লিচু বাগানে সন্ধ্যা নামে
চায়ে চুমুক দিতেই যেন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। অমৃতের মতো লাগলো চা টা। দিনাজপুর শহরের বটতলীতে পাওয়া যায় মালাইয়ের চা। সে চায়ের গল্প শুনেছি বহুবার। যতটা রটে ততটা ঘটে না। কিন্ত বটতলীর মালেকের দোকানের চায়ের রটনা আর ঘটনা সমানে সমান। সেখানে চা খেতে খেতেই বিকেলে ঘুরার প্লান করি আমরা।
দিনাজপুরের আবহওয়া সব সময়েই চরমে থাকে। তার ওপর জৈষ্ঠ মাসের শুরু। কাঠাল পাকা গরম চারপাশে। গত বছর এমন সময়েই দলবেধে বেড়াতে আসি দিনাজপুরে।
কান্তনগর মন্দির, রাজবাড়ি, রামসাগর আর নয়াভিরাম শালবন ঘুরে ঐতিহাসিকতার পরশ নিয়ে মেতে থাকি আনন্দে। ভ্রমণের ফাঁকে মাঝে মাঝেই পেট বাবাজি হয়ে ওঠে অশান্ত। সে সময় যদি মেলে স্বাদের রান্না। তাহলে তো কথাই নেই। রুস্তমের গরু ভুনা, মুন্সির খাসি আর ভাবীর হোটেলের টাকিভর্তার স্বাদ পেয়ে আমাদের আনন্দ যেন আরো বেড়ে যায়। কাটারি চালের রান্না খেয়ে ঢেকুর তুলি। আর পান খেয়ে ঠোট লাল করার ফুর্তিতে কাটিয়ে দেই দিন দুয়েক।
দিনাজপুরের লিচুর খ্যাতি দেশময়। তাই জৈষ্ঠ মাসে এসে লিচু বাগান দেখব না। তা কি হয়! মৃদুল গো ধরে। কেউ কেউ মৃদুলের কথায় বিরক্ত হয়। কিন্ত আমরা কয়েকজন সায় দেই।
চাপাইনবাবগঞ্জের আমের মতোই বিখ্যাত দিনাজপুরের মাধববাটির লিচু। দুপুরের পর দুটি রিক্সায় শহর থেকে আমরা রওনা হই মাধববাটির দিকে।
দিনাজপুর থেকে মাধববাটি ১৫ কিলো ভেতরে। সবুজ ছাওনি আর মৃদু বাতাসের পরশ নিয়ে আমরা এগিয়ে চলি। বিরল বাজার থেকে ডানে পাকা রাস্তায় খানিকটা এগোতেই আমাদের রিক্সা নেমে পড়ে মেঠোপথে।
ধানের খড় ঢেকে রেখেছে রাস্তাটিকে। ধান শুকাতেই ব্যস্ত চারপাশের কৃষকরা। বছরের ধান উঠবে ঘরে। তাই আনন্দ সবার চোখেমুখে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একচিলতে হাসি খেলে যায় দুএকজনের মুখে। লিচু বাগান কোন দিকে? প্রশ্ন করতেই তারা দেখিয়ে দেয় মাঠের ওপাশের বাগানগুলোকে।
আমরা লিচু বাগানের কাছাকাছি যেতে থাকি। দূর থেকে মনে হচ্ছিল গাছগুলোতে যেন সিদুর ফোটা পড়েছে। একটি বাগানের কাছে আসতেই চোখ ছানাভরা। আমরা একেবারে থ হয়ে যাই। টকটকে লাল লিচুর ভারে নুয়ে পড়েছে বাগানের গাছগুলো। মৃদুলের কন্ঠে শুধুই ওয়াও, অদ্ভুত শব্দগুলো।
মাধববাটির এই বাগানটি স্থানীয় চৌধুরীদের। তাই সবার কাছে এটি চৌধুরী বাগান। সবুজ পাতার ধার বেয়ে ঝুলে আছে লাল লিচুগুলো। দেখতে একেবারে অন্যরকম।
লিচু বাগানে দেখি ছোট্ট একটি মাচাঘর। সেখানে আয়েস করে ঘুমাচ্ছে দুজন প্রহরী। আমাদের পায়ের শব্দে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। মাচাঘরের ছায়ায় বসে তাদের সাথে আমরা গল্প জমাই।
লিচু বাগানের প্রহরী ইয়াকুব। বাড়ি নোয়াখালি। লিচুর সময়ে প্রতিবছরই কাজের জন্য চলে আসে এ অঞ্চলে। লিচুতে স্প্রে করা, বাদুর তাড়ানো, চোর পাহারা আর লিচু ভেঙ্গে ডালা তৈরিই তার কাজ। কথায় কথায় হঠাৎ সে মাচায় বাধা একটি দড়ি দরে দেয় টান। অমনি ফট্ ফট্ শব্দ। চোখের সামনেই একটা গাছ থেকে উড়ে পালায় তিনচারটে বাদুর। টিনের পাতের সাথে দড়ি বেধে তৈরি করা এই যন্ত্রটি ইয়াকুবের ভাষায় ফটফটিয়া। পালা করে আমরাও টেনে ধরি ফটফটিয়ার দড়ি।
