কলামমুক্তিযুদ্ধ

২৫শে মার্চে রাজারবাগের প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ

১৯৬৫ সাল। মেট্রিক পাস করেছি মাত্র। একটা চাকরিও পেয়ে যাই তখন। কিন্তু প্রজেক্ট শেষ হওয়ায় বছর দেড়েকের মধ্যেই ওই চাকরি হারাই। ফলে কাজের সন্ধানে চলে আসি চট্টগ্রামে। লোকমুখে এক দিন পুলিশে লোক নেওয়ার খবরটি পাই। লাইনে দাঁড়াতেই শরীরের মাপে ফিট। মেট্রিক পাস শুনতেই নিয়ে নিল। পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল হিসেবে যোগ দিলাম। ব্রাশ (বডি) নম্বর ছিল ১৯৯।

হালি শহরে ছয় মাস ট্রেনিং। অতঃপর পোস্টিং হয় কুমিল্লায়। পরে পুলিশ টেলিকমিউনিকেশন কোর্সের জন্য আমাকে পাঠানো হয় রাজারবাগে। ১৯৭১-এ ছিলাম ওখানকার ওয়্যারলেস অপারেটর।

৭ই মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন রেসকোর্স ময়দানে। এরপর থেকেই পুলিশ ব্যারাকের অবস্থা বদলে যেতে থাকে। ওখানে অবাঙালি পুলিশ সদস্য যেমন ছিল, আবার বাঙালি হয়েও স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকও ছিল। খেতে বসলেই ওরা অহেতুক আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত। কিন্তু শেখের ভাষণের পর হাতাহাতি হতে থাকল

রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুকুর পাড়ে আলোচনায় বসতাম। সিদ্ধান্ত হয় যা-ই ঘটুক আমরা প্রতিহত করব। কিন্তু কীভাবে? তা-ও জানা ছিল না! ভয়ও ছিল। কারণ তখন আমাদের বিপক্ষে ছিলেন এআইজি টেলিকমিউনিকেশনের প্রধান এস এম নবাব এবং ডিএসপি (ট্রেনিং) বজলুর রহমান মজুমদার।

২৫ মার্চ ১৯৭১। সকালবেলা। ঢাকা শহর থমথমে। পাকিস্তানি সেনারা হেভি মেশিনগান নিয়ে মেইন রাস্তাগুলো টহল দিচ্ছে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

আমাদের আবাসন ছিল মৌচাক মার্কেটের পাশে, ২০৬ নিউ সার্কুলার রোডের বাড়িটিতে। রাত তখন ৮টা ৩০ মিনিটি। খবর আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি আর্মিরা যেকোনো সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা আক্রমণ করবে। তাই পোশাক পরে দ্রুত রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে চলে আসি।

তখন রোলকল হচ্ছিল। খবরটা তুলতেই সবাই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর আগেই পালিয়ে যায় অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা। আমরা ২০-৩০ জন ইন্সপেক্টর মফিজ উদ্দিনের কাছ থেকে চাবি এনে মেইন অস্ত্রাগার খুলে দিই। কমান্ড বলতে তখন কিছু ছিল না। উচ্চপর্যায়ের কেউ সাহায্যও করেননি।

থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ ম্যাগাজিনভর্তি গুলি নিয়ে দু-তিন শ সদস্য পুলিশ লাইনসের ব্যারাক, প্রশাসন ভবনের ছাদ, পুকুর পাড়, রোডের পাশে ও মানুষের বাড়ির ছাদে পজিশনে চলে যায়। সাধারণ মানুষের সহযোগিতায় তারা ব্যারিকেড দেয় মৌচাক, মালিকবাগ, শান্তিনগর ও চামেলীবাগের ডন স্কুলের সামনে (বর্তমান ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট)। ওই স্কুলের ছাদেও পজিশন নেয় ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য।

দুটি রাইফেল নিয়ে আমি আর মনির ওয়্যারলেস বেজ স্টেশনের নিয়ন্ত্রণে থাকি, প্রশাসন ভবনের নিচতলায়। ওয়্যারলেস সার্কিটে বসে অপেক্ষায় আছি ওয়্যারলেসে কোনো মেসেজ আসে কি না।

রাত তখন ১০টা ৩০। একট মেসেজ পাই। তেজগাঁও এলাকায় পেট্রলে থাকা ওয়্যারলেস অপারেটর আমিরুল মেসেজ দেন। বলেন : ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, হাউ ডু ইউ হেয়ার মি, ওভার।’

আমি প্রত্যুত্তরে বলি : ‘বেইস ফর চার্লি সেভেন, ইউ আর লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার, সেন্ড ইউর মেসেজ, ওভার।’

তখন তিনি বলেন : ‘চার্লি সেভেন ফর বেইস, অ্যাবাউট থার্টি সেভেন ট্রাকস লোডেড উইথ পাকিস্তানি আর্মি আর প্রসিডিং টুওয়ার্ডস ঢাকা সিটি ফ্রম দ্য ক্যান্টনমেন্ট।’

প্রায় ছয়-সাত শ লোক ছিল রাজারবাগে। একজন গিয়ে পাগলাঘণ্টা বাজায়। ফলে বাকি পুলিশ সদস্যরাও আরেকটি অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে পজিশনে চলে যায়।

