আদিবাসী

ভাষার দেশে বিপন্ন আদিবাসীদের মাতৃভাষা

সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এদেশে মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী শিশু স্কুলে যাচ্ছে। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ঝরে পড়ে মাতৃভাষার কারণে। তাই প্রয়োজন অতিদ্রুত আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ।

লেখার শুরুতেই দৃষ্টি রাখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের একুশে পদক অনুষ্ঠানের বক্তব্যটির প্রতি। প্রতিনিয়ত মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি চেতনায় মাতৃভাষা ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘মাতৃভাষা হারিয়ে যাচ্ছে জীবনের প্রয়োজনে। মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে সবার সঙ্গে কথা বলতে অন্য ভাষা বেছে নিচ্ছে। কিন্তু মাতৃভাষা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের যেমন অন্য ভাষায় শিক্ষা নিতে হবে. তেমনি নিজেদের মাতৃভাষাতেও চর্চা করতে হবে। কারণ নিজেদের মাতৃভাষা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা হয় না।’’

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি যারা তৈরি করেছেন, আমার বিশ্বাস, তারা এদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেন না। কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবেই আদিবাসীদের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার কারণগুলো এড়িয়ে গিয়েছেন। শুধু জীবনের প্রয়োজনেই নয়, ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া এই দেশে আদিবাসীদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষায় শিক্ষার সরকারি উদ্যোগের অভাব আর বাংলা ভাষার জাঁতাকলে। ফলে ভাষার দেশেই আজ বিপন্ন আদিবাসীদের মাতৃভাষা। এ যেন প্রদীপের নিচের কালো অন্ধকার।

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের শেষাংশেই বলেছেন মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে। বলেছেন, মাতৃভাষা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা হয় না। কিন্তু এদেশেই যে হাজার হাজার আদিবাসী শিশু ওই প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত– সে খবর কি পৌঁছায়নি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষা নিয়ে বাস্তবে কী ঘটছে?

সরকার প্রথম দফায় পাঁচটি মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আদিবাসী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে। এর জন্য প্রথমে জাতীয় পর্যায়ে মাল্টিলিঙ্গুয়াল এডুকেশন কার্যক্রম বাস্তবায়নে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়। পরিকল্পনা নেওয়া হয় প্রথম দফায় পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার। দ্বিতীয় পর্যায়ে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় পর্যায়ে কোচ, ওরাওঁ (কুড়ুক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্যান্য ভাষাতেও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের ৫টি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতেই আদিবাসী প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে ২০১৬ সালে এসেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আদিবাসী শিশুরা মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভাষায় শুধুমাত্র মাতৃভাষায় পড়তে না পাড়ায় আদিবাসী শিশুরা প্রকৃত শিক্ষা লাভ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে নানামুখী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেও আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাকার্যক্রমের ক্ষেত্রে কেন তহবিলের অপর্যাপ্ততা আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে? একই দেশে বাঙালি শিশুরা পড়াশোনা করছে তার চিরচেনা মায়ের ভাষায়। আর আদিবাসী শিশুদের মনে আগ্রাসী হিসেবে চেপে বসেছে বাংলা ভাষাটি। ফলে শিশু বয়স থেকেই এক রকম বৈষম্যের মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে আদিবাসী শিশুরা। এভাবে ধীরে ধীরে আদিবাসী মাতৃভাষাগুলো আজ বিপন্ন হচ্ছে নিঃশব্দে।

এবার চোখ রাখা যাক আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগগুলোর দিকে। সমতল ও পাহাড়ে আর্ন্তজাতিক ডোনারদের আর্থিক সহযোগিতায় স্থানীয় এনজিও বা সংস্থার মাধ্যমে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের যে উদ্যোগগুলো চলমান ছিল তার অধিকাংশই এখন আর্থিক সংকটে চলছে ঢিমেতালে। তাছাড়া তাদের মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

২০১৪ সালে এক বেসরকারি গবেষণার রিপোর্টে দেখা যায়, বেসরকারি উদ্যোগে আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষাকার্যক্রমে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে শতকরা ৫১ ভাগ শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে ও ৪২ ভাগ এসএসসি পাস এবং স্নাতকোত্তর শিক্ষকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ জন। ফলে ভালো শিক্ষকের অভাবে আদিবাসী শিশুরা প্রকৃতপক্ষে ভালো রেজাল্ট করা থেকেও পিছিয়ে আছে।

