আদিবাসী

পাহাড়িয়া বিদ্রোহ-শেষ পর্ব: বিদ্রোহের সুফল পান সাধারণ কৃষকরা

বিদ্রোহীর সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মধ্যভাগে ওই অঞ্চলে একদল ইংরেজ সেনা প্রেরণ করা হয়। বিশাল বিদ্রোহী দল সেনাদলটিকে যুদ্ধে পরাজিত করে বাঁকুড়া জেলার সেই সময়কার সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র এলামবাজার দখল করে নেয়। এ সময় তারা তীর-ধনুকের সঙ্গে বন্দুক ও তলোয়ারও ব্যবহার করে।

অবস্থা বেগতিক দেখে বীরভূমের কালেক্টর মি. কিটিং তখন গভর্নর-জেনারেলের কাছে পূর্ণ সেনাবাহিনী নামানোর আবেদন করে লিখেছিলেন—বন্দুক-তলোয়ারে সজ্জিত একটি প্রকাণ্ড সৈন্যদল বীরভূমে ঘাঁটি স্থাপন করে আছে। এখন তাদের ছত্রভঙ্গ করা একটি পূর্ণ সামরিক বাহিনী ছাড়া সম্ভব হবে না।

এদিকে তখন বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে। বর্ষায় বাঁকুড়ায় বিদ্রোহীদের থাকার মতো আশ্রয়স্থল ছিল না। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, বাঁকুড়ায় দখল করা ঘাঁটিগুলোতে কিছু বিদ্রোহী রেখে পাহাড় অঞ্চলে ফিরে যাবে বাকিরা। পরবর্তী সময়ে শীত শুরু হলেই তারা আবার ফিরে এসে আক্রমণ চালাবে। তারা তাই করল।

ইংরেজ শাসকরা এ সুযোগে সীমান্তে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং কলকাতা থেকে সৈন্য এনে শীতে বিদ্রোহীদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নেয়। এ বিষয়টি ও বিদ্রোহীদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় কালেক্টরের লেখা সরকারি পত্র থেকে।

গভর্নর-জেনারেলের কাছে তিনি লিখেছিলেন—আমাদের এখানে যে সৈন্য আছে, তা দ্বারা বিদ্রোহীদের বাধা দেওয়া সম্ভব নয়। সৈন্যদের তুলনায় বিদ্রোহীরা বহুগুণ বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি সুশৃঙ্খল এবং অনেক বেশি সাহসী। আর আমাদের সৈন্যগণ শৃঙ্খলহীন, ভগ্নোদ্যম এবং তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে তাদের সহযোগিতাকেই বেশি পছন্দ করে।

সময়টা ছিল নভেম্বর মাস। বিদ্রোহীরা পাহাড় থেকে নেমে আসার আগেই ইংরেজরা বিষ্ণুপুর সীমান্তের ছয়টি প্রবেশ পথে সেনাবাহিনীর সৈন্য মোতায়েন করে। আরেক দল সৈন্য শহরে প্রবেশ করে পাহারারত বিদ্রোহীদের হাত থেকে এলামবাজার মুক্ত করে। সমস্ত ইংরেজ সৈন্য বিষ্ণপুর রক্ষার জন্য ব্যস্ত থাকে। ফলে বীরভূম প্রায় অরক্ষিত থাকে।

এ সময় পাহাড়ে থাকা বিদ্রোহীরা আবার আক্রমণ শুরু করে। বিষ্ণুপুরে ইংরেজ সৈন্যসামন্ত মোতায়েন দেখে তারা বীরভূম আক্রমণ করে দখল করে নেয়।

এ সময় ওই অঞ্চলের শাসকগণের শোচনীয় পরিণতি জানা যায় হান্টারের লেখা রিপোর্ট থেকে। তিনি লিখেছেন—সৈন্যগণ  রাত্রিকালে মার্চ করতে করতে শ্রান্তক্লান্ত এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের পক্ষে দস্যুদের দমন করা সম্ভব ছিল না। এমনকি প্রধান শহরগুলি রক্ষা করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি লিখে পাঠান যে, সদর ঘাঁটি (বীরভূম শহরে) সরকারি দপ্তরগুলো পাহারা দেওয়ার জন্য মাত্র চারজন সৈন্য অবশিষ্ট রয়েছে। কয়েক সপ্তাহ পরে ওই সেনাপতি জানায়, রাজস্বের অর্থ-বহনকারী দলের জেলার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের নিরাপত্তার জন্য তিনি কোনো সৈন্য পাঠাতে পারবেন না।

১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকের ঘটনা। বিষ্ণুপরের প্রাচীন রাজধানী, বীরভূমের অন্তর্গত রাজনগর নামক শহরটি বিদ্রোহীরা অধিকার করে নেয়। ফলে এর মাধ্যমে সমগ্র বীরভূম জেলাই বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায়। ইংরেজ শাসকরা তখন সংকটে পড়ে। বীরভূম রক্ষা করতে গেলে বিষ্ণপুর এবং বিষ্ণপুর রক্ষা করতে গেলে তাদের বীরভূম ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম হয়।

