সাত ভাই এক বেহিন
চারপাশে সন্ধ্যা নামছে। আকাশের আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে। আমরা তখনও কড়া পাড়ায় দাঁড়িয়ে। কোনো ভ্যান পাচ্ছিলাম না। দিনাজপুরের হালজা থেকে উপজেলায় ফেরার গণপরিবহন ঐ একটি। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী? কড়া সম্প্রদায়ের মাহাতো (গোত্রপ্রধান) জগেন আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। থেমে থেমে টুকটাক কথা বলছি তার সঙ্গে।
রাস্তার পাশেই মাটি আর ছনে ঢাকা কড়াদের একটি বাড়ি। বাড়ির ভেতর খুপরির মতো দুটি ঘর। কোনো জানালা নজরে এলো না। হঠাৎ ভেতর থেকে কড়া ভাষায় কিছু একটা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে বাবলী কড়া। বাবলী মাঝবয়সী এক যুবতী নারী। মাথায় ভরাট সিঁদুর দেয়া। চোখেমুখে তার দুশ্চিন্তার ছাপ। এই অবেলায় আমাদের দেখে খানিকটা ইতস্তত হয়। বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘দাদা জোহার’। আমরাও হাসিমুখে উত্তর দেই। তারপর আর কথা হয় না।
বাবলীও যেন কারো জন্য অপেক্ষা করছে। খানিক পায়চারি ভাব। কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে চোখেমুখে বিরক্তি নিয়ে জানাল আজ তুত পোকার জন্য তুতপাতা পারা হয়নি। তাই সে অপেক্ষা করছে স্বামী কৃষ্ণ কড়ার জন্য। দুজনই মিলে বের হবে তুঁতপাতা আনতে। তুঁত পোকা! আমাদের চোখ কপালে ওঠে। তা দেখে জগেন মুচকি হাসে। জগেন জানাল আদিবাসী কড়ারা রেশম পোকাকে বলে ‘তুঁত পোকা’। রেশম পোকাকে তুঁতপাতা খাওয়াতে হয় বলেই এমন নামকরণ। কড়া পাড়ায় একমাত্র বাবলীই নিজ বাড়িতে রেশম চাষ করে। স্থানীয় এক এনজিও থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে রেশম পোকা পালছে সে। রেশম পোকার জন্য রাস্তার দু’পাশেই লাগানো হয়েছে সারি সারি তুঁতগাছ। রেশম পোকাকে নানা স্তরের পাতা খাওয়াতে মাঝে মাঝেই চলে তুঁতগাছ ছাঁটার কাজ। আমাদের আগ্রহে বাবলী তার রেশম পোকার প্রকল্পটি দেখায়।
কড়ারাও অন্যান্য সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের মতোই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মাহাতো জগেনের ধারণা পূর্বপুরুষদের আমলে হয়ত কৃষি ছাড়া অন্য কোনো কাজের সুযোগ তেমন ছিল না। তাই আজো কড়ারা কৃষি পেশাতেই যুক্ত থাকতে বেশি পছন্দ করে। কিন্তু সময়ের গতিতে পূর্বপুরুষদের পেশাগুলোকে আদিবাসীরা আর ধরে রাখতে পারছে না। তাই পাড়ার অন্য নারীরা যখন মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকে, বাবলীর ব্যস্ততা তখন রেশম পোকাগুলোকে নিয়ে। পোকা রাখার জায়গাটি পরিষ্কার করে তুঁতপাতা খাইয়ে রেশম পোকাগুলোকে বড় করে বাবলী। পাতা খাওয়ানোর নিয়মও আছে। বাবলীর ভাষায় প্রথম সপ্তাহে ‘নারাম পাতেই’ (কচি পাতা), ২য় সপ্তাহে ‘মাঝ পাতেই’ (মাঝের পাতা), ৪র্থ সপ্তাহে ‘সাকাত পাতেই’ (শক্ত পাতা) খাওয়াতে হয়। দিনে কয়বার খাওয়াতে হয় এমন প্রশ্নে বাবলী বলে, ‘পোততেক দিন চাইরবার কেরকে খাওয়া দিয়েল লাগত। দুইবার পাতেই তরলে লাগতে, একবার বিহানে একবার বিকেলে’ অর্থাৎ প্রত্যেকদিন চারবার পাতা খাওয়াতে হয়। পাতা পারতে হয় দুইবার। একবার সকালে একবার বিকেলে। রেশম হলে বাবলী তা কেজিপ্রতি ১২০ টাকায় বিক্রি করে স্থানীয় কারিতাস এনজিওতে।
বাবলীর ঘর থেকে বেরোতেই দেখি চারপাশে আলোর ছটা। পূর্ব আকাশে উঠেছে ঝলমলে চাঁদ। রাতকে ভুলিয়ে দিচ্ছে ¯িœগ্ধ চাঁদের আলো। বন্ধু কাজিম মনে করিয়ে দেয় পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর।
আজ রাতেই হবে পূর্ণচন্দ্রগ্রহণ। পৃথিবীর ছায়া পড়বে চাঁদের ওপর। সেই ছায়া স্থায়ী হবে ১০০ মিনিট। এরকম পূর্ণচন্দ্রগ্রহণ নাকি আবার দেখা যাবে ১১ বছর পরে।
চন্দ্রগ্রহণের কোনো খবর নেই কড়াদের কাছে। তারা শুধু জানে আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় যেন অন্যরকম লাগছে কড়া পাড়াটি। স্নিগ্ধ আলোয় মাটির দেয়ালে ঘেরা কড়াগ্রামটিকে মনে হচ্ছিল কোনো কল্পগ্রাম। চারপাশ দেখছি আনমনে। এমন সময় একটি বাড়ি থেকে ভেসে আসছে এক নারী কণ্ঠ। কান পাততেই শুনি ভরাট কন্ঠে আদিবাসী ভাষায় বলছে কোনো গল্প। মাহাতোকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখি অবাক কান্ড !
