বীরের দেশে একাত্তরের ফুটবল যোদ্ধাদেরও স্বীকৃতি দিতে হবে
‘ফুটবলের প্রতি প্রবল ঝোক ছোটবেলা থেকেই। আমার মা আর বন্ধু চিত্রর মা বাড়িতে তাদের শাড়ি খুঁজে পেতেন না। সবাই চিন্তিত! শাড়ি কোথায় যায়? আমরা মুখ টিপে হাসতাম। কারণ ওই শাড়ি পেচিয়েই বল বানাতাম। অতঃপর ওই বল খেলতাম সাধনার গলিতে। স্কুল লেবেল থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় ফুটবলার হওয়ার।
সময়টা ১৯৬৭। পলিটিক্সের সঙ্গে ননস্টপ চলছে ফুটবল খেলা। থার্ড ডিভিশনের পর ১৯৬৮ সালে চান্স পাই সেকেন্ড ডিভিশনে, ফরাসগঞ্জ স্পোটিংয়ে। এক বছর পরেই চলে যাই পাকিস্তান স্পোটিং ক্লাবে।
ইকবাল স্পোটিং ক্লাবের সঙ্গে একবার খেলা হয় আমাদের। বিহারী এরফান ছিলেন দলের ক্যাপ্টেন। ওরা মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে আসে স্টপার হিসেবে। তাকে বিট করা কঠিন ব্যাপার। সেমিফাইনাল খেলা। নক আউট ম্যাচ। আমাদেরও ভয় ওই মোহাম্মদ আলীকে। ইয়া বড় তার দেহ। চীনের প্রাচীর যেন! ডিআইটির সামনের গ্রাউন্ডে চলছে খেলা। চারপাশে শত শত লোক। একদিকে বিহারীরা। অন্যদিকে বংশাল, নাজিরা বাজার ও সিদ্দিক বাজারের বাঙালিরা।
হাফ টাইম পর্যন্ত খেলা ‘ড্র’ ছিল। দ্বিতীয়ার্ধের ১৫-২০ মিনিট তখন। কয়েকজনকে ডস করে মোহাম্মদ আলীকে বিট করে আমি গোল দিই। খেলা শেষ হওয়ার ঠিক ১০ মিনিট আগে গোল করি আরেকটা। ওরাও দেয় একটা। কিন্তু ২-১ গোলে হেরে যায়। পিডাব্লিউডির গেইম সেক্রেটারী শামসু ভাই ছিলেন মাঠে। খেলা শেষে আমার হাত ধরে তিনি শুধু বললেন–‘প্যাটেল, তুমি এখন থেকে পিডাব্লিউডিতে।’ মহাখুশি হয়েছিলাম। মাসে বেতন পেতাম ২২৫ টাকা। মাঠের খেলার সঙ্গেই তখন পুরোদমে চালিয়ে যাই রাজনীতিটাও।’
ফুটবল দিয়েই স্মৃতিচারণ শুরু করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেল। এক বিকেলে তাঁর বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।
হাজী আব্দুল মান্নান ও শামসুন্নাহারের মেজ ছেলে প্যাটেল। জন্ম কেরানিগঞ্জের হাসনাবাদে হলেও পাঁচমাস বয়সেই পরিবার চলে আসে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বসতি গড়ে দিননাথ সেন্ট রোড, সাধনা ঔষধালয়ের গলিতে। প্যাটেলের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি গেন্ডারিয়া হাই স্কুলে। তিনি মেট্রিক পাশ করেন ১৯৬৮ সালে। অতঃপর ভর্তি হন কায়েদিআজম কলেজে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী কলেজ)। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র।
পুরান ঢাকার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেন সাইদুর রহমান প্যাটেল। তাঁর ভাষায়–‘গেন্ডারিয়া, সুত্রাপুর ও কোতোয়ালি তখন মুসলিম লীগ অধ্যুষিত এলাকা। নামকরা মুসলীম লীগার ছিলেন খাজা খায়রুদ্দিন, মাজেদ সরদার, সুরুজ মিয়া চেয়ারম্যান, গিয়াসউদ্দিন, হাবিব গুন্ডা, চিকাল উদ্দিন (জিন্না আলাউদ্দিন), ইব্রাহীম চেয়ারম্যান, সিরাজ চেয়ারম্যান, আফতাব মাস্টার, মুসলিম সরদার, সিরাজুল ইসলাম, ইব্রাহীম চেয়ারম্যান, ওসমান সরদার। খুবই প্রভাবশালী ছিল এরা। নিজেদের স্বার্থে তারা গুন্ডাও পালত। সেই গুন্ডাদের দৌরাত্ব ছিল আরও ভয়াবহ। কালু গুন্ডা, আফজাল আর দুই কাচ্চা ছিল নামকরা। রাস্তায় দাড়িয়ে ওরা যারেতারে চড়থাপ্পর মারত। কিছু বলতে গেলেই ছুরি মেরে ভুড়ি বের করে দিত। রিকশাওয়ালারাও মুক্তি পেত না। মাসের শুরুতে সাধনা কোম্পানির শ্রমিকরা চাঁদা না দিয়ে বেতন বাড়িতে নিতে পারত না। মেয়েদেরও প্রকাশ্যে লাঞ্চিত করত ওরা। চোখের সামনে ওদের অত্যাচার দেখেই বড় হয়েছি।’
খেলার সঙ্গে রাজনীতিতেও তার ঝোক ছিল বেশি। রাজনীতির হাতেখড়ি হয় স্কুল জীবনে। ছাত্রলীগে যুক্ত হওয়ার অপরাধে শুরুতেই মুসলীম লীগের গু-াদের হাতে নির্যাতিত হন তিনি। সে ইতিহাস শুনি তাঁর জবানিতে–
