র্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি নয়
ধারণা করা হয় র্যাগিংয়ের উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম শতকে। তখন এটি প্রচলিত ছিল গ্রিসে। সেখানে কোনো ক্রীড়া দলে নতুন খেলোয়াড়ের আগমন ঘটলে তার মধ্যে কতটা একতাবোধ রয়েছে তা জানতে আর টিম স্পিরিটের বীজ বপন করতে দলের সিনিয়ররা তাকে নানাভাবে উপহাস, নানা পরীক্ষা এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তি যাচাই করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির অনেক পরিবর্তন ঘটে। এক সময় সৈন্যদলগুলোর ভেতরও এটির প্রচলন ঘটে।
স্বপ্ন আর আশা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বড় মানুষ হতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে, আরও কত-শত স্বপ্ন থাকে মনে। তাদের সেই স্বপ্নগুলোতে ক্ষত তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সিনিয়র শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসে নতুন শিক্ষার্থীদের চলতে-ফিরতে বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হতে হয় সিনিয়রদের ভয়াবহ র্যাগিংয়ের। কখনো দলবদ্ধভাবে কিংবা দু-একজন সিনিয়র মিলে জুনিয়রদের নানারকম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করে। এমন অসভ্যতা করেই তারা ক্ষান্ত হয় না, উপরন্তু একশ্রেণির ওই সিনিয়র শিক্ষার্থীরা দাবি করে, ‘র্যাগিং’ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি সাধারণ ঘটনা এবং এটা সিনিয়রদের অধিকারের মধ্যে পড়ে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত র্যাগিংয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালানো হয় প্রথম বর্ষের দুই শিক্ষার্থীর ওপর। এর ভিডিওচিত্রও তারা ধারণ করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। ফলে সেটি ভাইরাল হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দ্বিতীয় বর্ষের ছয়জন শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়।
বড় স্বপ্ন নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল ফাহাদ। কিন্তু নবাগত হওয়ায় র্যাগিংয়ের নামে সিনিয়ররা তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। বাবা-মাকে নিয়ে গালাগালও শুনতে হয় তাকে। ফলে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ভয়ে সে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পালিয়ে যায়। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সময় ফেইসবুকে ফাহাদের দেওয়া স্ট্যাটাসটি ছিল এমন, ‘আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, র্যাগিংয়ের প্রভাব যেন আর কোনো মা-বাবার ওপর না পড়ে। আমি নিজের মর্যাদাহানি করতে পারব, কিন্তু আমার মা-বাবাকে অপমানিত হতে দেব না। তাই আমার স্বপ্নকে ছাড়তে রাজি হলাম। বিদায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।’
একই বছরে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের নামে অর্ধনগ্ন করে শৌচাগারে সেলফি তুলতে বাধ্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র পাঁচ শিক্ষার্থী। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পরে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। র্যাগিংয়ে পিছিয়ে নেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ও। সেখানে এক নবীন শিক্ষার্থী সিনিয়রদের হাতে এতটাই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল যে, পরবর্তী সময়ে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কয়েক মাস নিজের বাবা-মাকেও চিনতে পারছিল না। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রকে র্যাগ দেওয়ার নামে বৃষ্টির মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পরে সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
উল্লিখিত র্যাগিংয়ের সংবাদগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে নেওয়া। এখানে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তুলে ধরা হলেও র্যাগিংয়ের ঘটনা এখন ক্রমেই বাড়ছে এবং প্রায় সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রকাশ্য না হওয়ায় অনেক ঘটনা অজানাই থেকে যায়। সিনিয়রদের কাছ থেকে পাওয়া এমন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে, অপমানে অনেক শিক্ষার্থীই মুষড়ে পড়ে। এর প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন মানসিক ট্রমা থেকে বেরুতে পারে না। ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় তাদের জীবন। এর দায় আসলে কে নেবে?
একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের একেক নাম। ‘মুরগি বানানো’, ‘ম্যানার শেখানো’ কিংবা ‘ফাঁপর দেওয়া’ প্রভৃতি। মূলত ‘র্যাগিং’ নামে যা করা হয় তা অমানবিক ও নিন্দনীয়। নবীনদের বাবা-মা বা জেলা বা উপজেলার নামে গালিগালাজ ও হেয় করা, বিভিন্ন অপমানজনক কাজে বাধ্য করা, সিনিয়র কাউকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেওয়া, শীতের রাতে পুকুরে নামিয়ে গোসল করানো, শীতে খালি গায়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে উঠবস করানো, গায়ে হাত তোলা, ইভটিজিং-অ্যাডামটিজিং, এমনকি যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটে।
ধারণা করা হয় র্যাগিংয়ের উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম শতকে। তখন এটি প্রচলিত ছিল গ্রিসে। সেখানে কোনো ক্রীড়া দলে নতুন খেলোয়াড়ের আগমন ঘটলে তার মধ্যে কতটা একতাবোধ রয়েছে তা জানতে আর টিম স্পিরিটের বীজ বপন করতে দলের সিনিয়ররা তাকে নানাভাবে উপহাস, নানা পরীক্ষা এবং শারীরিক ও মানসিক শক্তি যাচাই করত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির অনেক পরিবর্তন ঘটে। এক সময় সৈন্যদলগুলোর ভেতরও এটির প্রচলন ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর র্যাগিং সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। ক্রমেই এটি আগের চেয়ে অনেক সহিংস ও নৃশংস হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই সৈন্যদলে নাম লেখায়। সেখানে গিয়েই তারা র্যাগিংয়ের সহিংস রীতিনীতির মুখে পড়ে। যুদ্ধ শেষে যখন তারা আবার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে, তখন তাদের হাত ধরেই সৈন্যদলের র্যাগিংরীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়ে। শুরুতে শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিংয়ের নামকরণ করা হতো বিভিন্ন গ্রিক বর্ণ- আলফা, ফি, বিটা, কাপা, এপসাইলন, ডেল্টা প্রভৃতির নামানুসারে। এদের বলা হতো গ্রিক লেটার অর্গানাইজেশন। তখন নবাগতদের কিছু সাহসিকতা, শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নিয়েই ছেড়ে দেওয়া হতো। এটি ছিল অগ্রজদের সঙ্গে অনুজদের বন্ধন সুদৃঢ় করার একটি উপায়। কিন্তু এক পর্যায়ে তা প্রাণঘাতি অপসংস্কৃতিতে রূপ নেয়।
বর্তমানে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগিংয়ের একটা বিশেষ দিকও রয়েছে। এটা ক্ষমতার দম্ভ এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা। দেখা যায়, যারা র্যাগিংয়ের নেতৃত্ব দেয় তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ফলে তাদের ভয়ে অনেকেই মুখ খুলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে সরব নয়। ফলে বর্তমান সময়ে র্যাগিং আরও কলুষিত রূপ ধারণ করেছে। কেউ কেউ আবার এগুলোকে মেনেও নেয়। যে কারণে যারা র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে পরের বছর তারাই যখন সিনিয়র হয়, তখন নিজেরাও জুনিয়র শিক্ষার্থীদের র্যাগ দিতে উদ্বুদ্ধ হয়। এভাবেই এই নেতিবাচক সংস্কৃতি এক ব্যাচ থেকে আরেক ব্যাচে ছড়িয়ে পড়ে এবং ‘ক্যাম্পাস-কালচার’ হয়ে ওঠে।
র্যাগিংয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলে ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ২০০৯ সালে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে র্যাগিং বন্ধে কঠোর নির্দেশনা জারি করে। এছাড়া তারা একটি টোল ফ্রি হেল্পলাইনও চালু করেছে, যেখানে কল করে র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারে। ভারতের মতো হেল্পলাইন কার্যক্রমটি আমাদের দেশেও দ্রুত চালু করা প্রয়োজন।
‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি’ হবে তারুণ্যের সৃজনশীলতা বিকাশের সংস্কৃতি, তারুণ্যের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চৈতন্য বিকাশের সংস্কৃতি। ‘র্যাগিং প্রথা’ কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে র্যাগিংয়ের শাস্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই। তাই র্যাগিংকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রচারণা ও সচেতনতা কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্রিয়াশীল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোকে র্যাগিং বন্ধে স্পষ্ট ও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৬ জুন ২০১৯
© 2019, https:.