বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর
শাহরিয়ার কবির
অনুলিখন: সালেক খোকন
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—‘ইসলামের কার্ড’ হল জামায়াতের কার্ড, এটা বিএনপির কার্ড। আওয়ামী লীগ ওই কার্ড খেলতে গেলে ওটা ‘সুইসাইড’ হবে। আওয়ামী লীগের কার্ড হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ১৯৭০ সাল বলুন আর ২০০৮ সাল বলুন, ’৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানকে ‘না’ বলার জন্য মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ভোট দিয়েছে। পাকিস্তানিরা কিন্তু তখনও বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না। মানুষ সে কথা শোনেনি। একাত্তরে জামায়াতিরা বলেছিল, পাকিস্তানের বুকে ইসলাম না থাকলে পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে না। মানুষ তো সেটা শোনেনি। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ২০০৮ সালেও একই কথা বলেছিল জামায়াত-বিএনপি। মানুষ তা শোনেনি। তাই ধর্মের ওই কার্ড ওটা জামায়াতই খেলুক। শেখ হাসিনা চাইলে জামায়াতকে ‘ওভার ট্রাম’ করতে পারবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কার্ড’ দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ কতটুকু প্রতিষ্ঠিত? সেটা জানতে একটু পেছনে ফিরতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান পরিবর্তন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির একধরনের মৌলবাদিকরণ বা ইসলামিকরণ বা পকিস্তানিকরণ আরোপিত হয়েছে। এটা যেভাবে চলছিল মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার ফলে তা কিছুটা কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়েছে– এটা বলা যাবে না। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী যখন ক্ষমতায় ছিল, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যেভাবে তারা প্রশাসন ও রাজনীতির জামায়াতিকরণ বা মৌলবাদিকরণ করেছে তার মাসুল এখনও আমাদের দিতে হচ্ছে।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এখন। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়বে– এমনটাই আশা আমাদের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে বটে, জামায়াতের শীর্ষ পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। কিন্তু আমরা তো কিছু ব্যক্তির বিচার করছি। যে রাজনৈতিক দর্শন গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল, যেটাকে আমরা ‘মওদুদীবাদ’ বলি, জামায়াতের সে দর্শন কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদ্যোগ এখনও দৃশ্যমান হয়নি।
তা ছাড়া জামায়াতের যে বিশাল অর্থনৈতিক স্বর্গরাজ্য, তাদের যে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক, তাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি অটুট রয়েছে। তাদের দাওয়াতি কার্যক্রম গ্রামপর্যায়ে এখনও অব্যাহত। জামায়াত এবং বিএনপির আমলে পাঠ্যসূচি ও সংস্কৃতিনীতি যেভাবে একটা বিশেষ রাজনীতি সামনে রেখে করা হয়েছিল, সেগুলোও বন্ধ হয়নি। এখনও মাদ্রাসায় মওদুদীবাদ পড়ানো হচ্ছে। মাদ্রাসার ছাত্ররা এখনও পড়ছে এবং বিশ্বাস করছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ– এগুলো ‘কুফরি’ মতবাদ, ইসলামবিরোধী মতবাদ; যারা এগুলোর কথা বলবে তারা ‘মুরতাদ’। আর মুরতাদদের হত্যা করা যায়। তাই ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন চিন্তা বা ভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসীদের হত্যা করা থেকে জামায়াত কখনও সরে আসেনি।
তারা প্রায়ই বলে জামায়াত নাকি সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দল। নিয়মিতভাবে সম্মেলন ও নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এরা এগিয়ে। কিন্তু এটাই গণতন্ত্রের একমাত্র বিষয় নয়। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী ‘তানজুমাল কোরআনে’ লিখেছেন, গণতন্ত্র একটা কুফরি মতবাদ এবং এ মতবাদে যারা বিশ্বাস করে তারা ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে; যে দল মনে করে মুসলিম ও অমুসলিমের সমান অধিকার থাকতে পারবে না; যে দল নারী ও পুরুষের সমান অধিকার বিশ্বাস করে না; যে দল ‘ব্লাসফেমি’ আইন চালু করতে চায়; যে দল বাংলাদেশে শিয়াদের অমুসলিম মনে করে, অথচ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিতে জনগণই সার্বভৌমত্বের মালিক। সে দল কিভাবে একটি গণতান্ত্রিক দল হয়?
