গারোদের আদি বিয়ে (শেষ পর্ব)
গারো সমাজে নক্রম সাললা পদ্ধতির বিয়ের প্রচলন রয়েছে। এ পদ্ধতিতে মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে যখন মামাতো ভাই বা কোনো ছেলেকে যদি তার পছন্দ হয়, তখন সে তা আত্মীয়স্বজন ও বাবা-মায়ের কাছে তার মনের কথা খুলে বলে। তারা তার আগ্রহের কথা জানার পর সেই ছেলেটির ওপর গোপনে নজর রাখতে থাকে। সুযোগমতো ছেলেটিকে পেলেই মেয়ের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসী ছেলেটিকে পাকড়াও করে নিয়ে মেয়েটির ঘরে বন্দি করে রাখে। রাত্রে উভয়কে এরা একত্রে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু খুব কম সংখ্যক ছেলেই প্রথম রাতেই মেয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। যদি ছেলেটি মেয়েটিকে পছন্দ না করে তবে তার প্রকাশস্বরূপ সে ওই রাতেই মেয়েটির ঘর থেকে পালিয়ে যায়। পুনরায় তাকে ধরে আনা হয়। ছেলেটি যদি দ্বিতীয় রাতেও পলায়ন করে তবে তাকে আবার ধরে আনা হয়। তৃতীয় রাতেও ছেলেটি পালিয়ে গেলে ধরে নেওয়া হয় সত্যিকারভাবেই বিয়েতে তার মত নেই।
মেয়েপক্ষ তখন নিরুপায় হয়ে সালিসের আশ্রয় নেয়। সালিসের নিয়মানুসারে নির্দিষ্ট দিনে ছেলেপক্ষের লোকেরা হাজির হয় মেয়ের বাড়িতে। বিচারে সবার সামনে ছেলে ও মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হয় তাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কি না। যদি তাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক ঘটে থাকে তবে সালিসে ছেলেটিকে জরিমানা করা হয়। ছেলেপক্ষ ওই জরিমানা দিতে বাধ্য থাকে। ওই জরিমানার টাকার কিছু অংশ মেয়ের বাবা-মা ও বাকি অংশ আকিং নক্মা বা গ্রামপ্রধান ও অন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। এই আনুষ্ঠানিকতার পর মেয়েটিকে সব ধরনের কলঙ্ক থেকে মুক্ত হিসেবে ধরা হয়। গারো সমাজে বিয়ের ব্যর্থতার জন্য মেয়েটিকে কোনো সামাজিক বঞ্চনার শিকার হতে হয় না। দশজন কুমারী মেয়ের মতোই সমাজে সে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বসবাসরত গারোদের মাঝে একসময় ঠ্যাং ধরা বিয়ে নামক এক ধরনের বিয়ের প্রচলন ছিল। কনে খুব ছোট থাকা অবস্থায় এ ধরনের বিয়ের অনুষ্ঠান করা হতো। বিয়ের দিন কনের মা কনেকে কোলে নিয়ে বিয়ের কুটিরে বসত। বর এসে গ্রাম্য মোড়ল ও আত্মীয়স্বজনের সামনে কনের মায়ের ঠ্যাং বা পা ধরে বিবাহের স্বীকৃতি দিত এবং শাশুড়িকে নববধূসহ নিজ গৃহে যেতে অনুরোধ করত। মেয়ে বড় না হওয়া পর্যন্ত তার মা-বাবা তার রক্ষণাবেক্ষণ করত। এমনকি মেয়েসহ মাতা জামাতার বাড়িতে অবস্থান করত। সহায়-সম্পত্তির মালিকানা নির্ণয় কিংবা সমাজের আত্মমর্যাদা লাভের জন্য আদিবাসী সমাজে একসময় এ ধরনের বাল্যবিবাহের প্রচলন ছিল। যদি কোনো বাবার একমাত্র মেয়ে থাকে এবং যদি তার শরিকদের সে সম্পত্তি ভোগদখল করার সম্ভাবনা থাকে; তবে সে ক্ষেত্রে মেয়েকে এ ধরনের বিয়ে দেওয়া হতো। যাতে করে সম্পত্তির মালিকানা একমাত্র মেয়ে ও জামাতাই হতে পারে। তবে বর্তমানে এ ধরনের বিয়ে তেমন দেখা যায় না।
এ ছাড়া গারোদের মাঝে শাশুড়ি বিয়ের প্রচলন ছিল। এটি নক্রমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঘরজামাই যে পরিবারের ভাবী উত্তরাধিকারিণীকে বিয়ে করে, তাকেই নক্রম বলা হয়। যখন শাশুড়ি আইনত পরিবারের সম্পত্তির মালিক, শ্বশুরের মৃত্যুর পর নক্রম তাকে বিয়েপূর্বক পরিবারের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করত।