মাধববাটিতে লিচু বাগান বিক্রি চলে কয়েক পর্বে। মূল বাগানের মালিক ফুল ও মুকুল অবস্থায় বিক্রি করে বাগানটি। যারা কেনে তারা তিন থেকে চার মাস পরিচর্যা করে। ফলে পাক ধরলে এরা বাগান বিক্রি করে ঢাকার পার্টির কাছে। তারা আবার দশ থেকে বিশ দিনের মধ্যে লিচু ভেঙ্গে নিয়ে যায় ঢাকায়। কেউ কেউ আবার স্থানীয় পাইকারের কাছেই বিক্রি করে দেয় সব লিচু।
কথা শুনছি। এমন সময় অন্য একটি মাচাঘর থেকে ভেসে আসে গানের সুর। ইয়াকুব জানালো লিচু বাগানে তাদের কাটাতে হয় চার থেকে পাঁচ মাস। এ সময় এরা পরিবার পরিজনদের স্মৃতি ভোলে ছেড়ে গলায় গান গেয়ে।
ইয়াকুবের সাথে আমরা লিচু বাগান ঘুরে দেখি। ঘুরে ঘুরে চিনে ফেলি মাদরাজী আর বেদেনা জাতের লিচুগুলো।
বাগানের এককোনে বেশ কয়েকটি গাছে দেখলাম বড় বড় সব লিচু। সে গুলোর দিকে তাকিয়ে খানিকটা গোলকধাঁধাঁয় পড়ি। এগুলো লিচু নাকি স্ট্রবেরি! ইয়াকুব জানালো চায়না থ্রি আর বোম্বাই জাতের লিচু সেগুলো। এই লিচুগুলো সাধারণ বাজারে খুব একটা দেখা যায় না। বাগান থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় চলে যায় রাজধানীর অবস্থাশালীদের বাড়িতে। কোন কোন সময়ে একটি লিচুর দাম নাকি ৮ থেকে ১২ টাকা হয়। ইয়াকুবের কথায় আমাদের চোখ কপালে ওঠে। অনুমতি নিয়েই চায়না থ্রি জাতের দুএকটি লিচু চালান করে দেই মুখে। পাশ থেকে মৃদুল বলে আহ্ কি অপূর্ব!
দিনাজপুরের স্থানীয়দের পছন্দের লিচু মাদরাজী। এটি বেশ সুস্বাদু আর রসালো। একটি গাছ থেকে আমরাও চেখে দেখি দুএকটা।
খালি হাতে হোটেলে ফিরবো। তা কি হয়। অন্যদের তো আফসোস তোলা চাই। আমরা শপাচেক মানরাজী লিচু কিনতে আগ্রহী হই। দর ঠিক হয় দেড় হাজার টাকায় হাজার। একটি গাছ দেখিয়ে দিতেই শুরু হয় লিচু ভাঙ্গা। কি যে ভালো লাগা সে দৃশ্য। গাছে উঠে ছোট ছোট ডাল ভেঙ্গে নিচে ফেলছে একজন। অন্যরা বাঁশের ঝুড়িতে পাতা দিয়ে বেছে বেছে সাজিয়ে রাখছে লিচু। এ যেন এক অন্যরকম শিল্পকর্ম। মৃদুলসহ আমরাও লিচু পারি আনন্দ নিয়ে।
লিচু বাগানে লিচু ভাঙ্গা হয় সকাল-বিকাল। এ সময় বাগান এলাকার মানুষেরা ব্যস্ত থাকে নানা পেশায়। কেউ বাঁশের ঝুড়ি বানায়। কেউ দোকড়া (চট) আনে। কেউবা বাগানে বাগানে ঘুরে লিচুর ডালা সাজায়।
সন্ধ্যার আগেই আমরা ফিরতি পথ ধরি। চারপাশের বাগানে তখন লিচু ভাঙ্গা চলছে। আশপাশের মানুষেরা ব্যস্ত লিচুর ডালা সাজাতে। ফিরছি আর ভাবছি নানা কিছু। মাধববাটি সত্যিকারের লিচুগ্রাম।
ব্যস্ত শহরের রাস্তায় কোন ফলের দোকানের লিচুর দিকে চোখ পড়লে আজও আনমনা হয়ে যাই। মনে পড়ে লিচুগ্রামের সেই স্মৃতির কথা।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে কালেরকন্ঠে ২২ মে ২০১১
© 2011 – 2018, https:.
The missing point from your post, I think, is that Pittsburgh doesn’t just take away the run, they also take away the long ball. Brady and Brees carved up Pittsburgh by taking the short completions over and over and over again.
আহ পাকা পাকা ডাশা লিচু! লোভ ধরিয়ে দিলেন খোকন ভাই! 🙂
thanks to visit tarik.