এদেশে কেন জিন্দাবাদের রাজনীতি চলবে?
“গ্রামে তহন চিকিৎসা ছিল না। আবার সন্তান হওয়ার সময়েই মা মারা যায়। আমার বয়স তহন আঠার মাস। মরার আগে মা কইছিল ছেলেরে মাদ্রাসায় পড়াইব। বাবাও সে কথা রাখে। গ্রামে মাদ্রাসা কম ছিল। আমারে তাই পাঠায়া দেয় কিশোরগঞ্জে, এক আত্মীয়র বাড়িতে। দশ বছর বয়সে ভর্তি হই নোহার নান্দলা আলিয়া মাদ্রাসায়।
১৯৬৫ সাল। তহন দাখিলি নহম এ পড়ি। ওই সময় ভারত-পাকিস্তান ওয়ার চলছে। মিছিলে আমগো স্লোগান দিতে হইছে- ‘মার কে লেংগি, জোর কে লেংগি, কাশমির, কাশমির।’ এর মানে তহন বুঝতাম না। ভাবতাম মুনসির দল কি কয়! কাশমির কত হাজার মাইল দূরে। ওইডা কেমনে আনবো।
মাদ্রাসায় পড়লেও ছোটবেলা থাইকা মনটা আমার অন্যরকম ছিল। গ্রামে গ্রামে গিয়া পালাগান দেখতাম। বাবাই ছিল সব। তার বুকে বইসা থাকতাম। বাবা কইত- ‘আমরা তো শোষণের মহারাজার অধীনে। রাজা কেডা? আইয়ুব খান। ওগো বাড়ি তো পশ্চিম পাকিস্তানে। ওরা আমরার রাজা হইব কেরে।’ কথা শুইনা বাবায় হাসতো। এরপর কইত- ‘সব চাকরি আর লাঠিগুলা তো তারার হাতে। আমরার হাতে তো কিছুই নাই। তারাই এহন রাজা হইছে।’
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আগের ঘটনা। কিশোরগঞ্জ থাইকা ভৈরবের ট্রেনে নামছি গৌরিপুরে। বাড়িত যামু। অপেক্ষায় আছি মোহনগঞ্জের ট্রেনের। ওইদিন গৌরিপুর রাজবাড়ির সামনে শেখ মুজিবের মিটিং হয়। উনি ভাষণও দেন। বৈষম্যের কথাগুলা তুইলা ধরেন। খুব ভাল লাগছিল শেখ মুজিবের কথা। কি যে কণ্ঠ তার! বাবার কথাগুলাই তহন পরিষ্কার হইয়া যায়।
এরপর মাদ্রাসা ছাইড়া ভর্তি হই নেত্রকোণার দত্ত হাইস্কুলে। স্কুল থাইকাই ছাত্রলীগ করা শুরু করি। ছাত্রনেতারা আইসা ভাষণ দিতো। ওইটা মনযোগ দিয়া শুনতাম। তহন নেত্রকোণায় নেতা আছিল খালেক ভাই, মোমেন সাহেব, ডা. আখলাকুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের বর্তমান সচিব সাজ্জাদুল হাসানের পিতা) প্রমুখ।
মেট্রিক পাশের পর ভর্তি হই নেত্রকোণা সরকারি কলেজে। আন্দোলন আর মিছিল চলছে তহন। কলেজে ছাত্রলীগ করত জোহা, সাফায়েত প্রমুখ। মিছিল নিয়া আমরা এসডিওর অফিস পর্যন্ত যাইতাম।
৭০ এর নির্বাচনে মোমেন সাহেব হন এমএনএ। তার বিপরীতি ছিল হাতি মার্কা। কিন্তু নির্বাচনে জয় লাভ কইরাও আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পায় না। শুরু হয় অসহোযোগ আন্দোলন। এরপর ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে শেখ মুজিব ভাষণ দেন। থানায় গিয়া পুলিশের ওয়ারল্যাসে শুনছি সেই ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিশাল প্রেরণা। ভাষণটাই ছিল একটা যুদ্ধের মূল নির্দেশনা। একেকটা কথাই একেকটা ইতিহাস। এরপর তো পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা শুরু কইরা দেয়। তহন আমি চইলা যাই গ্রামে।”
মুক্তিযুদ্ধের আগের নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা এভাবেই বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আবুল হাশেম। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা।
শেখ সৈয়দ আলী ও পিয়ারের মা এর ছোট ছেলে আবুল হাশেম। বাড়ি নেত্রকোণার সদর উপজেলার দিগজান গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমিডিয়েট ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র।
ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
মুচকি হেসে আবুল হাশেম বলেন-
‘দুষ্টু ছিলাম বেশি। ভোলা সংক্রান্তি হলেই অন্য ছেলেদের ধরে মারধর করতাম। সঙ্গে থাকত আবু মিয়া, ফজলু মিয়া আর কাজল। আমরা আম চুরিটা বেশি করতাম হিন্দু পাড়ায়। নিজে খেতাম, বিলাইতামও। কারও সাথে কথা কাটাকাটি হলেই রাতে দলবেধে তার গাছের ডাব সাবার করে দিতাম। বেটাগিরি করছি। তবে যা বলতাম সব সামনেই।
ফুটবল খেলেছি তখন। মাছও মারছি। ফাগুন মাসে নদীতে ধরতাম- কই, মাগুর, বোয়াল আরও কত মাছ। আগে চৈত্র মাসেই জাল টেনে মাছ ধরা যেত। এখন তো পানিই থাকে না। মানুষও নদী দখল করে নিছে। মানুষ এখন লোভে নদীই খেয়ে ফেলছে।’
একাত্তরে নেত্রকোণা শহর থেকে গ্রামে ফিরে কী করলেন?
‘মুক্তারপাড়া মাঠে কাঠের ডামি রাইফেল আর আনসারদের অস্ত্র দিয়ে ১৫-২০দিনের ট্রেনিং নিই। ট্রেনিং করান দুজন আনসার কমাণ্ডার। ছিলাম ৫০জনের মতো। ওই ট্রেনিং থেকেই প্রথম রাইফেল চালানো শিখি। কিন্তু তা দিয়ে তো পাকিস্তানিদের ঠেকানো যাবে না। তাই ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ’
আবুল হাশেমরা কলমাকান্দা হয়ে চলে যান ভারতের বাগমারা ইয়ুথ ক্যাম্পে। তার সঙ্গে ছিলেন ইসলাম উদ্দিন, কালা, মতি, নুরুজ্জামান প্রমুখ। সেখানে একমাস চলে লেফট-রাইট ও শারীরিক প্রশিক্ষণ। অতঃপর জুলাই মাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তুরাতে। ২৯দিনে ট্রেনিংয়ে আবুল হাশেম থ্রি নট থ্রি, এলএমজি, স্টেনগান, এসএমজি প্রভৃতি চালানো শিখেন। ভারতীয় আর্মির এসকে দাশ আর কেএম দাশের কথা এখনও তার মনে পড়ে। উইং ছিল চারটা। আবুল হাশেম ছিলেন এক নম্বর উইংয়ে। ট্রেনিং শেষে শপথ হয় তুরাতে- ‘দেশের সাথে কোনও বেঈমানি করব না। দেশের জন্য যুদ্ধ করব। কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করব না।’ এমন শপথ করতে হয়েছে আবুল হাশেমদের।
তার ভাষায়, ‘এরপরই আমাদের সাতজনকে ইন্টিলিজেন্স ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় শিলং। সঙ্গে ছিল জিন্নত আলী বিশ্বাস, কিশোরগঞ্জের একজন, জামালপুরের এক প্রফেসর প্রমুখ। ১৪ থেকে ১৫দিন হয় ট্রেনিং। শিখলাম স্কেচ অব ম্যাপ, কোন পথে এসে কোন পথে যাব, বাহিনীকে নিয়ে এগোনোর কৌশল প্রভৃতি। ফিরে এসে বাগমারায় দিপক সাংমার কোম্পানিতে যুক্ত হই। দিপক সাংমা ছিলেন কোম্পানিটির কমান্ডার। ছিল তিনটা প্লাটুন। একেকটা প্লাটুনে ৩০জন। ৯০জন নিয়ে ছিল কোম্পানি। আক্রমণ করতে হতো রাতে, হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে। এগার নম্বর সেক্টরের অধীনে আমার যুদ্ধ করি- খিশা, শ্যামগঞ্জ পাবই, ঐক্যখালি,পূর্বধলা,মাইজপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।’
ভিডিও: একাত্তরে গুলিবিদ্ধ ও কানে চিনেজোঁক ঢুকে যাওয়ার ইতিহাস জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম
এক অপারেশনে হাতে গুলিবিদ্ধ হন এই সূর্যসৈনিক। এছাড়া তার ডান কানের ভেতর চিনেজোঁক ঢুকে যায়। ফলে সারাজীবনের জন্য ওই কান নষ্ট হয়ে গেছে।
কী ঘটেছিল রক্তাক্ত ওইদিনটিতে?