জামায়াতের সন্ত্রাসের দর্শনটা আজ সবাইকে জানতে হবে। জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তজার্তিক সংগঠন। আইএস আর আল কায়দার জম্মের বহু আগ থেকেই আন্তজার্তিক নেটওয়ার্ক তারা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। বিভিন্ন দেশে তারা শাখা প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের নীতি হচ্ছে মওদুদীবাদ। তারাই জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জেহাদ, জেএমবি এসব তৈরি করে লোকজন রিক্রুট করে আফগানিস্তানে পাঠিয়েছে জেহাদ করার জন্য। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জিহাদি বলয়ের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ তৈরি হয়। ওইসব জেহাদি আবার ফিরেও এসেছে। এভাবে সন্ত্রাসকে জামায়াতে ইসলামের নামে বৈধতা দিয়ে আসছে। তাই জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।
অনেকেই বলছেন, জামায়াত নিষিদ্ধ হলে বিএনপির দল ভারী হবে, নিষিদ্ধ হলে তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে এবং আরও শক্তিশালী হবে। আবার নানা চাপ রয়েছে আমেরিকার ও ওআইসির। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রেও তো বাধা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি সাহসের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং যাবতীয় চাপ অগ্রাহ্য করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারেন, তাহলে তিনি বা তাঁর দল চাইলেই জামায়াতও নিষিদ্ধ হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না—‘ইসলামের কার্ড’ হল জামায়াতের কার্ড, এটা বিএনপির কার্ড। আওয়ামী লীগ ওই কার্ড খেলতে গেলে ওটা ‘সুইসাইড’ হবে। আওয়ামী লীগের কার্ড হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ১৯৭০ সাল বলুন আর ২০০৮ সাল বলুন, ’৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানকে ‘না’ বলার জন্য মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা ভোট দিয়েছে। পাকিস্তানিরা কিন্তু তখনও বলেছিল, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না। মানুষ সে কথা শোনেনি। একাত্তরে জামায়াতিরা বলেছিল, পাকিস্তানের বুকে ইসলাম না থাকলে পৃথিবীতে ইসলাম থাকবে না। মানুষ তো সেটা শোনেনি। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ২০০৮ সালেও একই কথা বলেছিল জামায়াত-বিএনপি। মানুষ তা শোনেনি। তাই ধর্মের ওই কার্ড ওটা জামায়াতই খেলুক। শেখ হাসিনা চাইলে জামায়াতকে ‘ওভার ট্রাম’ করতে পারবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কার্ড’ দিয়ে।
সরকার গত সাত বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ যেসব উন্নয়ন করেছে সেটার জন্য নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু এখন মাথাপিছু আয়টাই যদি সব হয়, তাহলে সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় তো আমাদের দশগুণ। তাই বলে কি আমরা সৌদি আরবের মতো একটা রাষ্ট্র চাইব? উন্নয়নের টার্গেট আমাদের আছে। কিন্তু জাতির চেতনাগত টার্গেটও আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে।
এ সরকার অনেক কিছুই করেছে। সংবিধানে চার মূলনীতি পুনঃস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু দুই ‘পাকি-মনা’ জেনারেল এরশাদ ও জিয়া যেভাবে সংবিধানের সাম্প্রদায়িকতাকরণ করেছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’সংযুক্ত করে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে– এগুলো তো এখনও রয়ে গেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দীপ্ত পদক্ষেপে– এটা পুরোপুরি বলা যায় না।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিশদ ব্যাখ্যা করেছিলেন। ধর্মের নামে আমরা পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন দেখেছি, ধর্মের নামে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ দেখেছি, এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয় বাংলাদেশে, সে জন্য ধর্মের নামে রাজনীতিটা নিষিদ্ধ হওয়া দরকার।
রাজনীতির মৌলবাদিকরণের রূপরেখা আসলে দীর্ঘকাল ধরে চলেছে। আমরা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশটা স্বাধীন করেছি। সরকারি হিসাবে দুই লাখ আর বেসরকারি হিসাবে সোয়া চার লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য, ধর্ম নিরপেক্ষ একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। অথচ বেশির ভাগ সময় এ দেশটা শাসন করেছে স্বাধীনতাবিরোধীরাই। ফলে কিছু মানুষের মধ্যে হয়তো মৌলবাদী ঝোঁক বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপরায়ণ হতে পারে, কিন্তু তারা মৌলবাদী নয়, সাম্প্রদায়িক নয়। এটা তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রমাণ করেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রমাণ করেছে, শাহবাগে যে গণজাগরণ হল– এর মাধ্যমেও প্রমাণ করেছে। তাই এই মানুষের ওপর আস্থা আমাদের রাখতে হবে।
আরেকটা ভাবনার বিষয় কিন্তু ঘটে চলেছে সমাজে। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরি, ষাটের দশকে আমরা যখন পড়েছি। আমরা তো একটাও ‘হিজাবি’ দেখিনি। বোরখা পড়াটাকেই তখন নিন্দার চোখে দেখা হত। টিটকিরি মারা হত। ঢাকায় আমার জন্ম। ছোটবেলায় দেখেছি পাড়াতে কোনো মহিলা বোরখা পড়ে আসলে ছোট ছেলেমেয়েরা তার পিছু নিত আর টিটকিরির ভাষায় বলত, ‘বোরখাওয়ালি বুয়া, তেরি বোরখা মে চুয়া’। আর আজ বোরখা ও হিজাব সামাজিক ‘স্ট্যাটাস’ হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে হল এটা?