‘১৯৬৬ সাল। তখন আমি গেন্ডারিয়া হাই স্কুলে, মেট্রিক পরীক্ষার্থী। একমাত্র গেন্ডারিয়া হাই স্কুলে তখন প্রথম ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়। আমি হলাম স্কুল শাখার সভাপতি। টিচাররা অনেকেই মুসলীম লীগার। তাদের মাধ্যমে ছাত্রলীগের কথা জানতে পারে মুসলিম লীগের গুন্ডারা। ওইদিনই দশ-বারজন ‘ছাত্রলীগ মারাস’ বলে স্কুল গেইটের সামনেই আমার ওপর আক্রমণ চালায়। মার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম। পরে মেনেনজাইটিস হওয়ায় ওইবছর মেট্রিক দিতে পারিনি। কিন্তু তবুও ছাত্রলীগ করা বাদ দিই নাই।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য উর্দু লেখা গাড়ির প্লেট ও দোকানের সাইনবোর্ডে কালো কালি মেরে দিতে হবে। স্কুলের প্রায় শতাধিক ছাত্র মিছিল নিয়ে অংশ নেয় এ কাজে। হঠাৎ সুত্রাপুর থানার তৎকালীন ওসি সালাম সাহেব এসে আমার ওপর চড়াও হয়। লাঠিপেটা করে গাড়িতে তুলে নিতে চায়। তার লাঠির আঘাতে আমার ডান চোখে ক্ষত হয়ে ফুলেও যায়। ছুটে গিয়ে স্কুলের ভেতর আশ্রয় নিই। ফোলা চোখটাতে পানি দিচ্ছিলাম। এ অবস্থা দেখে মুসলিম লীগার শিক্ষকরা অট্টহাসি দিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে–‘কিরে ফ্যাটলা, মানা করছিলাম না ছাত্রলীগ করিস না।’ কথাটা শুনে আর ঠিক থাকতে পারি না। মুখের ওপরই বলে দিয়েছিলাম–‘এক চোখ গেলে তো আরেক চোখ থাকবে। তবুও মুজিবের রাজনীতি ছাড়ব না।’
এ ঘটনায় ওইদিনই জগন্নাথ কলেজে প্রতিবাদ সভা হয়। পরদিন ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘গেন্ডারিয়া স্কুলের ছাত্রদের ওপর সালাম ওসির লাঠি চার্জ।’ এরপরই ছাত্রনেতারা আমাকে নিয়ে যায় শেখ মুজিবের কাছে। গভীর মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি আমাকে সম্বোধন করেছিলেন– ‘আমার সর্দার বল্লব ভাই প্যাটেল।’ শেষ পর্যন্ত ওই নামেই ডেকেছেন। মাঝেমধ্যে তাঁর আঞ্চলিক ভাষায় আদর করে বলতেন–‘আমার মেয়া চাঁন।’ শেখ কামালও ছিল ক্লোজ বন্ধু। নানাবিষয়ে আমাদের শেয়ারিং হতো। আসা-যাওয়াও ছিল নিয়মিত। তা দেখে ওইসময় ঢাকাইয়ারা মজা করে বলতো–‘শেকের তো চাইর পোলা–কামাল, জামাল, রাসেল, প্যাটেল।’
ভিডিও: সত্তরের নির্বাচনে মুসলিম লীগের দুর্গে কীভাবে জিতলেন বঙ্গবন্ধু–জানাচ্ছেন প্যাটেল
পাকিস্তান আমলে একবার ভিক্টোরিয়া পার্কে মিটিং করতে গিয়ে মার খেয়ে ফিরেন শেখ মুজিব। সে স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি প্যাটেলদের বলতেন– ‘ওটা মুসলিম লীগের দুর্গ।’ অথচ সত্তরের নির্বাচনে সেখানেই দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু নিজে। প্রতিপক্ষ ছিলেন মুসলীম লীগের খাজা খায়রুদ্দিন। নির্বাচনে গোটা পাকিস্তানের দৃষ্টি তখন ওই আসনটির দিকে। সে সময় অনেক সাহস আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল প্যাটেলরা।
কীভাবে?
প্যাটেল বলেন– ‘আমরা কি বাংলাদেশ পাব, নাকি পাকিস্তানই থাকবে–সেই রায়টা প্রথম দিয়েছিল সুত্রাপুর-কোতোয়ালির মানুষেরা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। তখন সারাদেশ উত্তাল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। কিন্তু তিনি চিন্তিত ছিলেন তার সিট (তৎকালীন ঢাকা-৮ আসন) নিয়ে।
ধোলাইখাল, ধুপখোলা মাঠ, ফজলুল হক গার্লস কলেজ আর লালকুঠিসহ কয়েকটা জায়গায় নির্বাচনী জনসভা করি আমরা। লালকুঠির মিটিংয়ে নেতা বললেন স্টেজে মাত্র দুটি চেয়ার রাখতে। আমরা তো উদগ্রীব। আরেকটা চেয়ারে কে বসবেন? মিটিংয়ের সময় দেখলাম ফরাসগঞ্জের মালা সরদারের হাত ধরে তিনি এগিয়ে আসছেন। মুসলিম লীগার হয়েও মালা সরদার ওইদিন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ভোট চেয়েছিলেন। রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ছিল সেদিন বুঝেছি।’
নির্বাচনে মুসলীম লীগের গুন্ডাদের ভয় ছিল না?