প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম আবেগতাড়িত হন। বুকে জমানো কষ্টগুলো তার অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। এক বীরের কান্না আমাদেরও স্পর্শ করে। তখন নিরব থাকি। অতঃপর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন ওইদিনের আদ্যপান্ত। তার ভাষায়-
‘আনুমানিক নভেম্বর মাসের ঘটনা। বাগমারা থেকে বাংলাদেশ অংশে তিন মাইল ভেতরে মাইজপাড়া। ওখানে পাকিস্তানি সেনারা মাইন পোতা শুরু করেছে। ওদের ফিরাতে হবে। যেন আর অগ্রসর না হয়। আমরা তখন বাগমারায়, ৩৫জনের মতো। দিপক সাংমা, আমি, রফিকসহ কয়েকজন বসে পরিকল্পনা করি। ওদের ফায়ার করে সরিয়ে দিতে হবে। দিনের বেলায় রওনা হয়েছি। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বেলা দুইটার দিকে মাইজপাড়ার কাছাকাছি চলে আসি। পাহাড়ি অঞ্চল। আমার অস্ত্র ছিল স্টেনগান। হেভি গান নিয়ে ওরাও প্রস্তুত ছিল। ওরা নিচের দিকে, আমরা একটু উঁচুতে। বিকালের দিকে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। আমাদের কাভারিং ফায়ার দেয় ভারতীয় আর্মি। আমার পজিশন ছিল একটা ঝোপের ভেতর। ফায়ার করছি। হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগে ডান হাতের গোড়ালির উপরে। রেঞ্জের বাইরে ছিলাম। গুলিটি তাই দুর্বল হয়ে সামান্য ক্ষত তৈরি করে। ক্ষত স্থানে রক্তও ঝরছিল। কিন্তু তখনও ফায়ার করছি। হঠাৎ অনুভব করলাম ডান কান দিয়ে কী যেন ঢুকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে কানের ভেতরটা ও মাথায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। কানের ভেতরটা কামড়ে ধরে। বুঝে যাই চিনেজোঁক কানে ঢুকে গেছে। যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কান দিয়েও রক্ত বেরুচ্ছিল। তখন এগিয়ে আসে সহযোদ্ধা জহির। আমাকে তুলে নিয়ে পাঠিয়ে দেয় মেঘালয়ের তুরাতে। তুরা হাসপাতালে কান থেকে চিনেজোঁক বের করে আনা হয়। সে থেকেই ডান কানে আর শুনতে পাই না। সারাজীবনের জন্য সেটি অকেজো হয়ে গেছে।
স্বাধীনের পরেও কান দিয়ে পুঁজ বেরুতো। গন্ধে কেউ সামনে আসতো না তখন। অসহায়ের জীবন ছিল ওটা। পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা চলে আমার। কিছুটা ভাল হলেও কান চুলকায় এখনও। পুঁজও পড়ে মাঝেমধ্যে। তখন খুব যন্ত্রণা হয়। এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি ভাই। আফসোস নাই কোনো। দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই বড় পাওয়া।’
অনেকেই তো মুক্তিযুদ্ধে যায়নি, আপনি কেন গেলেন?
আবুল হাশেমের উত্তর, ‘দেশের টানে। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ গেছে বেশি। রাইফেল পাবে আর সেটা চালাবে, বেঁচে থাকতে হবে আবার দেশও রক্ষা করতে হবে, দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে হবে- এমন নানা কারণে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল সবাই। তা না হলে এই জাতি পাকিস্তানি জাতিতে পরিণত হতো। বাঙালিদের রক্ত বিহারীদের রক্তের সাথে মিশে যেত।’
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সেই দেশ কি পেয়েছেন?