রাত ১১টা ৩০। সর্বপ্রথম পাকিস্তানি আর্মির বহর শান্তিনগর পার হয়ে চামেলীবাগের ব্যারিকেডের সামনে এসে থামে। ব্যারিকেড সরাতে ১০-১২ জন গাড়ি থেকে নামতেই ডন স্কুলের ছাদ থেকে পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেলে গুলি চালায়। পাকিস্তান সেনাদের ওপর ওটাই ছিল প্রথম আক্রমণ, যা শুরু করেছিল পুলিশ সদস্যরাই। পাকিস্তানি সেনাদের এলএমজি, এমএমজি, এইচএমজি, মর্টারগুলোও তখন গর্জে ওঠে।

হঠাৎ পাশের ব্লিডিংয়ে কামানের একটা গোলা এসে পড়ে। ফলে বিদ্যুৎ চলে যায়। টেলিফোন লাইনও কাটা। কী করা যায়? আক্রান্ত হওয়ার খবরটি সারা দেশের সবাইকে জানাতে পারলে হয়তো অনেকেই আত্মরক্ষা করতে পারবে এ চিন্তা থেকেই নিজ উদ্যোগে একটা ওয়্যারলেস বার্তা ট্রান্সলেট করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর প্রস্তুতি নিই।

রাত ১২টা বাজার তখনো তিন-চার মিনিট বাকি আছে। রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রথম ওয়্যারলেস বার্তায় আমি বলি :

‘Base for all station of east pakistan police, very very important massage for you, keep note, keep listening, watch. We are already under attacked by Pak army, try to save yourself, over and out.’ ১৯৭১-এ প্রথম ওয়্যারলেস মেসেজ প্রদানের ইতিহাসটি এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা কনস্টেবল মো. শাহজাহান মিয়া। তার বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাট্টা গ্রামে। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।

এরপর কী ঘটল? শাহজাহান বলেনÑ ‘ওয়্যারলেস মেসেজ পাঠানোর পর প্রশাসন ভবনের চারতলার ছাদে অবস্থান নিই। সেখানে ছিল আরও ৪০-৫০ জন। আমরা পাঁচজনের একটা করে ট্রুপস করি। আমার ট্রুপসে ছিল মনির, গিয়াসউদ্দিন, আবু সামাদ, সালাম প্রমুখ। মূল ভবনের ওপর থেকে প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে পজিশনে যাই। আর্মিরা ভেতরে ঢুকলেই ঠেকাব।

রাত তখন ৩টা হবে। ট্যাংকের সাহায্যে ওরা রাজারবাগের মেইন দুটি গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকেই টিনের ব্যারাকে আগুন দেয়। বেরোতে না পেরে অনেকেই সেখানে পুড়ে মরে। ছাদ থেকে আমরা গুলি চালালে ওরা ব্রাশফায়ার করতে থাকে। দেখলাম পুলিশের শত শত লাশ পড়ে আছে। ভোর ৪টার পর ৮-১০ ট্রাক এনে ওরা লাশগুলো তুলে নিয়ে যায়। গুলি তখন শেষ। ২০-২৫ জন পুলিশ সদস্য ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু আমরা বেরোতে পারিনি। ফজরের আজানের পরে পাকিস্তানি সেনারা ছাদে আসে। ওরা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের বের করে আনে। শুরু হয় ভয়াবহ নির্যাতন। রাইফেলের বাঁট আর হকিস্টিক দিয়ে মারতে মারতে আমাদের নিচে নামিয়ে আনে। ওদের বুটের লাথিতে রক্তে লাল হয়ে জমাট বেঁধে যায় খাকি পোশাক। বন্দি ছিল দেড় শর মতো। ভেবেছিলাম মেরেই ফেলবে!

২৮ মার্চ ১৯৭১। বিকেল তখন ৩টা। তালিকা করে আমাদের হস্তান্তর করা হয় এসপি এমাজ আহমেদ চৌধুরীর কাছে। ১০ জন করে গ্রুপ করে চিকিৎসার জন্য ছাড়া হয়। পরে রিপোর্ট করতে হবে মিল ব্যারাক পুলিশ লাইনসে। রিপোর্ট না করেই পালিয়ে চলে যাই এক আত্মীয়র বাড়িতে, উলুনে। পরে আমি চলে আসি বাড়িতে, নেত্রকোনায়।

‘যারা পুলিশ ব্যারাক থেকে বের হয়ে গিয়েছে, তারা যেন অনতিবিলম্বে যোগদান করে। তাহলে সাধারণ ক্ষমা করা হবে। তা না হলে রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেবে।’ রেডিও পাকিস্তান থেকে এমন ঘোষণা দেওয়া হলেও শাহজাহান দুই ভাইসহ চলে যান ভারতের মহেশখোলায়। মুক্তিযুদ্ধ করেন এগারো নম্বর সেক্টরে।

স্বাধীনতা লাভের পর পুলিশের এস এম নবাব এবং বজলুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতার অভিযোগ এনে মামলা করেছিলেন এই বীর। ফলে তাদের চাকরি থেকে ডিসমিস করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই আবার চাকরিতে ফিরে আসেন ওই বজলুর রহমান মজুমদার। এভাবে প্রায় সব সেক্টরেই স্বাধীনতাবিরোধীরা পুনর্বাসিত হতে থাকে। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতনও শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ওটা ছিল আরেক পাকিস্তান আমল।

একাত্তরের সাহসিকতার জন্য ১৯৭৩ সালে যে খেতাব দেওয়া হয়, সেখানে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেওয়া পুলিশের কেউ নেই। তাই মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা প্রবলভাবে উপেক্ষিত ছিল মনে করেন শাহজাহানসহ পুলিশের অন্য মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরতে তারা বর্তমান সরকারের কার্যকর উদ্যোগ আশা করেন।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৫ মার্চ ২০১৯

© 2019, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button