গারোরা বিয়েতে অলংকার হিসেবে দাংগা সরা, রেপ্পা সরা, কক্কা শীল, সিক্কী সরা, সাংগোং, নাকেন্টা, ডোমি প্রভৃতি ব্যবহার করে থাকে। এরা সব সামাজিক উৎসব, ধর্মীয় আচার ও অতিথি আপ্যায়নে ধেনো পচুই মদ বা চু প্রিয় পানীয় হিসেবে ব্যবহার করে। গারো মহিলারা বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে এই মদ তৈরি করে। এ ছাড়া বিয়ে উৎসবে ভাত ও শূকরের মাংস খাওয়ানো হয়।
একসময় গারো যুবকরা প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই ওঝার আশ্রয় নিত। ওঝা যুবককে যুবতীর মাথার চুল, গায়ের ময়লা, নখের মাথা ইত্যাদি সংগ্রহ করতে বলত। যুবক তা সংগ্রহ করে আনলে ওঝা সাতটি বা পাঁচটি বড়শির মাথা ওই জিনিসগুলোর সঙ্গে একত্র করে তাবিজের মধ্যে ভরে চুলার পাড়ে বা যুবতীর শোয়ার ঘরের দরজার নিচে পুঁতে রাখার নির্দেশ দিতেন। চুলার পাড়ে তাবিজ রাখলে যুবকের প্রেমে যুবতী উন্মত্ত হবে এবং তার শরীরে জ্বালা ধরবে বলে মনে করা হতো। আর দরজার নিচে পুঁতে রাখলে যুবতী দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় পুঁতে রাখা স্থানে পা পড়লেই ওই যুবককে ছাড়া সে একমুহূর্তও থাকতে পারবে না বলে গারোরা বিশ্বাস করত।
গারো সমাজে অবৈধ যৌন সম্পর্কে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী একে অন্যজনকে যদি ব্যভিচারী বা ব্যভিচারিণী সন্দেহ করে বা গোপন প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক আছে প্রমাণ করতে পারে তবে দোষীর বিরুদ্ধে সমাজ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত পুরুষের মধ্যে যদি অবৈধ যৌন সম্পর্ক থাকে তবে জরিমানা দিতে হয়। এরূপ যৌন সংসর্গে যদি কোনো মেয়ে গর্ভধারণ করে, তবে ছেলেটিকে বিয়ে এবং সন্তানকে পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করতে হয়। বিয়ে করতে যদি ছেলেটি রাজি না হয় তবে তাকে জরিমানা পরিশোধ করতে হয়। প্রাচীনকালে গারো সমাজে ব্যভিচারিণীর স্বামী তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রী প্রেমিককে ব্যভিচারে লিপ্ত অবস্থায় ধরতে পারলে উভয়কেই হত্যা করা হতো। শুধু তাই নয়, ব্যভিচারের উদ্দেশে ঘরে প্রবেশকারীকে ওই ঘরের মালিকও হত্যা করতে পারত। গারো ভাষায় একে নকচামাল-আ বলা হতো।
গারো সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সুযোগ রয়েছে। উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে বিয়ের বাগদান ভঙ্গ করা যায়। কেবল একপক্ষ তা ভঙ্গ করলে, ভঙ্গকারীকে জরিমানা দিতে হয়। স্বামীর অবিশ্বস্ততা প্রমাণিত হলে বা স্ত্রীর অবিশ্বস্ততা স্বামীর কাছে প্রমাণিত হলে দুজনই দুজনকে ত্যাগ করতে পারে। এর জন্য অবশ্যই জরিমানা দিতে হয়। আবার কোনো পক্ষ প্রজননে অক্ষম প্রমাণিত হলেও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। অনেক সময় স্বামী বিয়ে বিচ্ছেদ করতে চাইলে স্ত্রীকে রেখে পলায়ন করে। পরবর্তী সময়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে। আবার স্ত্রী যদি বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে চায় তবে নকমার মাধ্যমে উভয় পক্ষের লোকজন নিয়ে আলোচনা করেই ঘটায়। পলায়নপূর্বক স্ত্রী ত্যাগের জন্য স্বামী আকিম আইনে দণ্ডিত হয়। তবে আকিম আইনে সব সময় মাতৃপ্রধান সমাজ ব্যবস্থাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