বিষ্ণুপুর থেকে রাতের অন্ধকারে তখন ইংরেজরা বীরভূমের দিকে সৈন্য প্রেরণ করতে থাকে। ফলে সেখানে ইংরেজ সৈন্য সংখ্যা কমে যায়। সে সুযোগে বিদ্রোহীরা অতর্কিতে আক্রমণ করে বিষ্ণুপুরও দখলে নেয়। ইংরেজ সৈন্যরা তখন পালাতে থাকে। অতঃপর বিদ্রোহীরা বীরদর্পে দক্ষিণ দিকের জেলাগুলোর জমিদার ও জোতদারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এভাবে বীরভূম ও বাঁকুড়ার সর্বত্র আক্রমণ চলতে থাকে। ফলে ইংরেজদের শাসন-ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে।

১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের বর্ষাকাল তখন। বিদ্রোহীরা কয়েক মাস অলসভাবে বিষ্ণুপুরে অবস্থান করছিল। এ সময় স্থানীয় বিদ্রোহী ও বহিরাগত পাহাড়িয়া আদিবাসীদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় বিদ্রোহীদের মধ্যে যারা কৃষক তারা সংগ্রাম বন্ধ করে গ্রামে ফিরে কৃষিকাজ শুরু করা পক্ষে থাকে। আর বহিরাগত পাহাড়িয়া বিদ্রোহীরা বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই নিয়ে বিদ্রোহীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।

এ সুযোগে ইংরেজরাও স্থানীয় বিদ্রোহী কৃষকদের সংগ্রামের পথ থেকে সরিয়ে নিতে কৌশল অবলম্বন করে। বীরভূম ও বিষ্ণুপুর অঞ্চলের বিশাল জঙ্গল কেটে ইংরেজ শাসকরা বসতি স্থাপন ও কৃষিকাজ আরম্ভ করার ব্যবস্থা করে। ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর-নভেম্বর মাসের কথা। ওইসব জমিতে কৃষিকাজ ও বসতি স্থাপনের জন্য ইংরেজরা কৃষকদের আহ্বান জানায়। ফলে সমতলের অনেক কৃষক সংগ্রামের পথ ত্যাগ করে ওই জমিতে চাষবাস শুরু করে।

অন্যদিকে পাহাড়িয়া আদিবাসী বিদ্রোহীরা ইংরেজ ও জমিদার-জোতদারদের সম্পদ লুটের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ থেকে ঘরে ফিরে যাওয়া বিদ্রোহী কৃষকদের ঘরবাড়ি ও সম্পদও লুটে নেওয়া শুরু করে। এর ফলে সমতলের ওই কৃষকরাও নিজেদের বাঁচাতে ইংরেজ সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় এবং যৌথভাবে আক্রমণ করে পাহাড়িয়াদের বিদ্রোহ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। অনেক আদিবাসী তখন পালিয়ে যায়। আর বেশ কিছু পাহাড়িয়া বিদ্রোহী ইংরেজদের হাতে ধরা পরে।

ইংরেজরা তখন বন্দি পাহাড়িয়া আদিবাসীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে। পাহাড়িয়াদের সংখ্যা গুনতে বিদ্রোহীরা ধরা পড়লেই যেন তাদের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এমন নির্দেশ দেওয়া হয় সৈন্যদের। ফলে সৈন্যরা বন্দিদের মাথা কেটে ঝুড়ি ভর্তি করে সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতে থাকে। আর এভাবেই বীরভূম ও বাঁকুড়া অঞ্চলের কৃষক এবং পাহাড়িয়া আদিবাসীদের সম্মিলিত বিদ্রোহটি ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে নির্মম অবসান ঘটে।

এই বিদ্রোহ সম্পূর্ণ সফলতা লাভ না করলেও আংশিক সফল হয়েছিল। বিদ্রোহে প্রাণ দিতে হয় বহু পাহাড়িয়া আদিবাসীদের। কিন্তু বিদ্রোহের সুফল ভোগ করেছিল সাধারণ কৃষকরা। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পর জঙ্গলাকীর্ণ যে পতিত জমি পড়েছিল, বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ শাসকরা বাধ্য হয়ে তা আবার চাষাবাদ ও বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তুলে সমতলের কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়। আর এভাবেই অন্নহীন, বস্ত্রহীন, জমিহীন একদল কৃষক আবার ফিরে পায় তাদের বাসস্থান ও চাষাবাদের জমি। কিন্তু বিদ্রোহে প্রাণ দেওয়া শোষিত, লাঞ্চিত, নিপীড়িত পাহাড়িয়া আদিবাসীদের ইতিহাসে জায়গা হয় শুধুই লুটেরা আর দস্যু হিসেবে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে এনটিভিবিডি ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button