‘ভয় তো ছিলই। তবুও ঘরে ঘরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ক্যাম্পিং করতাম আমরা। মুসলিম লীগের গু-াদের অত্যাচারের কথা তুলে ধরতাম। সে কারণে তখন মিথ্যা মামলায় বন্ধু সিরুসহ সতেরদিন জেলও খেটেছিলাম। মুসলিম লীগারদের ছিল হিউজ টাকা। বস্তির ভোটই তখন বেশি। তারা বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে টাকা বিলাতো আর কোরআন শপথ করাত। ওরা চলে গেলে রাতে যেতাম আমরা। বলতাম–‘আপনের টাকা আপনেরে দিয়া গেছে, আমাদের শোষণ করা রক্তের টাকা। রাজনীতি আর দেশ নিয়ে কোরআন শপথ হয় না। তাই ভয় নাই। ওই পয়সা তো ওদের না। আপনাদের পয়সা আপনারা নিবেন। কিন্তু ভোট দিবেন নৌকাতে।’ আমাদের কথা মানুষ রেখেছিল। সত্তরের নির্বাচনে মুসলিম লীগের দুর্গেই জিতেছিলেন শেখ মুজিব।’
২৫ মার্চ। মধ্যরাত। পাকিস্তানি সেনারা পাখির মতো মারতে থাকে ঢাকার মানুষকে। প্যাটেলরা তখন লোহারপুলের ওপর ড্রাম, ভাঙ্গা জিনিস, গাছের ডাল দিয়ে ব্যারিকেট তৈরি করে। পাকিস্তানিদের গাড়ি যেন না আসে সে কারণে মনিজার রহমান গার্লস হাই স্কুল ও বাবুল লন্ড্রীর সামনে তৈরি করা হয় বড় গর্ত। গেন্ডারিয়া স্টেশনের শ্রমিকদের নিয়ে তারা জুরাইন ও দয়ালগঞ্জের রেললাইনের কয়েকটা পাতও উপড়ে ফেলে।
অতঃপর কী ঘটল জানান প্যাটেল।
তিনি বলেন– ‘সুত্রাপুর থানার ওসি তখন সিকদার। সেকেন্ড অফিসার সাত্তার খানের মাধ্যমে খবর পাই বাঙালি পুলিশ সদস্যদের আর্মস কেড়ে নিয়ে থানায় বসিয়ে রেখেছেন ওসি। সেনারা তখন সদরঘাটে হত্যা চালিয়ে লালকুটির আর্মির সাব ক্যাম্পে বিশ্রাম নিচ্ছে। খুব কাছেই সুত্রাপুর থানা। তবুও জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করে আমরা ২৭জন থানা আক্রমণ করি। সিরু, আজিজ, মঈন, শাহজাহান, মনু, আবুল, বজলু, মঈনসিনা, দুলাল, দুলু, অজয়, আকবর, বিডিআরের এক সিপাই সঙ্গে ছিলেন। অতঃপর থানা থেকে একটি রিভেলবারসহ ৩১টা রাইফেল নিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসি ধুপখোলা মাঠে। ভোর তখন হয়হয়। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ৫ রাইন্ড গুলি ছুড়ে আত্মগোপনে চলে যাই। এরপরই পাকিস্তানি সেনারা রকেট লাঞ্চার দিয়ে বেরিকেট উড়িয়ে গেন্ডারিয়ায় ঢুকে অত্যাচার চালাতে থাকে। ২৭ তারিখে ওরা গুলি করে হত্যা করে ১৩জনকে। যার মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির দুলালও ছিলেন।’
আপনারা তখনও কি গেন্ডারিয়াতে?
