গারোদের আদি বিয়ে (দ্বিতীয় পর্)
গারোদের বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে থাকে। এ আদিবাসী সমাজে প্রচলিত বিয়ের পদ্ধতিগুলোর মধ্যে দোদক্কা বা দো-সিয়া, থুনাপা, সেক্য়া, দকচাপা বা অন্চাপা, নকপান্থে গাআ, চাআ সেংআ, চাদিলা, চামে জিকআ, জিকগিত্তে রাআ, নক্রম সাললা উল্লেখযোগ্য।
গারোদের বিয়ের সব পদ্ধতির মধ্যে দোদক্কা বা দো-সিয়া অধিক প্রচলিত। দো অর্থ মোরগ বা মুরগি আর দক্কা ও সিয়া অর্থ আঘাত বা হত্যা করা। এ বিয়ে রীতিতে বাগদানবদ্ধ দল প্রথমে কনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। সেখানে সবার উপস্থিতি কামাল বা পুরোহিত একটি মোরগ ও একটি মুরগিকে সামনে এনে ধান ছিটিয়ে খেতে দেয়। যদি মোরগ ও মুরগি একত্রে ধান খেতে থাকে, তবে এ দম্পতির জীবন সুখের হবে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর যদি একটি খায় অপরটি না খায়, তবে ধরে নেওয়া হয় এ দম্পতির জীবনে কলহ থাকবে। এরপর কামাল ধূপ জ্বালিয়ে দুর্বা ঘাস ছিটিয়ে মোরগের পা বা পাখা দিয়ে বরের পিঠে ও মুরগিটি দিয়ে কনের পিঠে আঘাত করে তাদের বিয়ের ঘোষণা দেন এবং আশীর্বাদ করেন। অতঃপর মোরগটি ছেলের জন্য ও মুরগিটি মেয়ের জন্য উৎসর্গ করা হয়। কামাল মোরগ-মুরগির মাথা একত্রিত করে একটি কাঠের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন। মৃত্যুর পর মোরগের ঠোঁট মুরগির দিকে এবং মুরগির ঠোঁট মোরগের দিকে থাকলে দম্পতির ভবিষ্যৎ শুভ হবে বলে ধরে নেওয়া হয়।
আবার আবেং সম্প্রদায়ের গারোরা আরেকটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে কামাল বা পুরোহিত নবদম্পতির ভবিষ্যৎ শুভাশুভ নির্ণয় করে থাকেন। একে দো-বুক-নিয়া বলে। দো-বুক অর্থ মোরগের অণ্ডকোষ নিয়ে মেপে দেখা। এ পদ্ধতিতে কামাল একটি মোরগ বধ করে পেট কেটে ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যমা ঢুকিয়ে অকোষ দুটি বের করে আনে। যদি অণ্ডকোষ দুটি সমান হয়, তবে ধরে নেওয়া হয়, নবদম্পতির ভবিষ্যৎ সুখময় হবে। আর যদি অসম হয়, তবে তাদের জীবন দুঃখময় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার মোরগটির খাদ্যনালিতে যদি খাদ্য ভর্তি থাকে, তবে গারোরা বিশ্বাস করে ওই নবদম্পতির ভবিষ্যৎ ধন-ধান্যে পূর্ণ হবে।
থুনাপা শব্দের অর্থ হলো গোপনে প্রবেশ করে শুয়ে পড়া। এ পদ্ধতিতে ছেলে বা মেয়ে যাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক, গোপনে তার শয্যায় গিয়ে তার সঙ্গে শয়ন করে এবং যৌনকাজে লিপ্ত হয়। বর-কনের ইচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটি হয়ে থাকে। এতে অভিভাবকের পছন্দের গুরুত্ব থাকে না। এটিকে এক কাঁথায় ঘুমানো বা নাপপে থুয়া বা নাপগ্রিকে থুয়া বা থুনাপা বলা হয়। এর ফলে উভয় পক্ষের কারো কোনো আপত্তি না থাকলে বিয়ে হয়ে যায়। আর সম্মতি না থাকলে ছেলেমেয়েকে আলাদা করে দেওয়া হয় বিশেষ সালিশের মাধ্যমে। এটিকে বলা হয় সালসেকা।
