মুক্তিযুদ্ধ

একজন রাজাকার চিরকালই রাজাকার

“আমার ছোটবেলাটা ছিল অন্যরকম। স্কাউটিং করতাম। নাটকের প্রতিও ঝোঁক ছিল। তখন ক্লাস সিক্সে। মকবুল স্যার নাম লিখে নিলেন। আমি তো মহাখুশি। পরে শুনলাম নাটক করতে হবে নারী চরিত্রে। মনটা খারাপ হল। জীবনের প্রথম নাটক, তাও আবার নারী চরিত্র! নাটকটা করলামও। কিন্তু বন্ধুদের টিটকিরির ভয়ে পাঁচদিন স্কুলে যাইনি।

“লাইব্রেরি-সংস্কৃতি তখন খুব চালু ছিল। কার কত টাকা সেটা বিবেচ্য ছিল না। কাজ আর মানসিকতার কদর ছিল বেশি। খারাপ লোকের টাকা থাকলেও কদর পেত না। এখন হয়েছে উল্টো।

“আমি তখন নাইনে পড়ি। সারা দেশে আন্দোলন তুঙ্গে। শেখ মুজিবের নাম সবার মুখে মুখে। পাকিস্তান সরকার ‘দেশ ও কৃষ্টি’ নামে একটা বই স্কুলগুলোতে দেয়। বাঙালি সংস্কৃতি ভুলে পাকিস্তানি তমদ্দুন-তাহজিদ-কৃষ্টি শিখানোর চেষ্টার অংশ ছিল সেটি। ওই বইটি আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।

“সত্তরের নির্বাচনের কিছু আগের কথা। বঙ্গবন্ধু আসেন কুষ্টিয়ায়। বানানী সিনেমা হলের সামনের বড় মাঠে মিটিং চলে। ওই দিন খুব কাছ থেকে দেখি নেতাকে। পাহাড়সম একটা লোক। কী তাঁর কণ্ঠ! আমি যে কথাটা বলতে চাইছি তাঁর মুখে যেন সেই কথাই উচ্চারিত হচ্ছে। ওই দিন থেকেই বঙ্গবন্ধু জায়গা করে নেয় আমার হৃদয়পটে।”

পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে দুলালের ডান হাতের কব্জির হাড় ভেঙে রগগুলো ছিঁড়ে যায়
পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে দুলালের ডান হাতের কব্জির হাড় ভেঙে রগগুলো ছিঁড়ে যায়

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখার স্মৃতি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল।

আব্দুল গফুর সরদার ও আয়েশা গফুরের সপ্তম সন্তান দুলাল। পৈত্রিক বাড়ি বরিশালের হিজলার হরিনাথপুরে। কিন্তু বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দুলালের বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি খালিশপুর প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন আলমডাঙ্গা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।

দুলালদের পরিবার ছিল রাজনৈতিক সচেতন। কিন্তু কিভাবে এবং কেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেন? অন্তরালের সেই গল্প জানতে চাই আমরা।

 তিনি বলেন, “আমার বড় দুলাভাই চাকুরি করতেন খুলনা কোকোনাট প্রসেসিং মিলে। তিনি পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ৩ মার্চ ১৯৭১। খুলনায় একটা মিছিল সার্কিট হাউজের কাছে পৌঁছালে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ওখানেই শহীদ হন তিনি। এ খবর আমাদের মনে ঝড় তুলে। বোনের মুখটার দিকে তখন তাকাতেই পারি না।

“একদিন আগেই বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন রেসকোর্স ময়দানে। দেশ তখন অশান্ত। বোনকে নিয়ে ফেরার পথে চুয়াডাঙ্গা রেল স্টেশনে শুনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি। এক দোকানে বাজছিল সেটি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে…।’ মনের কথাই যেন বললেন তিনি। ওই দিনই শপথ নিয়েছিলাম, ওদের এ দেশ থেকে তাড়াব। মরণ হলেও দেশটাকে স্বাধীন করব।”

কী করলেন তখন?

মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলালের উত্তর, “ধারণা ছিল কিছু একটা ঘটবে। তাই হান্নান ভাই প্রথম ট্রেনিংয়ের উদ্যোগ নেন। স্কাউট ট্রেনিং ছিল আমার। আনসারদের কাছ থেকে রাইফেল চালানোও শিখে নিয়েছিলাম। স্কুল থেকে এসিড বাল্ব চুরি করে সেটা দিয়ে এলজিইডির মাঠে শেখানো হল ককটেল বানানো। কয়েকদিন পর হাসু আর হান্নান ভাই স্টেশনের জিআরপি পুলিশের কাছ থেকে কয়েকটা রাইফেল কেড়ে আনেন। তা দিয়েই আমরা আলমডাঙ্গায় পাহারা বসাই।”

৩০ মার্চ ১৯৭১। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে পাকিস্তানি সেনারা দখলে নেয় কুষ্টিয়া। এপ্রিলের ৭ তারিখে তারা পজিশন নেয় আলমডাঙ্গা থানায়। ওই দিনই আবুল হোসেনসহ ৮-১০ জনকে ওরা ধরে নিয়ে যায় হাটবলিয়া ফেরি ঘাটের সামনে। সেখানে গুলি করে তাঁদের হত্যা করা হয়। আলমডাঙ্গায় ওটাই ছিল প্রথম গণহত্যা।

ট্রেনিংয়ে গেলেন কোন সময়?

“মে মাসের প্রথম সপ্তাহের কথা। সেকান্দারসহ কয়েকজন পরিকল্পনা করি বাড়ি ছাড়ার। আব্বা বেতনের টাকা রাখতেন আলমারির ভেতরে। সেখান থেকে ৫০ টাকা নিয়ে একটা স্লিপ লিখে দিলাম– ‘খুব প্রয়োজনে ৫০টা টাকা নিলাম আব্বা। পরে দিয়ে দিব।’ একদিন বাড়ির সবাই ব্যস্ত নানা কাজে। পেছন দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি। মেহেরপুর, কুষ্টিয়া পার হয়ে কাজিপুর দিয়ে চলে যাই ভারতের নদীয়াতে। মুজিব নগরের ঠিক ওপাশে দমপুকুর। সেখানকার ক্যাম্পে গিয়ে নাম লিখাই।

“সেখানে ১৫ দিন চলে লেফট-রাইট। অতঃপর আসেন ভারতীয় সেনারা। হায়ার ট্রেনিংয়ে লোক নিবে জনাবিশেক। আমি রোগা পাতলা। সাইজেও ছোট। টিকলাম না। কিন্তু যুদ্ধ করার তীব্র বাসনা মনে। হঠাৎ ওরা জানতে চাইল কুষ্টিয়া ও যশোরের বাইরের কেউ আছে কি না? সঙ্গে সঙ্গে আমি হাত তুললাম।

চিকিৎসা হলেও মুক্তিযোদ্ধা দুলালের ডান হাত স্বাভাবিক হয়নি
চিকিৎসা হলেও মুক্তিযোদ্ধা দুলালের ডান হাত স্বাভাবিক হয়নি

“আমাদের ট্রেনিং হয় বিহার চাকুলিয়ায়। ট্রেনিং সেন্টারে ক্যাপ্টেন ভোলা শিং ও হাবিলদার রাজেন্দ্র কুমারের কথা এখনও মনে পড়ে। ২৮ দিনের ট্রেনিংয়ে শিখানো হল থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এসএমজি, এসএলআর, গ্রেনেড, মাইন, মর্টার, রকেট লাঞ্চার প্রভৃতি চালানো। আমার এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) নং ২১২৭।”

