কেমন আছে আদিবাসীরা?
সুখদেব পাহানের বয়স তখন ছয়। বাবার ইচ্ছে, ছেলে তার সঙ্গে কাজে যাবে, সংসারে আসবে বাড়তি আয়। কিন্তু ছেলেকে নিয়ে মা ভারতী পাহানের স্বপ্নটা ভিন্ন; বই হাতে ছেলে যাবে স্কুলে, শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে। তখন কেউ আর তাকে ঠকাতে পারবে না। সমাজে পাহানদের সম্মান বাড়বে। আর শিক্ষার আলো ছড়াবে সুখদেব।
দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম গোদাবাড়ী। সুখদেবরা ছাড়াও এ গ্রামে বাস করেন পঁচিশটি মুণ্ডা পাহান পরিবার। এরা কথা বলেন ‘সাদরি’ভাষায়। এ ভাষাতেই মায়ের ঘুমপাড়ানি গান আর বাবার বকুনি খেয়ে বেড়ে উঠেছে সুখদেব। রাত-দিন মায়ের মুখের কথা আর উৎসব-আনন্দে আদিবাসী গানের সুরের মাঝেই সে খুঁজে পায় তার মাতৃভাষা।
মায়ের ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। সুখদেবকে স্কুলে পাঠাতে সম্মতি দেন বাবা খোসকা পাহান। বুকভরা আশা নিয়ে ছেলেকে ভর্তি করান স্থানীয় কালিয়াগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সুখদেব হেসে খেলে বড় হচ্ছিল যে ভাষার আলিঙ্গনে, মায়ের সে ভাষা খুঁজে পায় না বিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্র বা শিক্ষক কেউ কথা বলে না তার প্রিয় ‘সাদরি’ভাষায়। চারপাশের সকলেই বাংলা ভাষাভাষী। বাংলা তার কাছে অপরিচিত, অন্য জাতির ভাষা। তাই প্রথম দিনেই দুরন্ত সুখদেবের শিশুমনে ছন্দপতন ঘটে। তার সব আনন্দ, হাসি উবে গিয়ে মনের ভেতর জায়গা করে নেয় অজানা আতঙ্ক। শিক্ষালাভ করতে এসে শিশু বয়সেই বাংলা ভাষা তার ওপর আরোপিত হয়।
একে তো ভাষার ভীতি, তার ওপর ক্লাসের বন্ধুদের আচরণে সুখদেব একেবারেই মুষড়ে পড়ে। আদিবাসী বলে তাকে বসতে হয় আলাদা এক বেঞ্চে। কেউ তার বন্ধু হতে চায় না। সবাই তাকে আড়চোখে দেখে। ফলে স্কুলে তার ভাব বিনিময়ের পথও হয় রুদ্ধ।
ক্রমেই স্কুলে যাওয়া তার কাছে রীতিমতো ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করে সে। বিদ্যালয়ের দুর্বল ছাত্রদের তালিকায় নাম ওঠে সুখদেবের। কেউ জানতেও পারে না তার পিছিয়ে পড়ার কারণ। কিছুদিনের মধ্যেই সে হারিয়ে ফেলে স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ। পড়াশুনায় ইতি। অতঃপর বাবার হাত ধরে শুরু হয় কাজে যাওয়া।
উপরের ঘটনাটি কোনো গল্প নয়। বরং নিজের অভিজ্ঞতায় দেখা এক আদিবাসী শিশুর শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার চিত্র মাত্র। শুধু শিক্ষা নয়, ক্রমেই এদেশে বসবাসরত আদিবাসীরা তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশ্ব আদিবাসী দিবস আজ । ১৯৯৩ সালকে জাতিসংঘ ঘোষণা করে আদিবাসীবর্ষ হিসেবে। অধিকার বঞ্চিত আদিবাসী মানুষদের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। আবার ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় ৯ আগস্টকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের। কিন্তু বাংলাদেশে এ দিবসটি বেসরকারিভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে মূলত ২০০৪ সাল থেকে।
সরকার পালন না করলেও ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ নিয়ে চলছে নানা আয়োজন। আদিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানসহ ভুমির অধিকার, শিক্ষা ও নিরাপত্তার দাবীগুলো উচ্চারিত হচ্ছে আদিবাসীদের মুখে মুখে। কিন্তু কেমন আছে এদেশে বসবাসরত আদিবাসীরা?