পঁচাত্তরের পর থেকে বিপুল পরিমাণে জনশক্তি আমরা রপ্তানি করেছি মধ্যপ্রাচ্যে। রেমিটেন্স আর পেট্রো ডলার হয়তো আসছে। কিন্তু এর পাশাপাশি সৌদি আরব থেকে ওয়াহাবি সংস্কৃতিটা যে আমাদের সমাজে পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিচ্ছে– সেটা আমরা খেয়াল করছি না। বরং আমরা এটাকে গ্ল্যামারাইজ করছি। কাগজে দেখেছি ঈদের সময় দেড় লাখ টাকায় হিজাব বিক্রি হয়েছে। এটা কিন্তু উদ্বেগের বিষয়। আমাদের মায়েরা, দাদী-নানীরা কি যথেষ্ট পর্দানশীল ছিলেন না? তারা তো শাড়ি পড়েছেন। শাড়িতো আমাদের চিরকালীন পোশাক। এই যে আধুনিকতা। এটা তো আসলে উল্টো যাত্রা।
এখন সমাজের উচ্চ পরিবারের ছেলেমেয়েরাও জঙ্গি-সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। কেন ঘটছে এমনটা?
মূলত আত্ম-পরিচয়ের সংকট তৈরি হচ্ছে পরিবারের মধ্যেও। আমি আগে বাঙালি নাকি মুসলমান? এটা আগে ঠিক করতে হবে। ইসলাম ধর্ম এই অঞ্চলে এসেছে মাত্র এক হাজার বছর আগে। আর পলিটিক্যালি ইসলাম যদি বলি সেটা তো খুব কম সময় আগের। বৌদ্ধ ধর্ম আড়াই হাজার আর হিন্দু ধর্ম এসেছে তিন হাজার বছর আগে। কিন্তু আমাদের বাঙালির ইতিহাস তো পাঁচ হাজার বছরের। এর মধ্যে আমরা তো বিভিন্ন সময় ধর্ম গ্রহণ করেছি, বর্জনও করেছি। আমাদের ‘এথনিক আইডিনটিটি’ তো পাল্টায়নি। আমি বাঙালি হয়ে জন্মেছি, বাঙালি হয়েই মরব। তাই আমি আগে বাঙালি। এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়।
তাছাড়া আমরা তো আমাদের সংস্কৃতিটাকে তরুণদের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। সাত শ বছর আগে কবি বলেছিলেন, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। সমকালীন বিশ্ব সাহিত্যে এমন আরেকটি বয়ান আপনি খুঁজে পাবেন না। শেকসপিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক। কিন্তু মনে রাখতে হবে চন্ডিদাসের দুই শ বছর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। শুধু সাহিত্যই নয়, অহংকার করার মতো হাজারটা বিষয় আছে বাঙালিত্ব চেতনার মধ্যে। এগুলো প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে পরবর্তী জেনারেশনের মধ্যে।
জঙ্গিবাদ ও ধর্মের নামে সন্ত্রাস একটা বিচ্ছিন্ন, একটা আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা নয়। এই সন্ত্রাসের একটা রাজনীতি আছে, দর্শনও আছে। এটাকে দার্শনিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে জয়ী হওয়া কঠিন হবে। শক্তিপ্রয়োগ দরকার। কিন্তু সেটা একটা সাময়িক ব্যবস্থা মাত্র। আদর্শকে মোকাবেলা করতে হবে আদর্শ দিয়ে। কিন্তু সেটার কি কোনো উদ্যোগ আমরা হাতে নিয়েছি?