ট্রেনিং শেষে দুলালসহ তাঁর সহযোদ্ধাদের আনা হয় ৮ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে, কল্যাণীতে। কুমারখালির খলিল গ্রুপের সঙ্গে দুলালকে পাঠানো হয় ভারতের বানপুরে। দর্শনার উল্টো দিকে ছিল তাদের ক্যাম্পটি। আগস্টের প্রথম দিকে ধোপাখালি ব্রিজ ও পরে ভিওপি ও দর্শনার বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করেন তাঁরা। এরপর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের শিকারপুরের একটি অ্যাকশন ক্যাম্পে।

বাকি ইতিহাস শুনি গোলাম মোস্তফা দুলালের জবানিতে–

“আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংকারে ডিউটি করতাম। মাঝেমধ্যে গেরিলা অপারেশনও চালত। এভাবে আলমডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করি। আমাদের ১৩ জনের দলটির কমান্ডার ছিলেন সুলতান জোয়ারদার। হান্নান গ্রুপ, সুলতান গ্রুপ, রশিদ গ্রুপ ও নান্নু গ্রুপ একসাথে থাকত। সম্মিলিত অপারেশন হলে কমান্ড করতেন হান্নান ভাই।”

১৯৭১ সালে এক অপারেশনে মারাত্মকভাবে আহত হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের ব্রাশের গুলিতে তাঁর ডান হাতের কব্জির ওপরের হাড় ভেঙে, মাংস পুড়ে, রগগুলো ছিড়ে যায়। চিকিৎসা হলেও এখনও ডান হাতের আঙুলগুলো তিনি পুরোপুরি সোজা করতে পারেন না। তিনটি আঙুল অবশ। চামড়ায় ব্যথ্যা হয় মাঝেমধ্যেই। কষ্ট হয় অনেক। কিন্তু খুশি মনে তা সহ্য করে যাচ্ছেন স্বাধীন এ দেশের জন্য।

কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওই দিনটিতে? জানতে চাই আমরা। স্মৃতি হাতড়ে মুক্তিযোদ্ধা দুলাল বলতে থাকেন ঘটনার আদ্যোপান্ত–

“রোজা তখন চলছে। আমরা বৃহত্তর কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গা, মেহেরপুর এলাকায়। আলমডাঙ্গার ভেতরে ছিল মিলিশিয়া বাহিনী। তারা সবাই পাঞ্জাবি। ছিল কালো রঙের ড্রেস পড়া রাজাকাররাও। বিহারির সংখ্যাও ছিল অনেক। পাকিস্তানি আর্মিরা আসত মাঝেমধ্যে। ঈদের দিনে আমরা আলমডাঙ্গা শহর অ্যাটাক করার পরিকল্পনা করি। সেসময় ঈদগাহ মাঠে সবাইকে এক জায়গায় পাওয়া যাবে। এ কারণেই আমাদের চারটা গ্রুপের সঙ্গে মরফত, কামাল, আবদার ভাইয়ের দলসহ আরও কয়েকটা গ্রুপ যোগ দেয়।

ভিডিও দেখতে : আহত হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল

  “১১ নভেম্বর ১৯৭১। সন্ধ্যাবেলা। কুমার নদীর ওপারে কুঠিবাড়ির কাছে পাওয়ার স্টেশনটি আমরা উড়িয়ে দিই। চুয়াডাঙ্গা থেকে দক্ষিণে যেন কোনো আর্মি আসতে না পারে সে কারণে সেখানকার রেললাইন উড়ানো হয়। এভাবে পরিকল্পনা করে কুষ্টিয়া থেকে আলমডাঙ্গাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। আমরা তখন পজিশনে থাকি আলমডাঙ্গার চারদিকে।

