চৈত্র-বৈশাখে বাঙালির মতো অন্যান্য জাতির মানুষেরও সম্মিলন ঘটে নানা উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতায়। এসব উৎসবগুলোই তাদের মিলনমেলা। উৎসবে দলগত নৃত্য, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় আদিবাসীরা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষের বিভেদটুকু। ফলে তাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ আরও সুদৃঢ় হয়।
চাকমারা এ উৎসবকে বিজু, ত্রিপুরা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাইং, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু বলে। মূলত ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’ উৎসব থেকে ‘বৈ’, মারমাদের ‘সাংগ্রাইং’ থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের ‘বিজু’ উৎসব থেকে ‘বি’ এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয়েছে ‘বৈ-সা-বি’। এটি আলাদা কোনো উৎসবের নাম নয়। এছাড়া অন্যরাও নিজ নিজ নামে অভিহিত করে তাদের এই উৎসবকে।
পাহাড়িদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। বৈসাবি আগমনে পাহাড়ি আদিবাসীরা গান ধর ‘তুরু তুরু তুরু রু বাজি বাজাত্তে/পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে/এচ্যে বিজু, বিজু, বিজু…’ ( তুরু তুরু শব্দে বাঁশি বাজে, গ্রামে ঘুরে বেড়াব সবাই মিলে, আজ বিজু, আজ বিজু)।
ত্রিপুরাদের প্রধানতম উৎসব হলো বৈসুক। এটি পালিত হয় চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে। উৎসবের প্রথম দিন আদিরীতি মেনে ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে, ফুল দিয়ে ঘর সাজায় ও কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর ঝুড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। ওইদিন ভালো ও পরিষ্কার কাপড়-চোপড় পরে এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়।
এ সময় ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরনের পিঠা আর মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়। বৈসুক উৎসব শুরু হলে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবশেন করে। এই নৃত্যকে ত্রিপুরারা গরাইয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে। এই লোকনৃত্যে ১৬ থেকে ৫০০ পর্যন্ত লোক অংশ নিতে পারে। ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয় এ নৃত্যে। নৃত্য দলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়।
নৃত্য শেষে প্রতি বাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন সবাইকে মদ, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দিতে হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে এ আদিবাসীরা। এদের আদিবাসী নিয়মে একবার কেউ গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নিলে, সে তিন বছর পর্যন্ত আর এই নৃত্যে অংশ নিতে পারে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হতে পারে বলে এরা বিশ্বাস করে।
মারমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে দেবীর পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় এ উৎসব এমনটিই বিশ্বাস মারমাদের। ফলে যে ক’দিন দেবী পৃথিবীতে অবস্থান করবেন সে ক’দিনই তারা নানা আনুষ্ঠানিকতা পালন করে।
মারমাদের সাংগ্রাইং চলে তিনদিন। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’ অর্থ ‘ফুল তোলা’। এদিন মারমা যুবতীরা নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধপূজার রাতে সে সব ফুল সাজিয়ে দলবেঁধে সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। বুদ্ধমূর্তির বেদিতে ভক্তি সহকারে সেই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রঙের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে। যারা বিহারে যেতে না পারে তারাও নিজ গৃহে রাখা বুদ্ধমূর্তির সামনে ফুলের অর্ঘ্য, মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রণাম ও প্রার্থনা করে। ওইদিন বিকেলে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সকল বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা না ঘুমিয়ে গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানা পদের ও হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। তৃতীয় দিনটি দেবীর নির্গমন দিবস। এদিন ভোরে এরা মঙ্গলাচরণ, অষ্টশীল গ্রহণ ও পি-দান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে উৎসবের সমাপ্তি ঘটায়। এ ছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য, সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ সময় পানি নিয়ে কোনো ঝগড়া বিবাদ করা যায় না। কৌণিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোনো অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী হচ্ছে চাকমারা। বিজু উৎসবের সঙ্গে তাই দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বিজু উৎসব পালন করে তিনদিন। বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে এরা মূল বিজু, তার আগের দিনটিকে ফুল বিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে।
ফুল বিজুর দিনে ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে উঠেই বিভিন্ন ধরনের ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর সেগুলো দিয়ে বুদ্ধপূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়িঘর সাজানো হয়। গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায়ও পরিয়ে দেওয়া হয় ফুলের মালা। এদিনে সবাই একত্রিত হয়ে শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়।
মূল বিজুর দিন চাকমারা খুব ভোরে দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে পুরনো বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামক এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার। এ সময় আগতদের নানা ধরনের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দলবেঁধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। মূল বিজুর দিনে নানা প্রকার পানীয় ও খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন বা নববর্ষের প্রথম দিনে চাকমারা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই এ দিনটিকে এরা ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।
সম্প্রতি দ্বিতীয় ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঘাইছড়ি ও বিলাইছড়িতে ঘটেছে হত্যাকান্ডের ঘটনা। ফলে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। তাই বৈসাবি উৎসবে প্রয়োজন বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আদিবাসীসহ স্থানীয় প্রশাসনকেই।
নববর্ষকে ঘিরে আদিবাসী উৎসবগুলো পালিত হয়ে আসছে আবহমানকাল থেকেই। এই উৎসবে ঘটে তাদের বৃহৎ সম্মিলন। যা তাদের দলবদ্ধতা ও একতার প্রতীকও। তাই পাহাড়ে আমরা আর হত্যা চাই না। চাই স্বাধীন এ দেশে সব জাতির উৎসবগুলো পালিত হোক নির্ভয়ে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশরূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৮ এপ্রিল ২০১৯
© 2019, https:.