‘একটা স্বাধীন দেশের মানচিত্র পেয়েছি। তখন এটাই ছিল বড় স্বপ্ন। কিন্তু আমাদের রক্তে পাওয়া বাংলাদেশ যেমন হওয়ার কথা ছিল তেমন হয়নি। স্বাধীনতা লাভের পর যখনই শুনেছি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ থাকবে দেশে। তখন খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু কই সেটাও তো ঠিক থাকেনি। বরং স্বাধীন দেশে জাতির পিতাকেই মারা হলো। ইতিহাসকে করা হলো কলঙ্কিত। যে দেশে বঙ্গবন্ধু নাই সেই দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’
ভিডিও:স্বাধীনের পরের দেশ ও স্বপ্নের বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলছেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম
দেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়- ‘পঁচাত্তরের পর তো দেশে কোনও রাজনীতি ছিল না। জিয়াউর রহমান আর এরশাদের মতো মানুষ ছিল ক্ষমতায়। তখন খালি লুটপাট করেই নেতা বনে গেছে অনেকেই। ওই ট্রেডিশন এখনও কিছু রয়ে গেছে। এক কোটি টাকার মালিক হইছে কিন্তু অনেক নেতা এখনও চুরি আর দুর্নীতি ছাড়ে নাই। তাহলে দেশ কেমনে এগোবে?
কিন্তু বর্তমান সরকার তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে?
‘যদি শেখ হাসিনা বেঁচে থাকে। আমার বিশ্বাস দুর্নীতি মুক্ত দেশ হবেই। তবে আপনার আমার মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পলিটিক্স ইজ এ বিজনেস- রাজনীতিবিদদের মনে এটা থাকলে কিন্তু চলবে না। দেখবেন তাহলে এক সময় পলিটিক্সটা আর নাই, খালি বিজনেসটাই দেখা যাবে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে এই যুদ্ধাহতের ভাষ্য, ‘তালিকা বির্তকিত করার পেছনে কিছু মুক্তিযোদ্ধা আর থানা কমান্ডাররা দায়ী। টাকা নিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধা বাড়িয়েছে। বিএনপির আমলে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে অমুক্তিযোদ্ধাদেরও। বেইমানের দেশ, মিরজাফরের দেশ বানিয়েছিল তারা। আর একাত্তরে নেতারা যারা ভারতে গিয়ে ইয়ুথ ক্যাম্পে বসে বসে খেয়েছে, তারাও এখন মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। এখন এই তালিকা সংশোধন করার উপায় নাই ভাই।’
স্বাধীনতা লাভের পরপরই যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের মেরে ফেলা প্রয়োজন ছিল বলেন মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম। তার ভাষায়-
‘স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়া সুন্দর একটা সরকার গঠন কইরা, মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা ঠিক রাইখা মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা সম্পদ লুণ্ঠন করছে, নারী ধর্ষণ করছে, পাকিস্তান শব্দটারে ভালবাসছে- তাদেরকে শায়েস্তা করার একটা পদক্ষেপ নিলে ভাল হতো। আর তখনই কিছু মারোনের দরকার ছিল। হেই মারাটা মারল বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। সরকারেরও খরচ হইল কোটি কোটি টাকা। অথচ আমরা টিগার টানলেই তখন বিচার হইয়া যাইত। এ সুযোগটা আমগো দেয় নাই। এটা বঙ্গবন্ধুর দোষ দিলে হইব না। এইডা ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনী করতে দেয় নাই। সেই সুযোগে জেলায় জেলায় দোরা সাপগুলাও গোখরা সাপে পরিণত হইছে এই দেশে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগও খুব ভাল ছিল। কিন্তু চোরগো লাইগা পারছে না।’
ভিডিও: বঙ্গবন্ধুর কথায় অশ্রুসিক্ত হন মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আবুল হাশেম
শুধু চিকিৎসায় সহযোগিতাই নয় স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সুপারিশে শম্ভুগঞ্জ জুট মিলে চাকরি পান মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম। তাই বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ এই যোদ্ধা। অকপটে বললেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা। আজ যে এতো কিছু। এটা তো দেশ স্বাধীন না হলে হতো না। আর দেশ স্বাধীন হইছে বঙ্গবন্ধুর জন্যই। তার ঋণ কি আমরা শোধ করতে পারব! হজে গিয়া কাবায় বইসাও তার লাইগা কানছি। বলছি- আল্লাহ উনারে তুমি সম্মানের সাথে বেহেস্তে রাখ, শেখ হাসিনাকেও সুস্থ রাখ। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এটা স্বীকার করতেই হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়া উনার সঙ্গে আছে, থাকবেও।’
মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেমের বড় ছেলে মাসুম আহমেদ। জুডিশিয়াল পেশকার হিসেবে কাজ করছেন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, নেত্রকোণায়।
কেমন বাংলাদেশ চান, সে বাংলাদেশে আপনি কীভাবে যুক্ত থাকবেন?