প্রথমে আসি শান্তিচুক্তি প্রসঙ্গে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলেও তা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। শান্তিচুক্তি হয়েছে, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এখনও প্রায় ক্ষমতাশুন্য। সরিয়ে নেওয়া হয়নি আর্মি ক্যাম্পগুলো। যে নির্দেশনার বলে সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তা-ও বাতিল করা হয়নি। শুধু পাহাড়িরাই নয়, পার্বত্য অঞ্চলে যে কোনো পর্যটককেই থাকতে হয় কড়া নজরদারিতে।
পাহাড়ে ভূমি বিরোধের নিষ্পত্তি হয়নি অদ্যাবধি। সমতলে ভূমি বিরোধের ঘটনা বেড়েছে কয়েকগুন। শুধু তাই নয়, নতুন নতুন ভূমি বিরোধ তৈরি হচ্ছে পাহাড়ে। ভূমি দখলের ঘটনায় সাজেক, রামগড়, মহালছড়ি, বরইতলীতে সংঘাত হয়েছে এবং এখনও তা থেমে নেই। মহালছড়ি থেকে রাঙামাটির পথে গামারিডালা এলাকাটি সম্পূর্ণই এখন স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এভাবে পাহাড়ে বাড়ছে রক্তপাত। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেই পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সঙ্কট। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে চাইছে না। পাহাড়ি-পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ি বাঙালিদের রাজনৈতিক ইন্ধন অশান্ত পরিবেশ তৈরি করছে।
কয়েকমাস আগে আদিবাসী নারীদের উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি সহিংসতা বিষয়ে বেসরকারি দুটি সংস্থা এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যাতে দেখা যায় গত ৮ বছরে ৪৩৪ জন আদিবাসী নারী-শিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হলেও একটিরও বিচার হয়নি।
তারা আরও জানায়, ২০১৫ সালে ৬৯টি ঘটনার মধ্যে ৩৮টি পার্বত্য চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো সমতলে সংঘটিত হয়েছে। আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। ২০১৫ সালে ১৪টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ১১টি শারীরিক লাঞ্ছনা, ৬টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি, ১৬টি ধর্ষণের চেষ্টাসহ ৬৯টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কারণে সংখ্যালঘু আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
গারো নারীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে বিউটি পার্লার, গার্মেন্টস ও বিদেশিদের বাসাবাড়িতে। মালিক দ্ধারা হয়রানি ছাড়াও তারা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক বাঙালি ছেলে নানা প্রলোভনে বা জোর করে বিয়ের মাধ্যমে গারো নারীদের ধর্মান্তরিত করে লুফে নিচ্ছে তাদের সহায় সম্পত্তি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আদিবাসীদের প্রতি নির্যাতন বৃদ্ধির মূল কারণ হল বিচারহীনতা। প্রশাসন, রাজনীতিক ও বিচার ব্যবস্থার পক্ষপাতিত্বের কারণে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। আবার অনেক গবেষক মনে করেন আদিবাসীদের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণেই তাদের ওপর নির্যাতনে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর নির্যাতন বাড়ছে।
২০০৮ সালে সরকার ঘোষণা করে দেশে কোনো আদিবাসী নেই। পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্তটিই চূড়ান্তরূপ পায় বর্তমান সরকারের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। সংশোধিত সংবিধানের উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশ নামে ২৩(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে -রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অন্যান্য বৈশিষ্টপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।
আবার ৬ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশে -বাঙালি ছাড়া অন্য সব মানুষের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে – বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন। ফলে সেখানে অন্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও আত্মপরিচয় পুরোপুরি অস্বীকার করা হয়েছে।
একইভাবে ২০১০ সালের ১২ এপ্রিল প্রণীত হয় ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান’আইনটি। এর ২(২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’অর্থ তফসিলে উল্লেখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ।
একদিকে সরকার বলছে দেশে কোনো আদিবাসী নেই, আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বর্তমান আইন মতে আদিবাসীরাই যদি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হন, তবে তো সরকার বলেই দিচ্ছে এদেশে আদিবাসী আছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি হয়। ফলে পাহাড়ে কয়েক দশকের রক্ত সংঘাতের অবসান হয়। এই চুক্তির জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কার’লাভ করেন। তাই এ সরকারের উচিত আদিবাসীদের যৌক্তিক দাবীগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া।
এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীরাও বাঙালিদের সঙ্গে কাঁধেকাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। অথচ স্বাধীন দেশে তারা পাচ্ছে না নিজেদের স্বীকৃতিটুকু। আমরা চাই না একটি স্বাধীন দেশে অন্য জাতিকে ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বলতে। চাই আদিবাসীদের হাতে হাত রেখে এ দেশটাকে এগিয়ে নিতে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে পরিবর্তন.কমে, প্রকাশকাল: আগস্ট ০৯,২০১৬
© 2016 – 2018, https:.