গারো ভাষার সেক্আ শব্দের বাংলা অর্থ হলো হরণ করা। এ ধরনের বিয়ে পদ্ধতিতে ছেলেমেয়ে পরস্পরকে ভালোবেসে গোপনে অন্যত্র চলে যায় এবং স্বামী-স্ত্রীরূপে বসবাস করে। বিবাহিতদের মধ্যেও এমনটা ঘটে থাকে। যদি অবিবাহিতদের মধ্যে এটি ঘটে তবে আখিমের (আইন) মাধ্যমে ছেলেমেয়েকে পতি ও পত্নীরূপে বসবাস করতে দেওয়া হয়। আবার অনেক সময় তাদের বলপূর্বক পৃথক করে শাস্তিও দেওয়া হয়। প্রাচীনকালে গারো সমাজে এরূপ পলায়ন পূর্বক বিয়ে ঘটলে উভয়কেই হত্যা করা হতো।
দকচাপা বা অন্চাপা এর বাংলা অর্থ সপত্নী গ্রহণ। গারোদের এ বিয়ে প্রথায় একজন পুরুষ একজন বিধবা বৃদ্ধা ও একজন যুবতীকে এক সঙ্গে বিয়ে করে। প্রায় ক্ষেত্রেই যুবতী বিধবার পূর্ব স্বামীর ঔরশজাত কন্যা হয়ে থাকে। যৌন সংসর্গে মা ও মেয়ে উভয়েই সমান অধিকার ভোগ করে। বিয়ের এ পদ্ধতিকে দকচাপা বা অন্চাপা বিয়ে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ স্ত্রী সম্পদ ও সম্পত্তির অধিকারী হয়ে থাকে। তার মৃত্যুর পর কন্যার কাছে সম্পত্তির সে অধিকার চলে যায়। সাধারণত বিধবা বৃদ্ধার কোনো কন্যা না থাকলে বিধবা বৃদ্ধার কোনো নিকট আত্মীয়াকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
গারোদের নকপান্থে গাআ বিয়ের পদ্ধতিটি অনেকটা থুনাফা পদ্ধতির মতো। নকপান্থে গাআ শব্দটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায়—অবিবাহিত যুবকের গৃহে প্রবেশ। গারো সমাজে অবিবাহিত যুবকরা আদিতে নকপান্থে রাত্রিযাপন করত। কোনো উৎসব ছাড়া সেখানে মেয়েদের প্রবেশাধিকার ছিল না। সে সময় কোনো মেয়ের যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ হতো, তবে সে তাকে নকপান্থে গিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা জানানো এবং যেখানে ছেলেটি ঘুমাত সেখানেই অবস্থান করত। ছেলেটির যদি মেয়েটিকে পছন্দ হয়, তবে পরদিনই ছেলেটি মেয়ের বাড়িতে চলে যায় এবং স্বামী-স্ত্রীরূপে একসাথে বসবাস শুরু করে। তবে এ ক্ষেত্রে মেয়ের মা-বাবার সম্মতি না থাকলে ছেলেটিকে তারা তাড়িয়েও দিতে পারে। যদি উভয়ের মধ্যে কোনো যৌন সম্পর্ক ঘটে থাকে, তবে ছেলের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করারও বিধান আছে গারোদের এ বিয়ে রীতিতে।
গারোদের কয়েকটি সম্প্রদায়ে চাআ সেংআ নামক বিয়েপদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ রীতিতে কোনো মেয়ের যদি কোন ছেলেকে পছন্দ করে, কিন্তু তার পক্ষে প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার মতো আত্মীয়স্বজন না থাকে, তবে মেয়ের পিতামাতাই মেয়েটিকে দিয়ে আসেন ছেলের মা-বোনের কাজে সাহায্য সহযোগিতার জন্য। মেয়ের কাজ ও ব্যবহার দেখে যদি ছেলের মা-বোনের পছন্দ হয় তবে তারা মেয়েটিকে নকপান্থে ছেলেটির জন্য খাবার নিয়ে যেতে বলে। সেখানে গিয়ে ছেলে ও মেয়েটিকে একই পাতে খেতে হয়। ছেলে যদি এতে রাজি না হয় তবে তার মা-বোনেরা মেয়ের পক্ষে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অনেক সময় এই নিয়মে ছেলে বিয়েতে রাজি হতে এক বছর বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। বিয়ের এই প্রথাতে ছেলেটির মেয়েটিকে বিয়ে করবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। তবে ছেলেটি বিয়েতে রাজি হলে দোদক্কা নিয়মে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়।
