো তার মায়ের কড়া ভাষায় সেখানে কেউ কথা বলে না। বন্ধুরা সকলেই বাঙালি। ফলে জাত যাওয়ার ভয়ে কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে সকলেই। কৃষ্ণ কষ্ট পায়। কিন্তু মায়ের উৎসাহে সাহস হারায় না। ফলে ক্লাসে বন্ধুবিহীনভাবে একাই কাটিয়ে দেয় সে। অজানা বাংলাভাষা বুঝে পরীক্ষায় পাশ করা। সে এক দুরুহ ব্যাপার! তাই পাশ ফেলের মধ্যেই কেটে যায় ৫টি ক্লাস। হালজায় হাই স্কুলে ষষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হয় কৃষ্ণ। কয়েকজন বাঙালি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয় তখন। বন্ধুর সম্পর্ককে জাত ধর্মের উর্ধ্বে রাখে তারা। এভাবে প্রিয় বন্ধু হিনু, সুদেব আরা হান্নানের সাথে আনন্দ হাসিতে কেটে যায় কৃষ্ণর দিনগুলো। মেট্রিকে পাশ করতে না পারলেও কৃষ্ণর জীবনের কোন ছন্দ পতন ঘটেনি। মায়ের স্বপ্নেও ভাটা পড়তে দেয়নি কৃষ্ণ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজ সম্প্রদায়ের শিশুদের অক্ষরঞ্জান দেয়া শুরু করে সে। ক্রমেই মাহতোসহ গোত্রের সকলেই নানা বিষয় জানতে নির্ভরশীল হয় কৃষ্ণর ওপর। কৃষ্ণও আলো ছড়াতে থাকে কড়া পাড়াটিতে। কারো কোন রোগ হলে ঝার ফুক নয়, কৃষ্ণ নিয়ে যায় হাসপাতালে। জমি সংক্রান্ত বিরোধে থানা বা প্রশাসনের সাথে কথা বলা, সাংবাদিকদের কাছে খবর পৌছানো, শিশুদের অপুষ্টি দূর করতে সচেতনতা আর যে কোন অন্যায়ে প্রতিবাদ গড়তে কড়াদের সাহস যোগায় কৃষ্ণ। কৃষ্ণ এখন কড়া পাড়ার মধ্যমণি। নিজ পাড়ায় বাঁচার পথ নামক স্থানীয় এক এনজিও স্কুল ছাড়াও পাশের গ্রামের মানিয়ভিটা আদিবাসী স্কুলের শিশুদের পড়ায় সে। কৃষ্ণ জানালো শিক্ষার আলো আদিবাসীদের মধ্যে পৌছালেই আদিবাসীরা আর পিছিয়ে থাকবে না। কড়া পাড়ায় এখন শিশুদের সংখ্যা ষোলর মতো। এর মধ্যে সুজন কড়া আর সাপোল কড়া পড়ছে ১০ম শ্রেণিতে। ৭ম শ্রেণিতে বিজন কড়া আর ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে কাঞ্চন কড়া ছাড়াও প্রাইমারী শ্রেণীতে পড়ছে আরো ৫ জন। মূলত কৃষ্ণ কড়ার অনুকরণে ও সহযোগিতায় এখানকার আদিবাসীরা আজ শিশুদের স্কুলে পাঠাচ্ছে। ফলে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে আদিবাসী পাড়াগুলো। আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে কৃষ্ণ বেশ ওয়াকিবাহাল। আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ, আদিবাসীদের মায়ের ভাষায় সরকারিভাবে শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা হলে আদিবাসী শিশুরা আর পিছিয়ে থাকবে না। কৃষ্ণর ধারণা তেমনটাই। শিক্ষার অধিকার মানুষের স্বীকৃত একটি মৌলিক অধিকার। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৯৫৭ সালের ৫জুন ৪০তম অধিবেশনে ১০৭নং কনভেশনের অনুচ্ছেদ ২১ এ উল্লেখ রয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জাতীয় জনসমষ্টির অবশিষ্ট অংশের সাথে সমতার ভিত্তিতে সকল স্তরে শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’ অনুচ্ছেদ ২৩(১) এ উল্লেখ রয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মাতৃভাষায় পড়তে ও লিখতে শিক্ষা দান করতে হবে। কিংবা যেখানে এটা সম্ভব নয়, সেখানে তাদের সমগোত্রীয়দের মধ্যে সাধারণভাবে বহুল প্রচলিত ভাষায় শিক্ষা দান করতে হবে।’ অনুচ্ছেদ ২৩(২) এ উল্লেখ রয়েছে ‘মাতৃভাষা বা আদিবাসী ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা কিংবা দেশের একটি অফিসিয়াল ভাষায় ক্রমান্বয়ে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ এছাড়াও ‘আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ’ এর ৩০ নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যে সব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ঐ ধরণের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংষ্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সাথে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ কৃষ্ণ মনে করে নানা টালবাহানায় আদিবাসীদের শিশু শিক্ষা ব্যাহত হচ্ছে। রক্ষা করা হচ্ছে না আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে। কিন্ত তবুও থেমে থাকবে না আদিবাসীদের অগ্রযাত্রা। কোন বাঙালি শিক্ষক কোন কড়া শিশুকে আজ দুর্বল কিংবা পিছিয়ে পড়া বললে কৃষ্ণ মুখ টিপে হাসে। কারণ কৃষ্ণ জানে তার মতোই আদিবাসী শিশুরা জয় করতে পারবে অন্যভাষাকে। শিক্ষার আলোয় জ্বলে উঠবে কড়া পাড়ার আদিবাসীরা। একদিন অভাব অনটন আর অবহেলাকে জয় করে টিকিয়ে রাখবে পূর্বপুরুষদের কড়া সংষ্কৃতিকে। সে পথেই হবে কড়াদের স্বপ্নযাত্রা। লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলানিউজ২৪.কমে ১৮ মে ২০১১ |
© 2011 – 2018, https:.