বাড়ির উঠানে গোটা পাড়ার বাচ্চাদের যেন হাট লেগেছে। মাদুর বিছিয়ে তারা সুনিয়াকে ঘিরে বসেছে। সুনিয়া কড়ার বয়স সত্তরের মতো। গোটা পাড়ার বাচ্চাদের জন্য সে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসেছে। এতগুলো বাচ্চা এক জায়গায় কিন্তু তবু পিনপতন নীরবতা। শুধু মধুমাখা কণ্ঠে কথা বলছে সুনিয়া। সবার দৃষ্টি তার দিকে। কারো চোখের পলক যেন পড়ছেই না। সবাই গল্প শুনছে। যেন চোখের সামনেই ঘটছে সবকিছু। আমরাও একপাশে বসে পড়ি। আমাদের দিকে চোখ ফিরিয়ে মুচকি হেসে স্বাগত জানায় সুনিয়া। চাঁদের আলোয় কড়া পাড়ায় বসে শুনি কড়াদের লোককথাগুলো। ভাষা বোঝাতে গোত্রের মাহাতো আমাদের সাহায্য করে। মাহাতো জগেন জানাল গল্পের নাম ‘সাত ভাই এক বেহিন’। সুনিয়ার কড়া ভাষায় শোনা লোককথার গল্পটির ভাবার্থ অনেকটা এরকম :
এক পরিবারে ছিল সাত ভাই আর এক বোন। তাদের বাবা মা বেঁচে ছিল না। ছোট ভাই ছাড়া বাকি ভাইরা ছিল সংসারি। কিন্তু বাড়ির রান্নাবান্নার সব কাজ করতে হতো বোনকে। বোনটি সবচেয়ে বেশি আদর করত ছোটভাইকে। ছোটভাইও তাই। আনন্দ হাসির মধ্যেই চলছিল তাদের সংসার। একদিন ঘটল এক ঘটনা। শাকপাতা কাটতে গিয়ে কেটে গেল বোনের কানি আঙ্গুল। আঙ্গুল থেকে গলগলিয়ে রক্ত পরতে থাকে শাকপাতায়। বোনটি তা না ধুয়েই রক্তমাখা শাকপাতা রান্না করে ফেলে। সে রান্না মুখে দিতেই ভাইদের কাছে অমৃতের মতো লাগে। হঠাৎ রান্না এমন সুস্বাদু হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বোনটি কড়া ভাষায় ভাইদের বলে, ‘হামার কেনি ইংরিয়ে কাটায় গেল লে। লোহু গিয়াল লে শাগোয়া মে’। রান্না খেয়ে ভাইরা আরো লোভী হয়। গোপানে তারা পরিকল্পনা করে বোনকে হত্যা করে তার মাংস খাওয়ার। কিন্তু ছোটভাই তাতে রাজি হয় না। অন্যরা তাকেও হত্যার ভয় দেখায়। ভয়ে ছোটভাই অন্য ভাইদের কথা মতো কাজ করতে থাকে।
পরিকল্পনা মোতাবেক ভাইরা মাঠের পাশের এক জায়গায় তৈরি করে উঁচু বাঁশের মাচা। কড়া ভাষায় ‘মাছরি’। উদ্দেশ্য বোনকে বিজারের (তীর) আঘাতে হত্যা করা। তারা বাড়ি থেকে বোনকে ডেকে এনে মাচায় উঠতে বলে। বড় ভাই বলে ‘ওখানে উঠলে তুমি ফুপুর বাড়ি দেখতে পাবে’। ফুপুর বাড়ির কথা শুনেই বোন মাচায় উঠে পড়ে। এই ফাঁকে ভাইরা তৈরি হয়ে নেয় তীরধনুক নিয়ে। ভাইদের হিংস্রতা দেখে বোন হতবাক হয়। প্রিয় ভাইদের খুশির জন্য সে নিজেকে উৎসর্গ করে।