এই যে জামায়াতিকরণ বা মৌলবাদিকরণের কথা বলছি, কিন্তু বি-মৌলবাদিকরণ ব্যবস্থা তো কোথাও দেখছি না। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি দলগুলো কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল কি সাংগঠনিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে ? বরং ওরা যতটা অ্যাকটিভ হচ্ছে আমরা ততটা ইনঅ্যাকটিভ রয়েছি।
আগে জামায়াতিদের তত্ত্বগতভাবে মোকাবেলার ক্ষেত্রে বামরাই ছিল উপযুক্ত। তাদের উপযুক্ত সংগঠনও ছিল। বাহাত্তরে সিপিবি কোথায় ছিল? ছাত্রলীগের চেয়েও বড় সম্মেলন তো ছাত্রইউনিয়ন করেছিল। ষাটের দশকে সব ট্রেড ইউনিয়ন বামরাই নিয়ন্ত্রণ করেছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে ছিল বামদের আধিপত্য। আজ আপনি তাদের কোথায় খুঁজে পান? এসব ইস্যুতে তো আমরা বামদের এখন পাই না। তারা মানুষের কথা বলবে, শ্রমজীবীর কথা বলবে। কিন্তু মানুষ কী চায়? সেটা বোঝার চেষ্টা করে না। এখন কি সাম্যবাদের কথা বলব, সমাজতন্ত্রের কথাও, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতন্ত্রের জমিনটাই আমাদের পায়ের নিচে থাকছে না? আগে তো জমিনটা তৈরি করতে হবে।
আমার বাম বন্ধুরা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধচারণ করতে গিয়ে এখন জামায়াত-বিএনপির ভাষাতেই কথা বলছেন। তাদের ইস্যুগুলোও হাইজেক্ট হয়ে যাচ্ছে। জামায়াততো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুতে কেন বামরা এক হতে পারে না? তারা এখন আর জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। অথচ এটাকে তো অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
আগে স্থির করতে হবে, আমরা কোন বাংলাদেশ চাই?
আমরা কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ চাই? নাকি হেফাজত-জামায়াত বাংলাদেশে যে ১৩ দফার ভিত্তিতে একটা শরিয়তি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সেদিকে যাব? যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশ বা প্রজন্ম চাই, তবে প্রথমে বলব, বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে। সেখানে সংবিধান অনুসারে বঙ্গবন্ধু তো একটা শিক্ষানীতি করেছিলেন কুদরত-ই- খুদাকে দিয়ে। মহাজোট সরকারও কবির চৌধুরীকে দিয়ে ওরকম একটা শিক্ষানীতি তৈরি করেছিলেন। সেখানে সুপারিশ করা হয়েছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত মাদ্রাসায় সাধারণ কারিকুলাম রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস মাদ্রাসায় বাধ্যতামূলক করার। অনেকেই তো দারিদ্র্যর কারণে মাদ্রাসায় পড়তে যাচ্ছে। তাদের তো একটা লক্ষ্য আছে। পাস করে বেরিয়ে একটা সরকারি চাকরি বা ভালো সুযোগসুবিধার চাকরি করবে। কিন্তু তার যে পাঠ্যসূচি সেটা দিয়ে তো সে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকতে পারছে না। তার দরজা তো খোলা থাকছে শুধু হেফাজত, হরকাতুল জেহাদ আর জামায়াতের দিকেই। আমরা তো মাদ্রাসার শিক্ষার বিরুদ্ধে না, বরং মাদ্রাসার কারিকুলামটা যুগোপযোগী করার পক্ষে। অথচ এই শিক্ষানীতি জামায়াত, হেফাজত ও সরকারের আমলাদের কারণে এখনও হিমঘরে পড়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শিক্ষানীতি, সংস্কৃতিনীতি, নারীনীতি, শ্রমনীতিতে প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ মানবগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে। সর্বস্তরের পরীক্ষায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকে ১০০ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না সেকুলারিজম প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সেকুলারিজম মানে ধর্মকে বাতিল করা নয়। বরং রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখা।”
এই অবস্থানে যদি আমরা শক্তভাবে দাঁড়াতে পারি, আমি মনে করি দশ বছর পর আলোকিত রাজনীতির আলো আমরা দেখতে পারব। যেখানে ধর্ম থাকবে, কিন্তু মানুষে মানুষে বিভাজনটা থাকবে না। মানুষের ভেতরই আমরা ধর্মকে পাব। ওটাই শক্তি।
শহীদ জননী জাহানার ইমাম মুক্তিযুদ্ধের অহংকারটিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তাই তরুণ প্রজন্মের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই বোধটা, এই অহংকারটা তরুণরা আজ ধারণ করছে। এটা পরিবার ও সামাজিকভাবে লালন করতে হবে। সরকারিভাবে এর ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই আমরা আরও এগিয়ে যাব। এখন যে মেধার পরিচয় আমরা দিচ্ছি এটা অব্যাহত থাকলে সারা বিশ্বে আমাদের ইতিবাচক আধিপত্য বাড়বে। তরুণদের হাত ধরেই একসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ একটি মানবিক দেশ হবে বাংলাদেশ।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ অক্টোবর ২০১৬, ১০বছর পূর্তি সংখ্যায়
© 2016 – 2018, https:.