পাখিগ্রাম ভাটিনা
‘সমিতির সভাপতি একরামুল প্রস্তাব করেন গোটা গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। প্রথমেই পাখি না মারার প্রস্তাবে সম্মতি দেন হাশেম তালুকদার নিজেই। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যেস ত্যাগ করে ছুড়ে ফেলেন নিজের এয়ার গান আর বন্দুকটিকে। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় অন্যরাও অনুসরণ করে তাকে।’
দিনাজপুরে হাতেগোনা যে কয়টি আদি হিন্দু পরিবার রয়েছে, পুলক বাবুরা তাদের মধ্যে একটি। কিন্তু পুলকও জানাতে পারল না ভাটিনা গ্রামটির রহস্য।
রহস্য জানার আগ্রহ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভাটিনার উদ্দেশে। সঙ্গী হলেন তারুণ্যদৃপ্ত রায়হান। দিনাজপুরের রাজবাড়ীকে পেছনে ফেলে অল্প সময়ে পৌঁছে গেলাম উঁচু বাঁধের ওপর। পাশেই গা ছমছম করা শ্মশান। দূরে কালী পূজার মেলা বসেছে। বাঁধের দুই পাশে কোনো পানির দেখা মিলল না। চারদিকে শুধুই ধানক্ষেত। দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে গানের আওয়াজ-‘ডাক দিয়াছে দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন, তোদের মাজারে।’
হঠাৎ আমাদের রাস্তা নেমে গেল বাঁধ বেয়ে একেবারে ধানক্ষেতের পথে। ধূসর সবুজ ধান গাছে থোকা থোকা কাঁচা ধান ঝুলছে। খানিকটা যেতেই পানির বাধা পড়ল। গ্রামের লোকেরা পানি পার হচ্ছে খেয়া নৌকা দিয়ে। খেয়ার মাঝি জানায়, এটি গর্ভেশ্বরী নদী। চর পড়ে নদীটি মৃত হলেও এক সময় এর গর্ভ স্পর্শ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বর্ষা মৌসুমে চলত নদীর ভাঙাগড়ার খেলা। এ কারণেই শহরের চারদিকে তৈরি করা হয়েছে বাঁধ। খেয়ার ওপারে নদীর তীর ঘেঁষা চওড়া রাস্তা। চারপাশে সারি সারি লিচু গাছ। লোক বসতি বেশ কম। রাস্তায় মাঝে মাঝেই হুমড়ি খেয়ে পড়তে হলো গ্রাম্য মাটির উঁচু বাধায়। বিরক্ত মুখে কিছু দূর যেতেই এক কৃষক দেখিয়ে দিল ভাটিনা গ্রামের মেঠো পথটি। ঢুকতেই থমকে দাঁড়ালাম। বড় একটি সাইন বোর্ডে লেখা ‘পাখি সংরক্ষিত এলাকা’ পাখি মারা নিষেধ’।
আমরা ঢুকে পড়লাম গ্রামটিতে। ভাটিনার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়ার মতো বাঁশঝার। সারা গ্রামেই রয়েছে ছোট ছোট পুকুর। পুকুরগুলো বাঁশ আর আম গাছে ঘেরা। এ ছাড়া চারদিকে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত। একটি বড় পুকুর পেরিয়ে যতই এগুচ্ছি ততই শত শত পাখির চিৎকারের শব্দ স্পষ্ট হচ্ছে। সামনে আসতেই আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। একটি বাঁশবাগানের প্রায় প্রতিটি ডালেই দেখা গেল নানা জাতের শত শত পাখি। মনের আনন্দে সকলেই চেঁচাচ্ছে। এ যেন পাখির মহামিলন স্থল। মনের ভেতর এক অন্যরকম ভালোলাগা টের পেলাম। এ এক অন্যরকম মন জুড়ানো দৃশ্য। অন্য পাশের আরেকটি বাঁশঝাড়ে বসেছে অজস্র বক আকৃতির কালো পানকৌড়ি। চোখের সামনেই কয়েকটি পানকৌড়ি পানিতে ডুবে ঠোঁট দিয়ে ধরে আনল বেশ কয়েকটি মাছ। একটি দেশি শালিককে দেখা গেল বড় একটি পানকৌড়িকে ঠোকর দিতে পিছু নিয়েছে। এত পাখি দেখে আমরা নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। দেখার আনন্দে ছটফট করতে লাগলাম। একটি ছোট্ট পুকুরের চারদিকের গাছগুলোতে অজস্র বক আকৃতির এক ধরনের বাদামি