“গেরিলা সেজে শহরের ভেতরটা ‘রেকি’ করতে হবে। তাই ১২ নভেম্বর ভোরে চারজনকে নিয়ে নান্নু ভাই শহরে ঢুকলেন। আমরা তাঁর অপেক্ষায় থাকি। সময় সকাল ৯টা। হঠাৎ গুলির শব্দ। ভেতরে কিছু একটা হয়েছে। নান্নু ভাইকে উদ্ধার করতে হবে। আমরা কুমার নদী দিয়ে আলমডাঙ্গা শহরে ঢুকি। চারদিক থেকে অন্যরাও এগোতে থাকে। সোনালী ব্যাংকের পাশ থেকে চাঁদতারার দিকে ফায়ার দিই আমরা। ওখানে ছিল রাজাকাররা। খানিক এগোতে নান্নু ভাইকে পাওয়া গেল। তাঁর গ্রুপটি আগেই এক রাজাকারকে গুলি করে মেরেছে। চারদিকের আক্রমণে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা আশ্রয় নেয় আলমডাঙ্গা থানাতে। সেখানকার বাংকারে অবস্থান নিয়ে তারা ব্রাশ চালাতে থাকে।

করিমপুর ফিল্ড হাসপাতাল থেকে দেওয়া ছাড়পত্র
করিমপুর ফিল্ড হাসপাতাল থেকে দেওয়া ছাড়পত্র

“হান্নান ভাইসহ আমরা তিনজন ছিলাম অ্যাডভান্স পার্টিতে। একটা বাড়িতে পজিশন নিয়ে থানার দিকে দেখে দেখে ফায়ার দিচ্ছি। তখন মধ্য দুপুর। নান্নু ভাই গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু একটি গুলি এসে লাগে তাঁর মাথায়। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়েই তাঁর শরীরটা নিথর হয়ে যায়। একইভাবে গুলিতে মারা যান বজলু ডাক্তারও। হাসু ভাই ঢুকছিলেন ডাকবাংলোর পাশ দিয়ে। ওখানে মিলিশিয়ারা পোশাক ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ধরে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ভেবে তিনি কাছে যেতেই বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে ওরা। আনসার ভাই গুলি খান চাঁদতারার ওখানে। ওটা ছিল একটা আরবান ফাইট।

“প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে। আমাদের দৃষ্টি থানার দিকে। কিন্তু ডানে পোস্ট অফিসের কাছে যে একটা বাংকার আছে সেটা বুঝতেও পারিনি। ওরা ওত পেতে ছিল। আমাকে টার্গেট করেই ওরা গুলি ছুড়ে। আমিও পাল্টা জবাব দিব। হঠাৎ মনে হলো ধাক্কা খেলাম। হাত থেকে এসএলআরটাও পড়ে গেল। গুলি আমার মুখে লাগার কথা। কিন্তু তখন ম্যাগজিনটা কাট করছিলাম। এসএলআরটা মাঝখানে থাকায় গুলিটা প্রথম লাগে এসএলআরের বডিতে। অতঃপর স্প্রিন্টার ঢুকে যায় ডানহাতের কব্জিতে। ফলে হাড্ডি ভেঙ্গে মাংস বেড়িয়ে যায়। চামড়া ঝলসে গিয়ে রগগুলো গাছের শিকড়ের মতো ঝুলতে থাকে। রক্তে ভিজে যায় গোটা হাতটিই।”

তখনও জ্ঞান ছিল মুক্তিযোদ্ধা দুলালের। জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তকর সংগ্রাম তখনও শেষ হয়ে যায়নি। বরং নিজেকে বাঁচানোর সে কাহিনি বড়ই করুণ, বড়ই কষ্টের। সেসময়ই চুয়াডাঙ্গা থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে ছুড়তে আলমডাঙ্গার দিকে চলে আসে। গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত দুলাল তখন আশ্রয় নেন আলমডাঙ্গার এক কবরস্থানে। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে পুরনো একটি কবরে সারা রাত লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। শুধু মৃত মানুষই নয়, একাত্তরে জীবিত মানুষেরও ঠাঁই নিতে হয়েছিল কবরে!