প্যাটেলের উত্তর–‘না। ২৯ মার্চ ১৯৭১। ভোরবেলা। বাসার লেপ ও চাঁদরে অস্ত্রগুলো মুড়িয়ে নিয়ে ঘর ছাড়ি। আরসিন কোম্পানির ঘাট হয়ে চলে যাই নদীর ওপাড়ে। আদম ব্লিডিংয়ে, শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসে। ঢাকা জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তখন লালবাহিনীর মান্নান। আর কর্মচারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট লুৎফর রহমান। মোহসিন সাহেব ট্রেজারার।
সে সময় নাদের আলী নামে এক পাঞ্জাবি ম্যানেজার ছিল ঢাকা জুট মিলে। শ্রমিকরা তার কাছে বেতনের টাকা চাইতে গেলেই সে বলত–‘তেরা মুজিব বাপ দেয়েগা।’ জুটমিলের গুদাম ভরা ছিল রেশন। তবুও তা চাইতে গেলেই বলত– ‘সব কুচ তেরা মুজিব বাপ দেয়েগা।’ শ্রমিকদের মুখে এ খবর পেয়ে আমরা ঠিক থাকতে পারি না। অস্ত্র হাতে ঢুকি জুট মিলে। গোডাউন ইনচার্জ ছিল লতিফ। তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে রাত পর্যন্ত শ্রমিকদের মধ্যে রেশন বিলি করি। অতঃপর ঢাকা জুট মিল ব্ল্যাক আউট করে দিই।
এরপর চলে যাই বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দক্ষিণ চারিগাঁ নওয়াপাড়া গ্রামে, লুৎফর রহমানের বাড়িতে। সেখানে ব্রিটিশ আমলের এক সুবেদার ছিলেন। তিনি এক মাস অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক ট্রেনিং দেন। ওই গ্রামের প্রায় শতাধিক লোক তাতে অংশ নিয়েছিল। অতঃপর নওয়াপাড়া গ্রামের ট্রেনিং প্রাপ্ত যুবকদের কাছে অস্ত্রগুলো রেখে আমরা চলে যাই মুঞ্জিগঞ্জে। সেখান থেকে বৈদ্যেরবাজার রামচন্দ্রপুর হয়ে চলে আসি প্রথমে ভারতের আগরতলায় এবং পরে কোলকাতায়। সঙ্গে ছিলেন তিনজন– লুৎফর রহমান, তার ছোট ভাই মুজিবর রহমান আর মোহসিন সাহেব।’
ফুটবল দল গঠনের চিন্তাটা আসলো কখন?
মুচকি হেসে সাইদুর রহমান প্যাটেল জানালেন সে ইতিহাসটি। তাঁর ভাষায়–‘সময়টা মে মাসের মাঝামাঝি। আমরা তখন কোলাকাতায়, সুবোধশাহার বাসায়। হঠাৎ চিন্তা আসে ফুটবল প্লেয়ার হিসেবে কীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখতে পারি? ভাবতে থাকলাম। মনে মনে একটা ফুটবল টিম গঠনের ইচ্ছাও জাগে। সে দলের খেলা থেকে যে তহবিল আসবে তা দিয়ে দেওয়া হবে মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়তেও মারাত্মক ভূমিকা রাখবে সেটি।
ভিডিও: স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের ইতিহাস জানাচ্ছেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেল
পরিকল্পনাটা শেয়ার করলাম সবার সঙ্গে। শুনে লুৎফর রহমান বলেন–‘পাগল হয়েছিস। দেশে পাকিস্তানিরা লক্ষ লক্ষ লোক হত্যা করছে, মা-বোনদের টর্চার করছে। আর তুমি এখানে ফুটবল খেলবা! পাবলিক পিটায়া মারবে।’
একটু রাগ হলো। তবুও দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝিয়ে বললাম– ‘একটা মিনতি দিয়ে সারাদিন কাজ করলে একজন শ্রমিকের যে পরিশ্রম হয়। মাঠে আমরা যতক্ষণ ফুটবল খেলি এর চেয়ে কম পরিশ্রম হয় না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে পয়সা পাব সেটা দিয়ে দিব মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে। এর চেয়ে বড় কাজ আর কি হতে পারে। খোলোয়াড়রা দেশের অ্যাসেট। তাদেরও তো দেশের জন্য কাজ করতে হবে।’
সব শুনে প্রস্তাবে তিনজনই সম্মতি দেয়। দেশপ্রিয় পার্কের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের হোটেল। সেখানে বসেই ফুটবল দল গঠনের আইডিয়া নিয়ে চারজন একটা ড্রাফট তৈরি করে। অতঃপর সেটা নিয়ে যাওয়া হয় প্রিন্স সিফ স্টিটিটে, এ এইচ এম কামারুজ্জামানের কাছে। পরিচয় দিয়ে প্যাটেল প্রস্তাবটি প্রথম তুলে ধরেন তাঁর কাছে। শুনে ভীষণ খুশি হলেন তিনি। হাত খরচ হিসেবে তুলে দিলেন আট’শ রুপি। পরে সামসুল হক সাহেব প্যাটেলদের নিয়ে যান তাজউদ্দীন আহমেদের কাছে, আট নম্বর থিয়েটার রোডে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফুটবল টিম গঠনের প্রস্তাবটি শুনে তাজউদ্দীনের প্রতিক্রিয়ার কথা জানালেন প্যাটেল।
তাঁর ভাষায়– ‘ফুটবল দল গঠনের উদ্দেশ্যটি জানতে চান তিনি। বললাম–‘ম্যাচের গেট মানিটা আমার মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দিব। জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এটা ভূমিকা রাখবে। আর খেলোয়াড়রাও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পাবে।’
শুনেই উনি জড়িয়ে ধরে বললেন–‘ইয়াং চ্যাপ প্যাটেল। এতো সুন্দর চিন্তা তোমাদের। কী করতে হবে বলো?
বললাম– ‘ইন্ডিয়ান সরকারের অনুমোদন লাগবে। ভারতব্যাপী খেলব আমরা। তাই লাগবে ইন্ডিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (আইএফএফ) এবং অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ)এর অনুমতিও।’
তাজউদ্দীন আহমেদ বললেন–‘সবকিছু আমি ও আমার সরকার করে দিবে।’
প্রাথমিক খরচের জন্য চৌদ্দ হাজার রুপি তিনি আমাদের হাতে তুলে দেন।’
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল- নামটা হলো কীভাবে?