আবার দেখা যাক আদিবাসী মাতৃভাষাগুলো কীভাবে বিপন্ন হচ্ছে? বছর দুয়েক আগে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি জরিপের ফলাফলে উঠে আসে সে চিত্র। সেখানে বলা হয় দেশের সব আদিবাসী মাতৃভাষাই আজ বিপন্ন। আন্তর্জাতিক সংগঠন সামার ইনস্টিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকের বাংলাদেশ শাখা প্রায় ৩০টি আদিবাসী ভাষার ওপর এই জরিপ চালায়। জরিপ চলে ‘ফিশম্যান মানদণ্ড’ মোতাবেক। একটি ভাষার অবস্থা কী, সেটি বোঝাতে এই মানদণ্ডের রয়েছে ৮টি স্তর। কোনো ভাষা চতুর্থ স্তরের পরের স্তরে চলে গেলেই ওই ভাষা বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ওই মানদণ্ডের প্রথম স্তরের বিবেচনার বিষয় ছিল, ভাষাটি উর্ধ্বতন সরকারি পর্যায়ে ব্যবহৃত হয় কি না। বিপন্নতার শুরু যে পঞ্চম স্তরে, সেখানে বিচার্য বিষয় হল, ভাষাটির মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি এবং ওই ভাষায় সাহিত্য রয়েছে কি না। মানদণ্ড মোতাবেক প্রায় সব আদিবাসী মাতৃভাষাগুলোই আছে বিপন্নের স্তরে।

জরিপে দেখা গেছে, নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা ছাড়া শিক্ষা বা কোনো কাজেই নিজ ভাষা ব্যবহার করতে পারে না আদিবাসীরা। এসব ভাষায় বাংলা ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে প্রবলভাবে। বয়সে প্রবীণ আদিবাসীরা নিজ ভাষায় কথা বলতে পারলেও নতুন প্রজন্ম তাদের ভাষাটির কোনো ব্যবহারই জানে না। দেশের সবচেয়ে বড় আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী চাকমাদের ভাষায় সাহিত্য আছে। কিন্তু ওই সাহিত্য খুব কম লোকের কাছেই পৌঁছায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী চাকমাদের পঞ্চাশ ভাগ বলেছেন, তারা নিজ ভাষার নানা উপকরণ পড়েছেন, কিন্তু সেগুলো তাদের কঠিন মনে হয়েছে। দুই-তৃতীয়াংশ বলেছেন, কেবল প্রার্থনার সময় তারা মাতৃভাষা ব্যবহার করেন।

জরিপে দেখা গেছে, আদিবাসীরা প্রয়োজনীয়তার চাপে পড়ে নিজ মাতৃভাষা থেকে এখন বাংলাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এটি অধিক পরিমাণ লক্ষ্য করা গেছে সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে। সাঁওতালদের ৪৯ শতাংশই মনে করে, নিজ মাতৃভাষার চেয়ে আজ বাংলাই বেশি প্রয়োজনীয়। উত্তরবঙ্গের কোদা ও কোল জাতির কেউই এখন আর নিজ ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। একই অবস্থা টাঙ্গাইলের কোচ ও দিনাজপুরের কড়া, ভুনজার, মুসহর আদিবাসীদের।

কিন্তু কীভাবে সুরক্ষা করা যায় আদিবাসী মাতৃভাষাগুলো। গবেষকরা বলছেন, অন্তত দুটি কাজ শুরু করতে হবে অবিলম্বে। একটি হল, প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীদের শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে তাদের মাতৃভাষা। দ্বিতীয়ত প্রতিটি ভাষার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। দুঃখের বিষয়, এর কোনো উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

২০০১ সালে বিশ্বের সব জাতির পক্ষে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের উপস্থিতিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ ইনস্টিটিউটের মূল লক্ষ্য, পৃথিবীর বিকাশমান ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় গবেষণা করা। দেশ ও বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০’ প্রণীত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নৃ-ভাষার যে বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা জরিপ শুরু করেছে তা এখনও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে এদেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে, তাদের ভাষার সংখ্যা কত, এসব ভাষার অবস্থাই-বা কেমন তা নিয়ে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য এখনও আমরা পাইনি।

সরকার সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ এদেশে মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আদিবাসী শিশু স্কুলে যাচ্ছে। যাদের মধ্যে বড় একটি অংশ ঝরে পড়ে মাতৃভাষার কারণে। তাই প্রয়োজন অতিদ্রুত আদিবাসীদের ভাষাগুলোকে রক্ষার পাশাপাশি আদিবাসী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, আদিবাসী এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, আদিবাসী এলাকার স্কুলগুলোতে বাধ্যতামূলভাবে আদিবাসী শিক্ষক নিয়োগ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মতো আমরাও চাই, আদিবাসী শিশুরাও প্রকৃত শিক্ষা লাভ করুক। পড়ুক তাদের মায়ের ভাষায়। রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলা টিকিয়ে রাখার গৌরবময় ইতিহাসের চেতনাই শুধু নয়, এদেশে সমানভাবে বেঁচে থাকুক আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো। আর এর জন্য সত্যিকারভাবেই এগিয়ে আসতে হবে সরকারকেই।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button