গারো সমাজের মাৎচি সম্প্রদায়ের মধ্যে চাদিলা পদ্ধতির বিয়ের প্রচলন রয়েছে। এ বিয়েতে কোনো মেয়ে যদি কোনো ছেলেকে পছন্দ করে, তবে সে তার বোন বা অন্য কোনো মহিলা আত্মীয়কে দিয়ে নকপান্থে ছেলেটির জন্য খাবার পাঠায় এবং তাদের অনুসরণ করে মেয়েটি লুকিয়ে থাকে। যদি ওই ছেলেটি মেয়েটির পাঠানো খাবার খেতে শুরু করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি উপস্থিত হয়ে ছেলেটির সঙ্গে একসঙ্গে খেতে বসে। ছেলেটি খেতে না চাইলে মেয়েটি রাত অবধি অপেক্ষা করে। রাতে ছেলেটির শোয়ার জায়গায় সে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই ওই রাত থেকে তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি পায়। যদি মেয়েটিকে অপছন্দ হয়, তবে ছেলেটিকে কিছুদিনের জন্য গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যেতে হয়।
আদিকাল থেকেই ওয়ানগালাসহ নির্দিষ্ট বড় বড় সামাজিক উৎসবে গারো ছেলেমেয়েদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। এ সময় তারা একসঙ্গে নাচ-গান করত। পরস্পরকে পছন্দ হলে তারা একে অপরের মতামত জেনে নিত এবং প্রেম নিবেদন করত। এভাবে একসঙ্গে তারা নাচ-গান আর মদ পান করে সারা রাত কাটিয়ে দিত। একসময় ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়লে মেয়েটি ছেলের খথুপ বা কাপড় নিয়ে নকমার কাছে তুলে দিয়ে নিজের বিয়ের পছন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটাত। পরে উভয়পক্ষ মিলে বিশেষ দিনে দোদক্কা পদ্ধতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করত। গারোরা বিয়ের এ পদ্ধতিকে বলে চামে জিকআ।
যখন কোনো স্বামীর স্ত্রী অত্যন্ত বৃদ্ধাবস্থায় অথবা কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত, যৌন কর্মাদি সম্পন্নে অসমর্থ হয়, নিঃসন্তান, সেই স্বামী-স্ত্রীর মাহারীর কাছে অতিরিক্ত স্ত্রী দাবি করতে পারে। ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীর কথা চিন্তা করে যদি প্রথমা স্ত্রী তার স্বামীকে দ্বিতীয় স্ত্রী নেওয়ার অনুমতি দেয়, তবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে অবশ্যই প্রথম স্ত্রীর পরিবারের বা বংশের মধ্যে হতে হয়। এভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণকেই জিকগিত্তে রায়া বলা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমা স্ত্রীই পরিবারের প্রধান হিসেবে সমুদয় কাজকর্ম ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী থাকেন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৩ আগস্ট ২০১৭
© 2017 – 2018, https:.