রঙের পাখি দেখা গেল। চোখ বন্ধ করে বেশ আয়েশী কায়দায় শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে তারা। পেছন থেকে একজন জানাল, এরা রাতচোরা। হয়ত এ কারণে চোরদের মতো দিনে ঘুমাচ্ছে। পাখি ওড়াতে একজন বিশেষ কায়দায় শব্দ করতেই বিস্ময়কর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। হাজার হাজার পাখি গাছ থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে ছুটে চলল। মনেই হয়নি গাছগুলোতে এত পাখি ছিল। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। মাথার ওপর আকাশের সব খানেই হাজার হাজার পাখি উড়ছে। মনে হচ্ছে ক্রমেই আকাশ থেকে পাখিদের একটি বড় জাল আমাদের ঢেকে দেবে। ভাটিনা গ্রামের লোকেরা এ রকম মন জুড়ানো দৃশ্য দেখছে প্রতিদিন। শত শত পানকৌড়ি, সাদা বক, কুনি বক, গুটকল, রাতচোরা, ঘুঘু, শালিক, টিয়া আর ময়নার ভয়হীন অবাধ আনাগোনা চলে গ্রামটিতে। কাদের মহতি উদ্যোগে তৈরি হয়েছে পাখিদের এমন প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য। স্থানীয় লোকেরা এক বাক্যে জানাল আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতির কথা।
১৯৯৬ সাল। ভাটিনা গ্রামের লোকেরা তখন ছিল খানিকটা শিক্ষাবিমুখ। আর্থিক দৈন্য এর প্রধান কারণ। পরিবেশগত কারণে গোটা গ্রামেই ছিল পাখির আনাগোনা। ফাঁদ পেতে বক ও পাখি ধরাই ছিল গ্রামবাসীর দৈনন্দিন ব্যাপার। এ ছাড়া গ্রামটিতে বিত্তশালীদের এয়ার গান আর বন্দুকের শব্দ চলত প্রায় সারাদিন। দিন শেষে একঝাঁক মৃত পাখির দেহ ঝুলতে থাকত শিকারিদের মোটরসাইকেলে।
গ্রামের কলেজ পড়ুয়া একরামুল হক থাকেন খালার বাড়িতে। নিজেদের ভাগ্য গড়া আর গ্রামের জন্য কাজ করার স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন যুবকদের মাঝে। অল্প সময়ে তৈরি হয় আলোর ভুবন যুব সমবায় সমিতিটি। প্রথমে ২৫টি পরিবার থেকে শিক্ষাবৃত্তির জন্য প্রতিসপ্তাহে সংগ্রহ করা হয় ১ টাকা করে। তার সঙ্গে অন্য সদস্যদের সঞ্চয় দিয়ে চলে শিক্ষা কার্যক্রম। যুবকদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় মেম্বার ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা হাশেম তালুকদার। মূলত হাশেম তালুকদারের সম্পৃক্ততার কারণেই সমিতিটি সহজেই গোটা গ্রামে আলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। অল্প সময়েই আলোর ভুবন সমিতি মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। কয়েক মাস কেটে গেলে সমিতির সভাপতি একরামুল প্রস্তাব করেন গোটা গ্রামটিতে পাখির অভয়ারণ্য তৈরি করার। প্রথমেই পাখি না মারার প্রস্তাবে সম্মতি দেন হাশেম তালুকদার নিজেই। পাখি মারার দীর্ঘদিনের অভ্যেস ত্যাগ করে ছুড়ে ফেলেন নিজের এয়ার গান আর বন্দুকটিকে। গ্রামের প্রভাবশালী হওয়ায় অন্যরাও অনুসরণ করে তাকে। গোটা গ্রামবাসী মেতে ওঠে পাখিপ্রেমে। পরিকল্পনা মোতাবেক ভাটিনায় ঢোকার ৩টি প্রবেশমুখে টাঙিয়ে দেয়া হয় পাখি মারা নিষেধ লিখিত বড় সাইন বোর্ড। গ্রামবাসীর ভালোবাসায় ক্রমেই ভাটিনা পরিচিত হয়ে ওঠে পাখিগ্রাম হিসেবে।
