আদিবাসী

কড়া বিহা (শেষ পর্ব)

কড়া আদিবাসী বিয়েতে বর ও কনে উভয়ের বাড়ির উঠানেই পাতা দিয়ে মোড়ানো মাড়োয়া তৈরি করতে হয়। মাড়োয়া তৈরিও বিশেষ নিয়ম আছে। মাটি উঁচু করে চারদিকে চারটি কলাগাছ, চারটি তীর, প্রথমে মাটি উঁচু করে জায়গাটিকে লেপা হয়। অতঃপর তার চারকোণে চারটা কলাগাছ ও ভেতরে একটি বাঁশ গেড়ে দেওয়া হয়। মাড়োয়ায় রাখা হয় আমের পাতা, মহুয়া পাতা, পানিভর্তি দুটি কলস, দুটি প্রদীপ, চারটা তীর প্রভৃতি। কাল সাট লিয়া (মাটির ঘটি বিশেষ) রেখে সুতা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।

বিয়েবাড়ির ওপরে বাঁশ দিয়ে উঁচু করে টানাতে হয় বাঁদর। খর দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করে তাতে তীর-ধনুক লাগিয়ে তৈরি করা মূর্তি বিশেষকে কড়ারা ‘বাঁদর’ বলে। কড়ারা বিশ্বাস করে, এতে করে বিয়ের আগপর্যন্ত বিয়ে বাড়িতে কোনো অশুভ আত্মা আসতে পারে না। এ ছাড়া এ বানরাকৃতি ঝুলতে দেখলে সমাজের লোক দূর থেকেই জানতে পারে যে ওই বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে।

কড়াদের বিয়েতে বর প্রথমে ঘটি হাতে নিয়ে কানি আঙুলে সুতা বেঁধে প্রথমে মাড়োয়ার চারপাশে পাঁচ পাক দিয়ে ঘের তৈরি করে নেয়। অতঃপর বরকে মাড়োয়ার ভেতরে এনে বসিয়ে খির খাওয়ানো হয়। এ সময় নাউয়া (নাপিত) এসে বরের চুল-দাড়ি কামিয়ে দেয়। এবং কানি আঙুল কেটে সামান্য রক্ত নিয়ে, তার সঙ্গে চাল মিশিয়ে আমপাতায় মুড়িয়ে তা বেঁধে দেওয়া হয় বরের হাতে। কড়া ভাষায় এটি নিউওয়ে। একই দিন বরের বাড়ির মতো কনের বাড়িতেও নাপিত আসে এবং একই আচারের মাধ্যমে তাকেও গোসল করানো হয়।

কড়াদের বিয়েতে কনেকে গোসল করাতে লাগে ১০ জন লোক। এদের মধ্যে পাঁচজন পুরুষ ও পাঁচজন মেয়ে হতে হয়। গোসলের পরই বিয়ের শাড়িতে সাজানো হয় কনেকে।

নাপিত যখন বরের নখ কেটে দেয় তখন কড়া নারীরা গান ধরে—

নও কাটারে নেউয়া

আঙ্গারি জানান ভেঙ্গিয়া

দেবরে নেউয়া

বরকে বেহেনিয়া।

বরকে গোসল করানোর সময়ে কড়াদের আদিবাসী গান—

এতদিন সিনান করলেন ভাইয়া

খালে খন্দকে

আজ কেনে সিনান ভাইয়া

এতো দশের মাঝে।

এ হি মিনালে ভাইয়া

যাবেন মাকড় দেশে।

কড়াদের বিয়েতে পণের সঙ্গে মেয়েপক্ষকে সাতটি শাড়ি, তিন সের খাবার তেল, তিন পুরিয়া সিন্দুর আর ‘ডারিয়া ঝোপা (কোমরে সাজানোর এক ধরনের উপকরণ) দেওয়ার বিধান চালু আছে।

বিয়ের মূল পর্বকে এরা বলে বিহা। কনের বাড়ি দূরে হলে সকালে আর কাছাকাছি হলে বরপক্ষ সন্ধ্যারাতেই রওনা হয়। কড়ারা বিয়ের দিন বরপক্ষ সরাসরি কনের বাড়িতে ঢুকতে পারে না। বরপক্ষকে প্রথমে বাড়ি থেকে দূরে গাছের ছায়ায় বা কোনো ডেরায় রাখা হয়। সেখানেই তাদের আপ্যায়ন করা হয়।