সে স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে চোখ পানি আসে দুলালের। বলেন, “হাতের ব্যথায় আমি গোঙাচ্ছিলাম। পরে নওশের আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যায় এরশাদপুর গ্রামে। সেখানেও ডাক্তার নেই। আমার হাত গামছা দিয়ে বাঁধা। সহযোদ্ধারা মসজিদের খাটিয়ায় তুলে নেয় আমায়। সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে খাটিয়াটি। যেন লাশ আমি। পরে বেলগাছির ওহাব মেম্বারের বাড়িতে মিলে গ্রাম্য চিকিৎসা। কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। পরে গরুর গাড়িতে করে নেওয়া হয় পাচুরিয়া গ্রামের বিলে। আমার হাত তখন পঁচতে শুরু করেছে। গন্ধে কেউ সামনে আসে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সঙ্গে ছিলেন লালচান আর শহিদুল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা পালকিতে করে আমায় বর্ডার পার করে আনেন। চিকিৎসা হয় করিমপুর ফিল্ড হাসপাতালে। আমার হাতে গ্র্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। হাতের দিকে চোখ পড়লে এখনও একাত্তরটা মনে পড়ে যায়।”

স্বাধীনের পরের দেশ নিয়ে এই যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তাঁর ভাষায়–

“তাজউদ্দীন সাহেবের নির্দেশে প্রতি জেলায় একটা মিলিশিয়া ক্যাম্প করা হয়েছিল। যেখানেই মুক্তিযোদ্ধারা আর্মস জমা দেয়। উদ্দেশ্য তালিকা করে তাদের দিয়েই আর্মি বানানো। পাকিস্তান থেকে যে বাঙালি আর্মিরা আসবে তাদের বিভিন্ন সেক্টরে বসিয়ে দেওয়া হবে। মূল আর্মিতে থাকবে মুক্তিযোদ্ধারাই। কিন্তু সেটা হল না। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোরা যে কাজে ছিলি সেখানেই ফিরে যা।’ কিন্তু একটা সশস্ত্র সংগ্রামের পর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে ফিরে যাবে নিজেদের গ্রামে! কাজের জন্য সে লোকের কাছে যাবে, যে লোক তার মুনিব ছিল। একাত্তরে যে কিনা ছিল রাজাকার। এটা ছিল অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত। দেশ বানিয়েছে যারা, দেশ চালাবে তারা। কিন্তু এমনটা তো হল না!

দুলালের অনুকূলে তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরীর প্রত্যয়ন
দুলালের অনুকূলে তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরীর প্রত্যয়ন

“তসলিম আহমেদ। ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা ছিলেন পাকিস্তান সরকারের স্বরাস্ট্র সচিব। বিকালবেলা তিনিই হন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাস্ট্র সচিব। যিনি আবার মুজিব বাহিনীরও সনদ স্বাক্ষর করেছিলেন। বাহাত্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হল মুক্তিযোদ্ধারা ডাকাত। গুজব ছড়ানো হল বিভিন্ন দেশে যেখানে যুদ্ধ হয় সেখানে নাকি মুক্তিযোদ্ধাদেরও মেরে ফেলা হয়েছিল। এই ভয়ে তখন অনেক মুক্তিযোদ্ধাই কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। কারা এটা করল? যারা মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, কিন্তু ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খেতে চায়, তারাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা দুলাল বলেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শে তাঁর ডাকেই মুক্তিযুদ্ধ করতে গেলাম। আমরা কেউ বুকের কলিজা দিয়ে, কেউ হার্টের টুকরা দিয়ে, চোখের মণি দিয়ে একটা ফুল বানালাম। যে ফুলের নাম ‘বাংলাদেশ’। অথচ এ দেশেই তাঁকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টি একাত্তরেই রচিত হয়েছিল। তিনি বড় নেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁর সেভ গার্ড হিসেবে কাজ করত তাজউদ্দীন আহমদ ও নজরুল ইসলামের মতো নেতারা। ক্রমেই একটা চক্র তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গ্যাপ করে দেয়। আবার জাসদের মুজিববিরোধী প্লাটফরমেও তখন ঢুকে পড়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী লোকেরা। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি সহায়ক হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটিকেও। অতঃপর দেশ চলতে থাকে উল্টো দিকে।”

সপরিবারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল
সপরিবারে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল

জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা বলতে নারাজ এই সূর্যসন্তান, “ঘোলা পানিতে একটু চিনি মিশিয়ে মানুষকে দিলে মিষ্টি লাগে বলেই সেটা মানুষ খায়। সেই মিষ্টিটা হল জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। সেটি যদি তুলে নেওয়া হয় তাহলে থাকে শুধু ঘোলা পানি। রাজাকারদের পুনর্বাসিত করে ক্ষমতালোভী জিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটিকেই কলঙ্কিত করেছে। একজন রাজাকার চিরকালই রাজাকার থাকে। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা থাকে না। চেতনা আর আত্মসম্মানবোধ বিক্রি করে দিলে তিনি আর মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না।”

 মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে বললেন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল বলেন, “সাবডিভিশগুলোতে একটা তালিকা করা হয়েছিল। সেসময় আমন্ জানি দেড় লাখ লোক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করছে। অথচ জেনারেল ওসমানি সাহেবের স্বাক্ষরিত সনদ ছাপানো হয়েছিল ২৬ লাখ। মুক্তিযোদ্ধাদের চুল কাটছে, নদী পার করে দিয়েছে তারাও এক হয়ে এখন মুক্তিযোদ্ধা। আপনিই বলেন, ভিকটিম আর ফাইটার দুটো কি এক? দুজনের মর্যাদা কি এক হওয়া উচিত! বীরাঙ্গনা, যাঁকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। জীবিত বলে তিনি হলেন মুক্তিযোদ্ধা। আর যাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে তিনি হলেন গণশহীদ বা সাধারণ শহীদ। প্রশ্নগুলো তো থেকেই যাচ্ছে।”

যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?

মুক্তিযোদ্ধা দুলালের সোজাসাপটা উত্তর, “স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। কিন্তু চেয়েছিলাম একটা সমাজব্যবস্থা যেখানে শোসিত আর শাসক থাকবে না। সবাই মৌলিক অধিকার পাবে। দেশ অনেক উন্নত হয়েছে। কিন্তু ধনী-গরিবের বৈষম্যটাও তো অনেক বেড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তো কেউ জিজ্ঞেস করি নাই– আমার পাশে কে হিন্দু, কে মুসলমান। অথচ ধর্মটা এখন ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতিতেও। তাই এখন তো মানুষ দেখি না ভাই। দেখি কিছু হিন্দু আর মুসলমান। মানুষ কই?”

স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাললাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা।

“আমার দেশের ছেলেরা যখন সারা পৃথিবীতে সাফল্য পায়। লাল সবুজের পতাকাকে সম্মানিত করে। তখন বুক ভরে যায়।”

খারাপ লাগে কখন?

“যখন মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের উত্থান দেখি। এটা শুধু সরকারের বিষয় নয়। জঙ্গিবাদের বিষয়ে সকলকেই সজাক থাকতে হবে।”

পরবর্তী প্রজন্মের ক্যাপাবিলিটি ও প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলালের। সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ নানাভাবে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটিকে তাদের মনে গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বীর যোদ্ধা। বুকভরা আশা নিয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন–

“তোমরা বই পড়। নিজেকে জানো। নিজের চিন্তা ও মানসিকতাকে উদার কর। দেশটাকে ভালবাস। তাহলেই দেখবে দেশ এমনিতেই এগিয়ে যাবে।”

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩০ অক্টোবর ২০১৬

© 2016 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button