জীবনকথা

ভাইজতে ভাইজতে বুড়ি হই গেনো

একসময় মুড়িওয়ালিদের মুড়ির চাল নিজেদেরই তৈরি করতে হতো। ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে ঢেঁকিতে করা হতো চাল। ফলে তখন কেউ কেউ শুধু মুড়ির চালেরই ব্যবসা করত। মুড়িওয়ালিরা এখন রাইস মিল থেকে মুড়ির চাল কিনে মুড়ি ভাজে। আকাশে মেঘ থাকলে মুড়িওয়ালিদের মনে অন্ধকার নামে। চালের অভাবে তখন বন্ধ থাকে মুড়ি ভাজা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগারও।

পাকা রাস্তাটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে কাহারোলের দিকে। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ থেকে কাহারোল উপজেলায় যেতে এটিই শর্টকাট পথ। চার কিলোমিটার পেরোতেই ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার। বাজারের নামটিও বেশ! জগদল বাজার।

বাজারের রাস্তা থেকে বাঁয়ে নেমে গেছে একটি কাদামাটির পথ। আশপাশে অগণিত পাটকাঠি। একসময়কার স্বর্ণসূত্র এখনো বিলীন হয়নি এখান থেকে। খানিকটা এগোতেই মাটির ওপর শণে ঢাকা বেশ কিছু বাড়ি নজরে এল। স্থানীয় এক যুবক জানালেন, এটিই মুড়িওয়ালিদের পাড়া। সবার কাছে এটি মুড়িপাড়া।
গোটা ত্রিশেক ঘর নিয়ে পাড়াটি। একসময় এই পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে ছিল ঢেঁকি। মুড়ির পাশাপাশি তখন চলত চিঁড়া কোটার কাজ। দশ গ্রামের লোক পাড়াটিকে চিনত ‘চিঁড়াকুটিপাড়া’ হিসেবেই। দিনে দিনে ঢেঁকি উঠে গেলেও বন্ধ হয় না মুড়ি ভাজা। এভাবেই চিঁড়াকুটিপাড়ার নামকরণ হয়ে যায় ‘মুড়িপাড়া’।
মুড়িপাড়ার একটি বাড়িতে ঢুকেই দেখি এক বৃদ্ধাকে। বয়স সত্তরের মতো। বৃদ্ধার সামনে মাটির চুলা। দাউ দাউ করে তাতে আগুন জ্বলছে। চুলার ওপর গরম বালুর কড়াই। তিনি সেখানে ঢেলে দিচ্ছেন সামান্য চাল। অতঃপর কাঠি দিয়ে বার কয়েক নাড়াচাড়া। অমনি কড়াই ভরে যায় মুড়িতে। যেন এক জাদুর হাঁড়ি।
বৃদ্ধার নাম পবিত্রি। ছোটবেলায় মায়ের দেখাদেখি মুড়ি ভাজা শিখে ফেলেন তিনি। সেই থেকে শুরু। মুড়ি বিক্রি করছেন ৪০ বছর ধরে। পরিচয় হতেই এগিয়ে দেন একথালা মুড়ি। গরম মুড়ি খেতে খেতে গল্প হয় তাঁর সঙ্গে।
মুড়ি ভাজছেন কত দিন ধরে? এমন প্রশ্নে পবিত্রি উত্তরে বলেন, ‘ভাইজতে ভাইজতে বুড়ি হই গেনো।’ প্রতিদিন কতটুকু মুড়ি ভাজেন? তিনি বলেন, ৫০ কেজি চালের মুড়ি।
একসময় মুড়িওয়ালিদের মুড়ির চাল নিজেদেরই তৈরি করতে হতো। ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে ঢেঁকিতে করা হতো চাল। ফলে তখন কেউ কেউ শুধু মুড়ির চালেরই ব্যবসা করত। পবিত্রির ভাষায়, ‘ধানটা ভলকাইছিনো, উসাই দি শুকাই ঢেঁকিত কুটিছিনো।’
সেই সময় এখন বদলে গেছে। মুড়িওয়ালিরা এখন রাইস মিল থেকে মুড়ির চাল কিনে মুড়ি ভাজে। ভরাট কণ্ঠে পবিত্রি বলেন, ‘হামরা অটোত থাকি মুড়ির চাইল কিনি, চাইল লবণ দিয়া শুকাই, ঘামাইয়া বালু দিয়া ভাজি।’

