শহীদপাড়ায় গণকবর
আলতাফ আলীর বাড়িটি মূল রাস্তার পাশেই। পাকা বাড়ির পেছনেই ছোট্ট একটি বাগান। বাগানে শিম, কলা আর হরেক রকমের গাছগাছালি। ছোট ছোট গোটা পঞ্চাশেক সুপারি গাছও রয়েছে বাগানটিতে। বাগানির হাতের ছোঁয়ায় শিমগাছের মাচায় ঝুলছে শত শত নীল রঙের শিমফুল। মৌমাছিরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে। সবুজে ঢাকা বাগানটির শোভা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে শিমফুলগুলো।
গোটা বাগানটি নিখাদ সমতল। কোথাও কোনো উঁচু নিচু ভাব নেই। নেই কোনো কবর বিশেষের লেশ মাত্র। পায়ে হেঁটে বিনা বাধায় চলে যাওয়া যায় বাগানের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তরে। গ্রামের শর্টকাট পথ হিসেবে অনেকেই এভাবে চলাচল করে বাগানের ভেতর দিয়ে।
শিমগাছের ঠিক পাশেই বাগানের একটি অংশ যেন হঠাৎ বদলে যায়। চারদিকে বসে বাঁশের চারটি বড় বড় ঘুঁটি। ঘুঁটির সঙ্গে দুই সারিতে ঘিরে দেয়া হয় হলুদ রঙের নাইলনের মোটা দড়ি। যেন একটি কবর বিশেষ। তবে সাধারণ সাইজের কবরের মতো জায়গা এটি নয়। কিছুটা বড় আকারের কবর এটি। সাধারণ কবরের মতো যতœ নেই, নেই কোনো ঘিরে দেয়া প্রাচীর। একেবারে পায়ের তলায় মিশে যাওয়া গণকবর এটি। এটিই ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের বাঘইল গ্রামের শহীদপাড়ার একটি গণকবর।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের উচ্চপর্যায়ের ৬ জন কর্মকর্তা আসবে এই গণকবরটি দেখতে। তারা কথা বলবেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গেও। সে কারণেই গণকবরকে চিহ্নিত করার এমন তোড়জোড়। কেউ দেখিয়ে না দিলে অন্য সময়ে এ কবর খুঁজে বের করা কারো পক্ষে প্রায় অসম্ভব। অথচ ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা এখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে শিশুসহ ২৩ জন নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে। যারা শায়িত আছেন এই গণকবরটিতে। মুক্তিযুদ্ধের ৩৯ বছর পরও রক্ষা করা হয়নি এই গণকবরটিকে। বরং অনাদর, অবহেলায় আর মানুষের পায়ের তলায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে গণকবরটি। মিশে যাচ্ছে দেশের জন্য আত্মাহুতি দেয়া ২৩ জন শহীদের আত্মত্যাগের কাহিনীটিও।
১৯৭১ সাল। ঈশ্বরদী উপজেলার বাঘইল গ্রামে গড়ে ওঠে একটি পাড়া। সবাই ডাকে নয়াপাড়া বলে। নতুন হওয়ায় পাড়াটির এমন নামকরণ। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দেয়া শহীদের রক্ত বদলে দেয় পাড়ার নামটিকে। নাম পাল্টে নতুনপাড়া হয়ে যায় শহীদপাড়া। শহীদপাড়া নিয়ে স্থানীয় এক সাংবাদিক তেমনটিই জানালেন।
৫ নবেম্বর ২০১০ তারিখে শহীদপাড়ায় যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তারা। আমরা সেখানে যাই তার একদিন পরেই। ঈশ্বরদী অতি পুরনো একটি উপজেলা। সাহসী বাঙালির নানা কাহিনীতে ভরা এই উপজেলা। পাঁচ শহীদের মোড় আর বিবিসি বাজারটি আজও ইতিহাসের সাক্ষী। এখানেই রাখা আছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায় নিক্ষিপ্ত বোমার অংশবিশেষও।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসায় পাকশী পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকাতে। সেখান থেকে খুব কাছেই শহীদপাড়া। বাঘইলসহ আশপাশের গ্রামের সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের। অনেক পরিবারেরই যুবক ছেলেরা গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানিরা নির্বিচারে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। সবাই উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