এভাবেই কেটে যায় ১৩ বছর। দিনাজপুর শহরে থাকা ইমরান জানায় নিজের অভিজ্ঞতার কথা। একবার সাইন বোর্ডের নির্দেশকে উপেক্ষা করে পাখি মারতে ইমরান ঢোকে ভাটিনা গ্রামে। পাখি মারার অপরাধে গ্রামের ছোট ছেলে-মেয়ে ও মহিলারাসহ সকলেই তাকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে। পাখি না মারার প্রতিশ্র“তি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পায় সে। এরপর থেকে ইমরান আর পাখি শিকার করে না। পেছনের কথা মনে হলে পাখি হত্যার অপরাধে আজও তিনি লজ্জিত হন।
ভাটিনা গ্রামটি সারা বছরই থাকে নানা ফসলে ভরপুর। টমেটো আবাদ হয় শত শত একর জমিতে। টমেটো চাষি মনসুর জানায়, সাধারণত টমেটো ক্ষেতে পোকার উপদ্রব এত বেশি হয় যে কীটনাশক ছিটিয়েও তা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। কিন্ত ভাটিনা গ্রামের শত শত পাখি ঐ সব পোকা খেয়ে ফেলে। ফলে কীটনাশক ছাড়াই পোকা দমন হয়। এ কারণে এখানকার কৃষকরা টমেটো ক্ষেতে বাঁশের কঞ্চি গেড়ে পাখিদের বসার বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখে। তা ছাড়া পাখি থাকার কারণে ধানক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ নেই বললেই চলে।
আলোর ভুবন সমিতির বর্তমান পরিকল্পনার কথা জানায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম। পাখিদের খাদ্যের কথা চিন্তা করে ইতোমধ্যে সমিতির উদ্যোগে গ্রামের রাস্তার পাশে লাগানো হয়েছে প্রায় ৩০০টি বট ও পাকুড় গাছ। এ ছাড়া অন্যান্য গ্রামেও পাখি মারা বন্ধ করতে সমিতি প্রতি শুক্রবার মসজিদে মসজিদে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ৫টি পুকুর নিয়ে মাছ চাষ প্রকল্প এবং একটি লেয়ার মুরগির ফার্মসহ বিভিন্ন আয় বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প থাকলেও সমিতির সদস্যরা মনে করে পাখি রক্ষার উদ্যোগটিই তাদের ব্যাপক পরিচিতি ঘটিয়েছে, করেছে সম্মানিত।
ঝড়ের পর পরই ভাটিনাবাসী বেরিয়ে পড়ে কুলা হাতে। খুঁজে খুঁজে বের করে ঝড়ে আহত পাখিগুলোকে। সাধ্যমতো চিকিৎসা করে ছেড়ে দেয় তাদের গন্তব্যে। পাখিদের সঙ্গে রয়েছে গ্রামবাসীর নাড়ির টান। পাখি রক্ষার নায়ক একরামুলের স্বপ্ন এক সময় ভাটিনাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে পাখি মারা নিষেধ সংশ্লিষ্ট সব সাইন বোর্ড উঠে যাবে। পাখির মতো একটি প্রাণীকে হত্যা করার কথা কারো চিন্তায়ও আসবে না। ছোট শিশুরা বেড়ে উঠবে পাখিদের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। পুঁথিগত শিক্ষা না পৌঁছালেও জীবের প্রতি দয়ার মহত্ব নিয়ে বেড়ে উঠবে শিশুরা। সকলের মনে পাখির প্রতি থাকবে মমতাবোধ ও ভালোবাসা।
ভাটিনা গ্রামে এখন আর কোনো বন্দুকের শব্দ নেই। নেই কোনো পাখি হত্যাকারীদের আনাগোনা। সকাল-সন্ধ্যা গোটা গ্রামে চলে পাখিদের অবাধ আনন্দ চিৎকার। ছুটির দিনে আশপাশের শত শত পাখিপ্রেমীর পদধূলিতে ধন্য হয় গ্রামটি। অনেকের কাছে তাই ভাটিনা এখন পাখি গ্রাম।
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৯ অক্টোবর ২০০৯, কালেরকন্ঠে ৮ মার্চ ২০১০
© 2011 – 2018, https:.
Apnake lekhok.com e amontron.
Apnaka dhonobad.
Although Air Gan forbidden for many years, Still innocent Birds are killed most of the part of country. If local people take such kinds of organized initiative then conservation of Endemic birds no longer a riddle.
ur r very much right sumon.thanks.