প্যাটেলের উত্তর-‘আসলে অফিসিয়ালি গঠন করা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি’। শুধু ফুটবল নয় সাতারসহ অন্যান্য খেলারও আয়োজন করার পরিকল্পনা ছিল সেখানে। কোলকাতায় আমাদের বেতার কেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ফলে আমরা যখন খেলতে নামলাম স্থানীয়রাই বলতে থাকল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। মানুষের মুখে মুখেই এভাবে নামকরণ হয়ে যায় দলটির।’
কারনানি ম্যানশনে সতের নম্বর ফ্ল্যাটটি ছিল আকবর আলীর। উনি কুমিল্লার লোক। সেটি নেওয়া হয় প্লেয়ার রাখার জন্য। মাসিক ভাড়া ছিল সাড়ে চারশ রুপি। কিন্তু উনি আগ্রহ নিয়ে বিনা ভাড়াতেই থাকতে দিলেন। তার আগে পাকসার্কাস এলাকায় সাখী নামক রেস্টুরেন্টে বসে প্রাথমিক একটি কমিটি করা হয়।
কারা ছিলেন সে কমিটিতে?
তিনি বলেন– ‘প্রথম কমিটিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চিপ পেট্রন রেখে সরকার অনুযায়ী পেট্রন নজরুল ইসলাম সাহেব, পেট্রন তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রথম সভাপতি ছিলেন শামসুল হক সাহেব। উনি দুত হয়ে বিদেশে চলে গেলে দ্বিতীয় সভাপতি হন আশরাফ আলী চৌধুরী। উনিও চলে গেলে সভাপতি হন ওয়ারি ক্লাবের এম এ চৌধুরী (কালু ভাই)। সেক্রেটারী হলেন লুৎফর রহমান। ট্রেজারার মোহসিন সাহেব। সদস্য ছিলেন এম এ হাকিম (তৎকালীন এমএনএ জামালপুর), আব্দুল মতিন (তৎকালীন এমপিএ ভালুকা), মজিবুর রহমান ভুঁইয়া প্রমুখ। ননি বোসাককে মুরব্বি হিসেবে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রস্তাবক ও সংগঠক হিসেবে রাখা হয় আমাকে।’
প্লেয়ার সংগ্রহ করলেন কীভাবে?
‘আমিই তখন একমাত্র খেলোয়াড়। কোলকাতার রাস্তাতে দেখা হয় আবাহনীর আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে। উনি খেলতে আগ্রহী হলেন। জানালেন ট্রামে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে প্রতাব শংকর হাজরার, আলী ইমাম আছেন মোহনবাগান ক্লাবে, ইস্ট বেঙ্গলে আছে ওয়ারির লুৎফর। এরই মধ্যে বন্ধু মঈনসেনাকে পাঠালাম ঢাকায়। সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে বিখ্যাত প্লেয়ার শাহজাহান, লালু ও সাঈদকে নিয়ে চলে আসে কোলকাতায়। এদিকে প্লেয়ারদেরকে আহ্ববান জানিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত অ্যানাউন্স করা হচ্ছিল। তা শুনে আগরতলায় আসেন অনেকেই। নওশের, সালাউদ্দিন, এনায়েত, আইনুল হক ভাই ছিলেন নামকরা প্লেয়ার। ইন্ডিয়ান সরকারের সহযোগিতায় আগরতলা থেকে তাদেরও আনা হয় বিমানে। আমি গেলাম আলী ইমাম ও প্রতাব দা-কে আনতে।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে প্রথম যোগ দেন আলী আশরাফ ভাই। দ্বিতীয়-প্রতাব দা, নুরুন্নবী ভাই। তৃতীয়-আলী ইমাম ভাই। চতুর্থ-লুৎফর। ইমাম ভাই আসেন তার দুইদিন পর। এভাবে ১৮-২০জনের মতো চলে আসছে। অলরেডি টিম সেট হয়ে গেছে। পাকসার্কাস পার্কের ভেতরের মাঠে চলছে প্যাকটিস। অতঃপর ২৬ বা ২৭ দিন পর বালুঘাট থেকে আসেন জাকারিয়া পিন্টু। আসে তান্নাও। সে বেশ স্মার্ট ছিল। তাই ম্যানেজার করা হয় তাকে। পরে সিনিয়র বিবেচনায় জাকারিয়া পিন্টুকে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ভাইস ক্যাপ্টেন করা হয় প্রতাব শংকর হাজরাকে।’
প্রথম ম্যাচ খেলেন কোথায়?