গ্রামটিতে ছিল বিহারিদের আনাগোনা। মাঝেমধ্যেই তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলত বাঙালিদের হাতাহাতির মতো ঘটনা। বিহারিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর। একইসঙ্গে শখ্য ছিল রাজাকার বাহিনীর। বিহারিদের মাধ্যমেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢোকে বাঘইল গ্রামে। ২৩ নবেম্বরে শহীদপাড়ায় চালায় ন্যক্কারজনক গণহত্যাটি।
শহীদপাড়ার প্রবেশমুখেই নজরে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভেঙেপড়া একটি বড় বোর্ড। রাস্তার পাশে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বোর্ডটি। কাছে যেতেই দেখা গেল বোর্ডটিতে শহীদ ও আহতদের নামের তালিকা লেখা। অনেক নামই প্রায় অস্পষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় একজন জানালেন প্রায় ছয়-সাত মাস আগে ভেঙে পড়েছে বোর্ডটি। কিন্তু শহীদদের নামের এই বোর্ডটিকে টাঙানোর যেন কেউ নেই।
সামনে এগোতেই কয়েকজনের দেখা মিলে। রাস্তার পাশে বাঁশের চাল তৈরিতে ব্যস্ত সবাই। একপাশে বসে আছে বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একজন বয়োবৃদ্ধ লোক। নিজের নাম জানাল আব্দুল কাদের পরমানি। ’৭১ এর কথা জানতে চাইলেই তিনি আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকান। তার চোখেমুখে খানিকটা ভয় আর বিরক্তির ছাপ। এই কাদের পরমানির বাড়িতেই ৭১ এর ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে আসে শিশুসহ পাড়ার প্রায় ৪২ জন সাধারণ মানুষকে। বিকেলের দিকে ব্রাশফায়ারের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়া হয় নিরপরাধ মানুষগুলোকে। ৪২ জনের মধ্যে সেদিন শহীদ হয় ২৩ জন। বাকিরা মারাত্মকভাবে আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
সেদিন বেঁচে যায় আব্দুল কাদের পরমানিও। তিনি জানালেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করায়। আর্মির অফিসার তখন হুংকার দিয়ে জানতে চায়, ‘কিতনা আদমি এহাছে’। হঠাৎ ব্রাশফায়ারে শব্দ গর্জে ওঠে। নিমেষেই তার ওপর লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত কয়েকজন। তাদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস। সাথের লোকদের রক্তে কাদেরের শরীরও লাল হয়ে যায়। তিনিও লুটিয়ে পড়েন সকলের সঙ্গে। পাকিস্তানিরা ভেবেছে সবাই গুলিবিদ্ধ। ফলে মৃত্যু অবধারিত। তারা চলে গেলে কাদেরসহ অনেকেই দৈবক্রমে আহত অবস্থায় প্রাণে বেঁচে যায়। নিজে বেঁচে গেলেও সেদিনের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করে কাদেরের নিকটাত্মীয়সহ অনেকেই। পাকিস্তানিদের হাত থেকে সেদিন রক্ষা পায়নি ৩ থেকে ৭ বছরের শিশুও। সাত্তার, সাজেদা আর নুরুন্নাহার নামের শিশু ছাড়াও রক্তাক্ত হয় জোসনা নামের একজন নব বিবাহিতা। পাকিস্তানি আর্মিরা চলে গেলে ২৩টি লাশ দাফন করা হয় একটি গণকবরে।
গণকবরটি কোথায় জানতে চাইলে কাদের পরমানি আমাদের নিয়ে যান ঠিক পাশেই একটি বাগানের দিকে। সেখানে দেখতে পাই ঘেরা দেয়া গণকবরটিকে। একগুচ্ছ ফুলের একটি তোরা পড়ে আছে গণকবরটির ঠিক মাঝখানে। পাশ থেকে আমজাদ মণ্ডল জানলেন ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তাদের দেয়া ফুল এটি। কিন্তু গণকবরটির এই হাল কেন? প্রশ্ন করতেই আমজাদ মণ্ডল অকপটে বলেন, ‘যাদের রক্তে এ দেশটা স্বাধীন হলো তাদের মনে রাখল না কোনো সরকার’। তিনি জানালেন বছর তিনেক আগে প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড আর শহীদ পরিবারগুলোর উদ্যোগে সিদ্ধান্ত হয় গণকবরটিকে পাকা করার। কিন্তু সে পর্যন্তই। তারপর আর কোনো কাজ এগোয়নি। এমনকি গণহত্যার দিনটিও পালন করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি অদ্যাবধি।