মুচকি হেসে দৃঢ়তার সঙ্গে মাসুম বলেন ঠিক এভাবে, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত। চাকরি করি জুডিশিয়াল কোর্টে। ছোট ভাই অডিটর হিসেবে কাজ করছে নেত্রকোণা জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এগুলো লোভনীয় চাকুরি। তথাপি আপনি দেখছেন আপনাকে বসতে দেওয়ার মতো একটা ভাল চেয়ারও বাসায় নেই। কষ্ট করে চলি। তবুও বাবার আদর্শটা লালন করি এবং করব। চাই যে দেশের জন্য বাবা রক্ত দিয়েছেন। সেই স্বাধীন দেশটা দুর্নীতি মুক্তভাবে সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠুক। আমরা কাজের ক্ষেত্রে সৎ থাকব। এটাই প্রত্যয়। এটাই আমার কাছে দেশপ্রেম। আমরা প্রজন্ম চাই হানড্রেড পারসেন্ট দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ।’
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাল লাগার অনুভূতি জানতে চাই আমরা। উত্তরে এই যুদ্ধাহত আবুল হাশেম বলেন, ‘যখন আমাদের সন্তানেরা রাস্তায় জয়বাংলা স্লোগান দেয়, তখন আমি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি হই। জয়বাংলাকে ওরা ধরে রাখছে। এটা ভাবলেই বুকটা ভরে যায়।’
খারাপ লাগে কখন?
‘যখন প্রকাশ্যে জিন্দাবাদ স্লোগান শুনি। জিন্দাবাদ হইছে উর্দু শব্দ। আমরা তো জিন্দাবাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করেছি। একাত্তরে জয়বাংলার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছে। জয়বাংলা হলো আমার মাথার তাজ। তাহলে এদেশে কেন জিন্দাবাদের রাজনীতি চলবে?’
রাজনীতিতে ভালদেরও আসা উচিত বলে মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আবুল হাশেম। প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন, ‘দুর্নীতি থাকলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে না। তোমরা এই দেশটাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিও। শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর দলের প্রতি আস্থাশীল থেকো। মনে রেখ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে তোমরাই হবে প্রকৃত বীর।’
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শেখ মো. আবুল হাশেম।
ট্রেনিং: ভারতের তুরাতে উনত্রিশ দিন ট্রেনিং করেন।
যুদ্ধ করেছেন : এগার নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন খিশা, শ্যামগঞ্জ পাবই, ঐক্যখালি,পূর্বধলা,মাইজপাড়া প্রভৃতি এলাকায়।
যুদ্ধাহত : আনুমানিক নভেম্বর মাসের ঘটনা। মাইজপাড়া এলাকায় এক অপারেশনে তিনি ডান হাতের গোড়ালির উপরে গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়াও তার ডান কানের ভেতর চিনেজোঁক ঢুকে যায়। ফলে সারাজীবনের জন্য ওই কান নষ্ট হয়ে গেছে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৬ এপ্রিল ২০১৯
© 2019, https:.
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব শেখ মোঃ আবুল হাসেম বিগত ২৫.০৯.২০১৯ খ্রিঃ ভোর ৪.৪০ ঘটিকায় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া মৃত্যুবরণ করেন।