প্যাটেলের উত্তর– ‘নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর মাঠে, ২৫ জুলাই ১৯৭১ তারিখে। প্রতিপক্ষ ছিল নদীয়া একাদশ। প্রথম লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করব, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাইব এবং জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে খেলা শুরু করব– এমনটাই ছিল আমাদের পরিকল্পনা। কিন্তু প্রবাসী সরকারকে তখনো স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। আট নম্বর থিয়েটার রোডে প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী অফিসেও ওড়েনি বাংলাদেশের পতাকা। ফলে পতাকা ওড়ানো ও জাতীয় সংগীত বাজানোতে আইনি জটিলতা দেখা দেয়। পরিকল্পনার কথা শুনে নদীয়া জেলার তৎকালীন ডিসি ডিকে বোস বললেন– ‘আমার চাকরি থাকবে না।’ আমরাও বেকে বসলাম। কেউ খেলব না। সারামাঠে তিল পরিমাণ জায়গা নাই। হাজার হাজার লোক খেলা দেখার অপেক্ষায়। পরে ডিসি সাহেব সাহস করেই অনুমতি দিলেন। প্রথম জাতীয় পতাকা উড়িয়ে ও জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে খেলা শুরু করি। ওটাই আজ ইতিহাস। খেলাটি আধা ঘন্টা পর্যন্ত ছিল ড্র। সেকেন্ড হাফে শাহজাহান প্রথম গোলটা করে। সেকেন্ড গোল করে এনায়েত। দুই দুই গোলে ড্র হয় ম্যাচটি।
সেকেন্ড গেইমটা ছিল গেস্টোপাল একাদশের সঙ্গে। মোহনবাগানের টিম। ওইদিন প্রচ- বৃষ্টি। বৃষ্টিভেজা মাঠ। শেখ কামালও ওইদিন ভিজে খেলা দেখেছিল। ওই গেমটা আমরা হেরে যাই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম সারা ভারতে টোটাল ১৬টি খেলা খেলে। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচের পরেই মাঠের যুদ্ধ ছেড়ে আমি চলে যাই সম্মুখ সমরে।’
কিন্তু আপনারই তো স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার জন্য ফুটবল যুদ্ধের ?
প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্যাটেল বলেন– ‘ছোট্ট ঘটনা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধ্য করেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচ শেষে ঘরে ফিরে দেখি ফ্লোর ভর্তি পানি। লেপ তোষক ভিজে চুপচুপা। টেপের মুখ খোলা রেখেছিল কেউ? কে করল এই কাজ? সবাই আমাকে ব্লেম দিল। খানিক হাতাহাতিও হয়। প্রতাব দা থামানোর কথা বলে আমাকে ধরে আর বাকীরা প্রচন্ড মারে। ওইদিন প্রতাব দা বলেছিল–‘প্যাটেল এটা কিন্তু পাকিস্তান না এটা হিন্দুস্থান।’ আমি হতবাক হয়ে শুধু তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কষ্ট আর দুঃখে কান্না হয় খুব। বুকের ভেতর যেন ঝড় ওঠে। এতো কষ্ট করে যে ঘর আমি গড়লাম সেই ঘরে আমি কেন আগুন দিব? কেউ এটা চিন্তাও করলো না!
ভিডিও: স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মতপার্থক্য তুলে ধরছেন প্যাটেল
আশরাফ আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে একটা তদন্ত কমিটি করা হয় তখন। তদন্তে বের হয় টেপের পানির বেগেই এটা ঘটেছে। কয়েকঘন্টায় টেপ দিয়ে পানি পড়ে ঘর ভেসে গেছে। এমনটা অন্য ফ্ল্যাটেও প্রায় ঘটে। পরে অবশ্য লিক আউটও হয় এটা আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র ছিল।’
প্রতিবাদ করলেন না কেন?
‘দেশের স্বার্থে। তদন্ত টিম যেদিন রিপোর্ট দিবে সেদিন প্রথম জানতে চেয়েছিলাম– ‘আমি কি নির্দোশ।’ আশরাফ আলী চৌধুরী বললেন–‘হ্যাঁ’। শুনে আবেগে কেঁদেছিলাম খুব। তখন সবাইকে বলেছিলাম–‘যে ঘর আমি নিজ হাতে বানাইছি, সে ঘর আমি পানিতে ভাসাতে পারি না!’ যেহেতু আমি নির্দোষ তাই প্রতাব দা ও পিন্টু ভাইসহ কয়েকজন সাসপেন্ড হতো। টিমটা তাহলে ভেঙে যেত। তাই দেশের কথা চিন্তা করেই আমি অভিযোগাটা উইড্রো করে বললাম–‘দেশের জন্যই ফুটবল দলটা কাজ করুক। যুদ্ধের জন্যইতো এসেছি। তাই যুদ্ধেই চলে যাব।’ অতঃপর চোখের জল মুছতে মুছতেই বেরিয়ে যাই।’