নিচ থেকে তীর ছুড়ে কোনো ভাই হত্যা করতে পারছিল না বোনকে। সবার পরে আসে ছোট ভাইয়ের পালা। সে চায় না তীর ছুড়তে। কান্না জড়ানো কণ্ঠে সে অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাষাণ ভাইরা তার তোয়াক্কা করে না। শেষে ছোটভাই চোখ বন্ধ করে ছুড়ে দেয় তীর। অমনি তীর গিয়ে বিদ্ধ হয় বোনের বুকে।
নিজ হাতে বোনের মৃত্যুতে ছোটভাই মুষড়ে পড়ে। কিন্তু বাকিরা ব্যস্ত থাকে বোনের মাংস কেটে রান্না করায়। তারা ছোটভাইকে বাড়ি পাঠায় ভাত আনতে। ছোটভাই বাড়ি গিয়ে ভাতের সঙ্গে মাছ আর কাকড়া রান্না করে নিয়ে যায় গোপনে। খেতে বসে অন্যভাইরা যখন বোনের মাংস দিয়ে খাচ্ছে সে তখন ছোট্ট একটি গর্তে রেখে দেয় প্রিয় বোনের মাংসগুলো। অন্যরা যখন বোনের হাড্ডি খায় ছোটভাই তখন শব্দ করে কাকড়া খায়। খাওয়া শেষে সে গর্তটিতে মাটিচাপা দিয়ে চলে যায়।
কয়েকদিন পর ঐ জায়গা দিয়ে যাওয়ার সময় ছোটভাই দেখলো সেই গর্ত থেকে একটি সুন্দর বাঁশগাছ হয়েছে। সে তখন সেখান থেকে একটি বাঁশ কেটে আনে ‘মুরলি’ (বাঁশি) বানানোর জন্য। মুরলি বানাতেই তাতে অন্যরকম সুর মিলে।
বাড়িতে বাঁশি আনার পর ঘটল অন্য ঘটনা। প্রতিদিন সকালে ছোটভাই যায় কাজে। ফিরে এসে দেখে কে যেন তার বাড়িঘর পরিষ্কার করে রান্না করে দিয়েছে। সে ভাবল হয়ত তার বৌদিরা এসব করেছে। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা না বলে। সে তখন চিন্তিত হয়ে পড়ে। একদিন কাজে না গিয়ে সে লুকিয়ে দেখল সবকিছু।
সে দেখল তার বাঁশি তার বোনের রূপ নিয়ে ঘরের সব কাজ সারছে। ছোটভাই খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। সে তার অন্য ভাইদের ঘটনাটি খুলে বলে। তারাও লুকিয়ে সব দেখে। একদিন ছোটভাই কাজে বের হতেই অন্যভাইরা তার ঘর থেকে বাঁশিটাকে নিয়ে বড় দিঘীতে ফেলে দেয়। একদিন পর তারা দেখল বাঁশিটি দিঘীর মধ্যে একটি সুন্দর শাপলা ফুলের রূপ নিয়েছে। বড় ভাই দিঘীতে নেমে শাপলাটি তুলে আনতে যায়। যতই সে এগোয় ততই শাপলাটি চলে আসে মাঝ দিঘীতে। ফলে শাপলা তুলে আনতে বড় ভাই ডুবে মরে দিঘীতে। এভাবে একে একে ডুবে যায় ছয় ভাই-ই। খবর পেয়ে আসে ছোট ভাই। সে দিঘীতে নামতেই শাপলাটি তার নিকটে চলে আসে। স্পর্শ করতেই সেটি তার বোন হয়ে ডাঙ্গায় উঠে আসে। এভাবে বোনকে ফিরে পেয়ে ছোটভাই মহাখুশি। ছোটভাইয়ের ভালোবাসায় প্রাণ ফিরে পায় বোনটি। আর পাপের শাস্তিতে ডুবে মরে ছয়ভাই।’
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৩ জুন ২০১১
© 2011 – 2018, https:.