বরপক্ষ দূরে অপেক্ষা করলে কনেবাড়ি থেকে ঘুইটা (শুকানো গবর বিশেষ), মশাল, পানিভর্তি একটি মাটির ঘটি ও পাতাসমেত আমের ডাল নিয়ে আসা হয়। অতঃপর আমের পাতা পানিতে ভিজিয়ে বরপক্ষের প্রত্যেককে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই সকলের উপস্থিতিতে বর ও কনের বাবা মাটির ঘটি অদল-বদল করে নেন।

কড়াদের বিয়েতে বরকে কনের বাড়িতে নেওয়ার আগে জাতি মিলন করা হয়। এ আচারে দুই পক্ষের মাহাতো ও পাঁচজন করে উপস্থিত হয়ে মাড়োয়ায় বিশেষ আচারের মাধ্যমে জাতি মিলন করানো হয়। এরপরই বরপক্ষ থেকে আনা জিনিস বুঝিয়ে দেওয়া হয়। আনা হয়—তিন বোতল তেল, তিন পুরিয়া সিঁদুর, পাঁচটা লুগা, ডোরাসেপিয়া পাঁচটা, কন্যাবাদে শাড়ি পাঁচটা প্রভৃতি।

বরকে কোলে করে নিয়ে আসবে তার শালা। অতঃপর বরকে বাড়িতে এনে প্রদীপ, ধান ও ঘাস দিয়ে বরণ করা হয়। একই সঙ্গে তাকে রুপার আংটি পরিয়ে খাওয়ানো হয় গুড়। কড়া ভাষায় এটি গুড় খিলা।

বিয়ের মূল পর্বকে এরা বলে সিমরেত হতে বা সিঁন্দুর পর্ব। এই পর্বটি বেশ নাটকীয়। কনের ভাইকে উঠতে হয় তার দুলাভাইয়ের কাঁধে আর বরকে গামছা নিয়ে উঠতে হয় তার দুলাভাইয়ের (বোহনে) কাঁধে। এ অবস্থায় বর তার কাছে থাকা গামছাটি কনের ভাই বা শালাকে দিয়ে দেয়। আর শালা ওই অবস্থায় বরকে পান খাইয়ে দেয়। পান খাওয়ানোর পর শালা ওই গামছাটি বরের কাঁধে পরিয়ে দেয়। গামছা পরানোর সঙ্গে সঙ্গেই বর কাঁধ থেকে নেমে চলে আসে সাজানো মারোয়ার দিকে। কনেকেও মাড়োয়ায় আনা হয়।

এই আদিবাসী বিয়েতে বর-কনের সিঁদুর পর্ব হয় চাষাবাদের প্রতীক জোয়ালের ওপর দাঁড়িয়ে গোপনীয়ভাবে। দুই পক্ষের মাহাতোর উপস্থিতিতে জোয়ালের দুদিকে বর ও কনে দাঁড়ানোর পর পরই চারদিকে কাপড় দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। বর ও কনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জোয়ালে তাদের এক পা পাশাপাশি স্পর্শ করিয়ে রাখে। আর ওই অবস্থায় বর তার হাতের তালুতে সিঁদুর নিয়ে পাঁচ আঙুলে কনের মাথায় দিয়ে দেয়। কোনোভাবেই সিঁদুর যেন মাটিতে না পড়ে, সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখা হয়। এটাই কড়াদের বিহা।

সিঁদুর পর্বের পর বর-কনেকে পালন করতে হয় খান্দা বা দশের খাবার পর্ব। নতুন হাঁড়িতে বা যেটিতে খাবার রান্না হচ্ছে, সেই হাড়িতে একটি কুলায় থাকা ঘাস, চাল ও ধান বর-কনেকে একসঙ্গে ঢেলে দিতে হয়। অতঃপর পরিচিত জনেরা ঘাস আর ধান ছিটিয়ে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে আর কনের হাতে গুঁজে দেয় নানা উপহার।

কড়া আদিবাসীদের প্রধান খাবার ভাত। বিয়েতে এদের পছন্দের খাবারের মধ্যে ঘংঘি (শামুক), মুসা (ইঁদুর), খোকরা (কাঁকড়া), কুচিয়া, দুরা (কচ্ছপ), ধারা, ঝিনুক, কুকুরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে বর্তমানে খাসির মাংস আর ডাল-ভাত খাওয়ানো হয়ে থাকে। হাড়িয়া এদের প্রিয় পানীয়। এদের উৎসব ও পূজাপার্বণে হাড়িয়ার ব্যবহার রয়েছে। এ আদিবাসী নারীদের একসময় নিজস্ব পোশাক ছিল। কড়া ভাষায় এটি পেনছি। বর্তমানে শাড়ি সস্তা হওয়ায় বিয়েতে অধিকাংশ নারীরাই পেনছি ব্যবহার করে না। এ ছাড়া বিয়েতে অলংকার হিসেবে তারা গলার মালা, কানসি, ঝুমকা, ফুটকি (নাকের ফুল), ঘড়কে পেনজাল (পায়ের নূপুর) প্রভৃতি ব্যবহার করে।