খেলার মাঠের যুদ্ধ ছেড়ে প্যাটেল চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। যোগ দেন সেক্টর টু এর ধনপুর সাব সেক্টরে (পরবর্তীতে যা নির্ভয়পুর সাব সেক্টর হয়)। এর কমান্ডার ছিলেন লে.কর্নেল মাহবুব আর টু আইসি ক্যাপ্টেন আবু কায়সার ফজলুল কবির। সেখানে প্যাটেলদের সর্ট ট্রেনিং দিয়ে নতুন অস্ত্রগুলো চালানো শেখানো হয়। ট্রেনার ছিলেন সুবেদার সামসু ও ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মোহাম্মদ আলী। অতঃপর তারা সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় আর্মিদের সঙ্গেই। সহযোদ্ধা সুবেদার মান্নান ও ইপিআরের আজিজের কথা এখন মনে পড়ে তার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্যাটেলরা ব্যবহার করতেন রাশান এলএমজি। প্লাটুনটা সেকশন ওয়াইজ ভাগ করা ছিল। প্রত্যেক সেকশনে থাকত একটা এলএমজি। একবার সূর্যনগর ও কনশতলার মাঝামাঝি একটা জায়গায় ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের ক্যাম্প। কয়েক প্লাটুন নিয়ে সেখানে আক্রমণ করে তারা। তিন দিক থেকে ফায়ার করে ওইদিন প্যাটেলরা এক পাকিস্তানি ল্যাফটেনেন্ট ও দশজন সেনাকে মেরেছিল। কিন্তু লালমাই যুদ্ধে তারা আবার হারায় ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দেলোয়ার হোসেন দিলুসহ ৫জনকে। তবুও পিছু হটে না প্যাটেলরা। বীরের মতো যুদ্ধ করে দুই নম্বর সেক্টরের কনশতলা, লালমাই, সোয়াগাজী, সূর্যনগর, চৌদ্দগ্রাম, বুচ্চিবাজার, কেকে নগর প্রভৃতি এলাকায়।
কথা ওঠে স্বাধীনতা লাভের পরের দেশ নিয়ে। প্রথমে জাসদেরই কার্যক্রম নিয়ে এই যোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি।
তিনি বলেন–‘আমি কালের সাক্ষি হয়ে আছি। ঢাকা ছাত্রলীগের পূর্বাচলের সিনিয়র সহসভাপতি ছিলাম তখন। স্বাধীনের পরেই পল্টনে ছাত্রলীগের একটা র্যালি হয়। তখনও সবাই এক। সেখানে একটা শপথনামা পড়ালেন আ স ম আব্দুর রব ভাই।’ বললেন– ‘একফোটা রক্ত বিন্দু থাকতে বাংলার মাটিতে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ এক বছরও ঘুরলো না। উনি উল্টে গেলেন। ওই পল্টনে দাড়িয়েই বললেন– ‘স্বৈরাচার শেখ মুজিব, খুনি শেখ মুজিব, তার চামড়া দিয়ে বাংলার মানুষ জুতা বানাবে।’
ছাত্রলীগ থেকে জাসদ যখন ভাগ হয় তখন শেখ কামালের নেতৃত্বে আমরা ছাত্রলীগকে পূর্ণগঠনের চেষ্টা করি। জাসদের ছেলেরা আমার ওপরও গুলি চালায়। লাকিলী বেঁচে যাই। সিরাজুল আলম খান ছিলেন মেকার। সিআইএর সুনজর ছিল তাদের দিকে। তখন ভারতের অপজিশনের নেতাও দেশাই, আমেরিকান ব্লকের।
একটা মিটিং করলে অনেক টাকা লাগতো তখন। জাসদ মিটিংয়ের পর মিটিং করেছে। কোথা থেকে আসত এই টাকা? প্রশ্ন কিন্তু তখনও ছিল। ঢাকার আশেপাশে যে সকল মুসলিম লীগাররা কখনও মিছিল মিটিংয়ে আসে না। তারাও যোগ দিয়েছিল জাসদের মিছিল-মিটিংয়ে। ওদের আর্থিক সহযোগিতাও পেত তারা।
জাসদ আন্দোলনের কোনো গাইড লাইন দিত না। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী তা মানুষের কাছে তুলেও ধরত না। পল্টনে দাড়িয়ে তারা শুধু একটা পরিবারকে নিয়েই অকথ্য মিথ্যাচার করেছে, গালি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষকে বিষিয়ে তোলাই ছিল জাসদের মূল কাজ। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে আন্ডার গ্রাউন্ডে তারা গণবাহিনী তৈরি করে। যারা প্ল্যান করে ব্যাংক, হাটবাজার তখন লুট করেছে। হোম মিনিস্টার মনসুর আলী সাহেবের বাসায়ও অ্যাটাক করে তারা। ফলে সারাদেশে অস্থিরতা দেখা দেয়। যা বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। তাই আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু হত্যার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে খন্দকার মোসতাক, খুনের নেতৃত্ব দিয়েছে জিয়াউর রহমান এবং ক্ষেত্র তৈরির নেতৃত্ব দিয়েছিল সিরাজুল আলম খান তথা জাসদ।’
১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করার অপরাধে অ্যারেস্ট করা হয় মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান প্যাটেলকে। অতঃপর কারাগারে চলে নির্মম টর্চার। প্রহসনের বিচারে তাকে বিশ বছরের সাজাও দেওয়া হয়।
সে সময়কার কথা বলতে গিয়ে এই বীরের বুকে জমে থাকা কষ্টের মেঘগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। আমরা তখন নিরব থাকি। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন–
‘মার্শাল’ল চলছিল। জিয়াউর রহমান সরকারের দুই নম্বর কোর্ট তখন গণভবনে। পাকিস্তান ফেরত উইং কমান্ডার সবুরুদ্দিন কোর্টের চেয়ারম্যান। মেজর সালেক মেম্বার। প্রথম হাজিরায় কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে সবুরুদ্দিন প্রশ্ন করেন তিনটি–
‘ছাত্রলীগ করতা?’
বলি– ‘জি’।
‘তুমি শেখ কামালের বন্ধু ছিলা?’