গণকবরস্থলে কথা হয় আলতাফ আলীর সঙ্গে। এ গণকবরেই শায়িত আছেন তার ভাই আইয়ুব আলী, ভাবী মনোয়ারা বেগম আর ভাতিজা সাত্তার। তার জায়গাতেই রয়েছে গণকবরটি। শহীদের পারিবারের সদস্য হিসেবে তিনি জানালেন নানা কষ্ট আর আক্ষেপের কথা। তিনি দাবি করলেন গণকবরটি সংরক্ষণ, একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি আর গণহত্যার দিনটিকে সরকারিভাবে পালনের। কিন্তু তিনি কিংবা শহীদ পরিবারগুলো কেন উদ্যোগ নিলো না গণকবরটি সংরক্ষণের। এমন প্রশ্নে উত্তর শুধুই নীরবতা।
জানা যায় ’৭১-এ শহীদপাড়ার এই গণকবরটিতে দাফন করা হয় শহীদ মজিবর রহমান খাঁ, শহীদ আরমান আলী, শহীদ আবুল হোসেন, শহীদ মোসলেম হোসেন, শহীদ শহিদুল ইসলাম,শহীদ উম্মে আলী মণ্ডল, শহীদ শফিকুল ইসলাম, শহীদ বাদাম মণ্ডল, শহীদ আইয়ুব আলী, শহীদ আঃ সবুর খাঁ, শহীদ আজিবুর রহমান, শহীদ আঃ সাত্তার, শহীদ ছাকাতন খাতুন, শহীদ রুপজান খাতুন, শহীদ দাছিমন বেগম, শহীদ হাওয়া বেগম, শহীদ মনোয়ারা বেগম, শহীদ রহিমা খাতুন, শহীদ রহিমা বেগমসহ মোট ২৩ জনকে।
‘জরুরিভাবে শহীদপাড়ার মতো গণকবরগুলোকে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এটি সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিত। আমি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসেবে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি শহীদপাড়ার গণকবরটিকে সংরক্ষণের, একই সঙ্গে শহীদ পরিবারগুলোকে সরকারিভাবে স্বীকৃতি দেয়ার’ – শহীদপাড়ার গণকবরটি সম্পর্কে এভাবেই বললেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঈশ্বরদী উপজেলা কমান্ডার মো. আব্দুর রাজ্জাক। পাশাপাশি তিনি জানালেন সরকারি সহযোগিতা আর আর্থিক সংকটের কারণে তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি গণকবরটিকে সংরক্ষণ করার। তবে অতিদ্রুত তারা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গণকবরটি সংরক্ষণ ও শহীদ পরিবারগুলোকে স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নিবেন বলে জানান।
এক ধরনের কষ্ট নিয়ে আমরা ফিরে আসি শহীদপাড়া থেকে। যাদের রক্তে এদেশ স্বাধীন হলো। তাদের মনে রাখল না এ দেশ। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরেও শহীদপাড়ার নিরীহ নিরপরাধ মানুষের আত্মত্যাগের কাহিনী তুলে ধরা হয়নি দেশবাসীর কাছে। উদ্যোগ নেয়া হয়নি গণকবরটির ন্যূনতম সংরক্ষণের। সরকারিভাবে স্বীকৃতিও পায়নি শহীদপাড়ার শহীদ পরিবারগুলো। এ বড়ই লজ্জার, বড়ই দুঃখের বিষয়।
ভাবতেই অবাক লাগে, ৭১ এ পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামসের লোকেরা গোটা দেশেই তৈরি করেছিল শত শত গণকবর। আর স্বাধীনের পর মানুষের পায়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে সে গণকবরগুলো। চাপা পড়ে যাচ্ছে বাঙালির আত্মত্যাগের কাহিনীগুলো।
এদেশে গণকবর সংরক্ষণের প্রশ্ন উঠলেই শুনতে হয় আর্থিক সংকটের কথা। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে। সংকট আসলে আমাদের মনে। সঙ্কট আমাদের মানসিকতায়। অকৃতজ্ঞের মতো আমরা বেঁচে থাকতেই যেন বেশি গর্ববোধ করি।
তবু শহীদ পরিবারগুলো আজো অপেক্ষায় আছে, কবে সংরক্ষণ করা হবে শহীদপাড়ার গণকবরটিকে? কবে নির্মিত হবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ? শহীদপাড়ার কোমলমতি ছেলেমেয়েরা কোন বছর থেকে পালন করবে ২৩ নবেম্বর দিনটিকে? কবে তারা স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে একগুচ্ছ ফুল দিয়ে বলবে, ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’।
ছবি : সালেক খোকন
লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিকে ২৩ ডিসেম্বর ২০১০
© 2011 – 2021, https:.