গারোদের বিবাহবিচ্ছেদ আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সম্পাদন করা হয়। এ ক্ষেত্রে সবার সামনে কামাল বা পুরোহিতের উপস্থিতিতে বিচ্ছেদে আগ্রহী স্বামী-স্ত্রী উভয়েই হাতে ধূলি নিয়ে মাথায় দিব্যি করে বলে যে, তারা ভবিষ্যতে কোনোদিন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করবে না। পরে কামাল মন্ত্র পাঠ করতে করতে বলসেক্কি গাছকে পৃথিবীর পুত্র চিহ্নিত করে তরবারি বা কুঠার দিয়ে উক্ত গাছটিকে আঘাত করলেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটেছে বলে মনে করা হয়। বিচ্ছেদের এ আচারকে গারো বলসেক্কি ডিনআ বলে।
বাংলাদেশে বসবাসরত গারোদের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে খ্রিস্টান হয়েছে। ফলে খ্রিস্টান রীতি অনুসরণ করেই তারা বিয়ে সম্পন্ন করে। এভাবে ধর্মান্তরের সঙ্গে সঙ্গেই গারো আদিবাসীরা হারিয়ে ফেলছে তাদের পূর্বপুরুষদের আদি সংস্কৃতি আর আচারগুলো। গারোদের কাছে বিয়ের আদি আচারগুলো এখন কুসংস্কার মাত্র। তবু এরা মনে করে, তাদের বৈচিত্র্যময় বিয়ের আদি সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগে গারোদেই এগিয়ে আসতে হবে।
গারো সমাজে প্রথম মানব-মানবীর সঙ্গম কাহিনী : পৃথিবীতে প্রথম মানব-মানবীর সঙ্গমরীতি নিয়ে গারো সমাজে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। কাহিনীর ভাবার্থ :
ভগবান তাতারা রাবুগা পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। কিন্তু সেখানে কে থাকবে?
তিনি খুব যত্ন করে মানব-মানবী সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠালেন। মানবের নাম শনি ও মানবী হচ্ছে মুনি। শুরুতে শনি ও মুনি ছিল পরস্পর ভাই-বোন। ভাগবান তাদের পরীক্ষার জন্য দুজনকে দুই দেশে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেন। একজন রইল তুরা পর্বতে আর একজন নীলগিরি পর্বতে। দীর্ঘ বারো বছর পর তারা আবার একত্র হলো। কিন্তু একজন অপরজনকে চিনতে পারল না।
শনি নারী মুনিকে বলল- তুমি কে?
মুনি উত্তর দিল— আমি তোমার স্ত্রী।
সে থেকে তারা পরস্পর স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হলো।
এভাবে দীর্ঘদিন কেটে গেল। ক্রমে ক্রমে তারা বৃদ্ধ ও বৃদ্ধায় পরিণত হলো। অথচ যৌন মিলনের পদ্ধতি তাদের কাছে তখনো অজ্ঞাত।
ভগবান স্বপ্নে তাদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা পরস্পর একত্র হও, নইলে পৃথিবীতে মানবজাতির উদ্ভব ঘটবে না।
কিন্তু কীভাবে একত্র হবে?
কোনো পদ্ধতিই যে তাদের জানা নেই।
হঠাৎ একবার খুব বৃষ্টি হলো। বৃষ্টিতে সব জলমগ্ন হয়ে গেল। তখন শনি ও মুনি দেখল একজোড়া ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমী কেমন মিলিত হয়ে আছে। ওরা ঠিক মানবসদৃশ যৌন ক্রিয়া-পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিল।
তা দেখে শনি ও মুনি অনুরূপভাবে প্রথম একত্র হলো। গারোরা বিশ্বাস করে এভাবেই মানব-মানবীর সঙ্গমের মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির বিস্তৃতি ঘটতে থাকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৬ আগস্ট ২০১৭
© 2017 – 2018, https:.