মুড়ি ভাজায় ব্যস্ত দুই নারী

পবিত্রির মতে, ভালো মুড়ির জন্য চাই ভালো ধানের চাল। তাই তাঁরা কেনেন চায়না ষোল ধানের চাল। ৫০ কেজির এক বস্তার দাম পড়ে  সতেরশ টাকা। বিক্রি থেকে খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, তাই মুড়িওয়ালির লাভ। বাড়তি আয় হিসেবে তা তাঁরা ব্যয় করেন সংসারে। কেমন লাভ? উত্তরে পবিত্রি বলেন, ‘নিজের খরচা ধরলে হামার কিছুই লাভ নাই। এমনি বস্তায় ২০০ টেকা টিকে।’
পবিত্রির পাশেই জয়বানুর বাড়ি। বয়স তাঁর ৪০। মুড়ি ভাজছেন ১৫ বছর ধরে। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘আগে পাইকার বাড়িত আসি মুড়ি নিয়া যেত। এহন মুড়ির মিল হইছে, হাতে ভাজা মুড়ির কদর কমিছে।’ জয়বানু মুড়ি ভেজে বিক্রি করেন স্থানীয় হাটে। মাঝেমধ্যে দোকানেও দেন পাইকারি রেটে। তাঁর ভাষায়, ‘পাইকারত দিলে লাভ কম হয়।’
রায়হান নামের স্থানীয় এক লোক এসেছেন মুড়ি কিনতে। কথা হতেই তিনি জানান, মুড়ির মিল থাকলেও তাঁদের পছন্দ কেমিক্যালমুক্ত হাতের স্বাদের মুড়ি। এমন মুড়ি কিনতে তিনি চলে আসেন মুড়িওয়ালিদের পাড়ায়। এখান থেকে অনেকেই এখন মুড়ি কিনে পাঠায় ঢাকার আত্মীয়দের কাছে।
মিলের মুড়ি কেমন? প্রশ্ন করতেই জয়বানু মুচকি হাসেন। অতঃপর উত্তরে বলেন, ‘মিলে যেই-সেই দিয়া ভাজে। সালটু লালটু দেয় ফুলিবার জন্যি। ফুললে মুড়িডা ফাঁপা হয়, সাদা হয়, কাস্টমার ধরে।’ তিনি বলেন, ‘হাতের মুড়ি কম ফুলে, লালচে হয় কিন্তু স্বাদ থাকে বেশি। হামরা খালি লবণ দেই।’
মুড়ি বেশি বিক্রি হয় কোন সময়? প্রশ্ন করতেই জয়বানু রমজানের সঙ্গে জানালেন বর্ষা ও জ্যৈষ্ঠ মাসের কথা। বর্ষায় যখন গ্রামে মানুষের কাজ কম থাকে, তখন হাতে থাকে না পয়সা। জ্বালানি খড়ির দামও থাকে ঊর্ধ্বমুখী। ফলে গ্রামের অনেক পরিবারই দু-এক বেলা মুড়ি খেয়ে দিন চালিয়ে নেয়। বৃষ্টির দিনে অনেকে আবার মুড়ি খেতে পছন্দ করে কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজের স্বাদে।
আবার জ্যৈষ্ঠ মাসে ঘরে ঘরে থাকে আম-কাঁঠাল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে আম-কাঁঠালের সঙ্গে মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজটিও অতি পুরোনো। তাই সেই সময়গুলোতে বেড়ে যায় মুড়ির চাহিদা। মুড়ি নিয়ে জয়বানুর এমন তথ্যজ্ঞান আমাদের অবাক করে।
যত সহজে আমরা মুড়ির স্বাদ পাই, মুড়ি ভাজা কিন্তু তত সহজ নয়। মুড়ি ভাজতে কষ্ট কেমন? এমন প্রশ্নে জয়বানু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,‘কষ্ট খুব। খুব গরম লাগে, আগুনের আঁচত ঘামি যাই, নাড়তে নাড়তে হাতে ফোসকা পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘আগুনের ঘরে থাকি থাকি দেখা পাই কম।’
আকাশে মেঘ থাকলে মুড়িওয়ালিদের মনে অন্ধকার নামে। জয়বানুর ভাষায়, ‘অইদ না হলে চাল শুকায় না।’ চালের অভাবে তখন বন্ধ থাকে মুড়ি ভাজা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় আয়-রোজগারও। এভাবেই কেটে যায় মুড়িপাড়ার মুড়িওয়ালিদের জীবনগুলো।

লিখাটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমআলোতে, প্রকাশকাল: ০৫ আগষ্ট ২০১১

© 2011 – 2018, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

3 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button