বলি– ‘জি’।
‘মুক্তিবাহিনীতে ছিলা?’
বলি–‘জি’।
এরপরই তিনি ক্ষেপে যান। বলেন–‘তোমার মুক্তিবাহিনীগিরি ছুটাচ্ছি।’
ওদের প্ল্যানটা ছিল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ধরেই নিয়েছিলাম ফাঁসি দিবে। জিয়া তখন তার দলে যোগ দেওয়ার নানা ভয়, প্রলোভন ও প্রস্তাব দিয়েছিল। তবুও যাই নি। বলেছিলাম, জিয়ার দলে যোগ দেওয়ার চেয়ে ফাঁসিতে ঝুলাও ভাল। পরে বিশ বছরের সাজা দেয়। জেলে বসেই বাবাকে হারাই। কয়েক ঘন্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি মিলে। কিন্তু কোমরের দড়ি আর হাতের হ্যান্ডক্যাপ খুলে নাই ওরা। জানাজার সময় মুরুব্বিরা দারোগাকে অনুরোধ করে হ্যান্ডক্যাপটা খুলে দেওয়ার। উত্তর ছিল–‘ওপরের অর্ডার নাই।’ বাবার কবরে মাটি দিতেও দেয় নাই জিয়া সরকার। এই কষ্টের কথা কীভাবে ভুলি বলেন!
একাত্তরের ক্রীড়াঙ্গণের যোদ্ধা, যারা খেলার মাধ্যমেই স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলেছিল। দেশ স্বাধীন না হলে যাদের রাস্ট্রদ্রোহীতার মামলায় গুলি করেই মারা হতো, একাত্তরের সেই ফুটবল যোদ্ধাদের সাতচল্লিশ বছর পরও সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি। বর্তমান সরকার দলের একজন প্লেয়ারকে আর্থিক সহযোগিতা করেছে মাত্র। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেল দুঃখ করেই বলেন–‘বীরের দেশে একাত্তরের ফুটবল যোদ্ধাদেরও স্বীকৃতি দিতে হবে। এরা তো একটা অ্যাম্বাসেডরের কাজ করেছিল। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ফুটবল দল হলো ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। এখন ক্রীড়াঙ্গণ ছাড়া একাত্তরের আর কারও স্বীকৃতি তেমন বাকী নেই। শব্দ সৈনিকরাও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাই আমরাও আশাবাদি। এই ফুটবল দলটিকে স্বীকৃতি প্রদানসহ প্লেয়ারদের সুচিকিৎসা ও আবাসনের ব্যবস্থা করলে মরেও শান্তি পাব।’
ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার সাইদুর রহমান প্যাটেলের। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে এক চুলও সরে দাঁড়াননি। দেশটা সোনার বাংলা হয়ে উঠুক সেটাই স্বপ্ন তার।
তিনি বলেন– ‘অন্যায় করাও শিখিনি। চোখের সামনে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকেই দেখেছি বিহারীদের বাড়ি দখল করে বড়লোক হতে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের সত্ত্বাটা কখনও নষ্ট করিনি। সবচেয়ে বড় আর্শিবাদ পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর। জিয়ার আমলে বন্দী অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ছিলাম সলিমুল্লাহ মেডিকেলে, দশ নম্বর নিউ কেবিনে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তখন দেশে ফিরেছেন মাত্র। খবর পেয়ে চারদিন পরেই তিনি দেখতে আসেন আমাকে। তাঁর স্নেহে আর সাহসেই নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলাম ভাই।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা ভৌগলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ চলবে। সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে তরুণ প্রজন্মকে। দেশকে উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তরের যুদ্ধে তারাই হবে এ যুগের যোগ্য মুক্তিযোদ্ধা। এমনটাই বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেলের। চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন- ‘তোমরা দেশপ্রেম নিজের ভেতর ধারণ করো। দেশের সঠিক ইতিহাসটাও জেনে নিও। সুশিক্ষিত ও সৎ থোকো। দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা করো। তাহলেই দেখবে দেশ থেকে তোমার অনেক কিছু পাবে।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য:
নাম : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রতিষ্ঠাতা সাইদুর রহমান প্যাটেল।
ট্রেনিং নেন : প্রথম এক মাসের অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক ট্রেনিং নেন এক ব্রিটিশ আমলের সুবেদারের কাছে, বিক্রমপুরের লৌহজং থানার দক্ষিণ চারিগাঁ নওয়াপাড়া গ্রামে। অতঃপর সেক্টর টু এর ধনপুর সাব সেক্টরে সর্ট ট্রেনিং দিয়ে নতুন অস্ত্রগুলো চালানো শেখানো হয়। ট্রেনার ছিলেন সুবেদার সামসু ও ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মোহাম্মদ আলী।
মাঠ ও সমরের যুদ্ধ : ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’ গঠনসহ প্রথম দুটি ফুটবল ম্যাচে অংশ নেন তিনি। অতঃপর খেলার মাঠ ছেড়ে চলে আসেন সম্মুখ সমরে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের কনশতলা, লালমাই, সোয়াগাজী, সূর্যনগর, চৌদ্দগ্রাম, বুচ্চিবাজার, কেকে নগর প্রভৃতি অঞ্চলে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৩০ জুন ২০১৮
© 2018, https:.