বিয়েতে কড়ারা রাতভর গান গায় ও ঝুমুর নাচে। তেমনি একটি বিয়ের গান—

কাহাকে কে হেকো বেরিয়া রাজা

উতার আলো বরা তারে

বিনিকুড়ি হেকে বেরিয়া রাজা

উতার আলো বরা তারে।

কড়াদের বিয়েতে কনে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন আবার কনেপক্ষ বরের বাড়িতে যায়। এ সময় তাদেরও আপ্যায়ন করা হয় হাড়িয়া, মাছ, মাংস আর ভাত দিয়ে। অতঃপর কনে ও বরকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কড়ারা একে বাহারোতা বলে থাকে।

কড়া আদিবাসী সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশায় কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশায় ধরা পড়লে মাহাতো বা পাঁড়ে গড়াৎকে দিয়ে গোত্রের সবাইকে ডেকে প্রথমে বেটকি বা সভা করে। বেটকিতেই শাস্তি নির্ধারিত হয়। সাধারণত এ ধরনের অপরাধে ছেলের জুজুরী (লিঙ্গে)-তে দড়ি বেঁধে লাঠি দিয়ে ডাং (টান দেওয়া) দেওয়া হয়। আর মেয়ের দুই হাত বেঁধে গায়ে পানি ঢেলে কুলা দিয়ে চারপাশ থেকে বাতাস দেওয়া হয় ঠান্ডা লাগানোর জন্য। তবে এমন শাস্তির বিধান এখন তেমন প্রচলন নেই।

কড়া আদিবাসীদের বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হলে বা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটার রীতি রয়েছে। কড়ারা একে বলে বিহা ভাইঙ গেল। ঘটলে উভয় পক্ষের মাহাতো ও দশজনের উপস্থিতিতে পালন করতে বিশেষ ধরনের আচার। কড়ারা এটিকে পাতপানি বলে। একটি কাসার বাটিতে পানি নিয়ে চার/পাঁচটি আমপাতাসহ একটি ভাঙা ডাল ডুবিয়ে রাখতে হয়। অতঃপর কাঁসার বাটির দুদিকে দাঁড়িয়ে স্বামী ও স্ত্রী দুটি পাতা ধরে। এ সময় দুই পক্ষের মাহাতো প্রথম দুজনকেই তিনবার করে জানতে চায় তারা একসঙ্গে সংসার করতে চায় কি না? তারা না-সূচক জবাব দিলেই স্বামী-স্ত্রী একই সঙ্গে টেনে পাতা ছিঁড়ে ফেলে। মূলত পাতারূপে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই ছিঁড়ে ফেলা বলে মনে করে কড়ারা। প্রথা অনুসারে তাই পাতা ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিবাহের বিচ্ছেদ ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

কড়াদের বিয়ের আদি রেওয়াজগুলো এখন কেমন চলছে? এমন প্রশ্নে গ্রামপ্রধান জগেন কড়া আক্ষেপের সুরে একটি উদাহরণ টেনে বলেন—কয়েক বছর আগ থেকেই কড়া আদিবাসী সমাজে নিজ গোত্রে কনে না থাকায় এখন শুধু একই গোত্রেই নয়, বরং ছেলেদের বিয়ে করানো হচ্ছে অন্য জাতির আদিবাসীদের সঙ্গে। কড়া সমাজে এখন মেয়ের অভাব। তাই প্রশান্ত কড়া বিয়ে করেছেন পাশের মুণ্ডা পাহান গ্রামের শেফালিকে। একইভাবে কেদু কড়া তুরি পাড়ার মিনাকে, মানিক কড়া ভুনজার পাড়ার কাজলি ও খেরচা কড়া ভুনজার পাড়ার বানারশিকে বিয়ে করেছে। এর ফলে কড়া আদিবাসী সমাজে বিয়ে সংস্কৃতি ও আচারগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

তবে জগেনসহ কড়া পাড়ার আদিবাসীরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছেন—অন্য জাতির মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে হলেও কড়া আদিবাসী বিয়েতে এরা কড়া জাতির বিয়ের আদি রীতিই পালন করে থাকেন। ফলে যত দিন কড়ারা টিকে থাকবে, তত দিনই টিকে থাকবে তাদের বিয়ের আদিরীতি ও সংস্কৃতি।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৪ জুলাই ২০১৭

© 2017 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button