যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদের কী হবে
সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর মালিকানাধীন ধানম-ির কেয়ারি লিমিটেডের তিনটি ফ্ল্যাট এবং ১১টি দোকানের মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবর এসেছে! যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করার দাবি তরুণ প্রজন্ম, মুক্তিযোদ্ধা ও সচেতন শ্রেণির। এ বিষয়ে সচেষ্ট থেকেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দায়িত্বশীলরাও। তা সত্ত্বেও এ সরকারের আমলেই কারা যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তির মালিকানা পরিবর্তনের কাজটি করছে? এ বিষয়ে কেন নীরব মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়? এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে অনেকেরই মনে।
যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মানবতাবিরোধী অপরাধ কি আমরা ভুলে গিয়েছি? একাত্তরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি যুক্ত ছিলেন কাসেম আলী। পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে হত্যার কার্যক্রমে যুক্ত থাকায় ‘বাঙালি খান’ হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিল মীর কাসেম আলী। তার নির্দেশে ১৯৭১-এ চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলকে নির্যাতন কেন্দ্র বানিয়ে সেখানে নির্মম নির্যাতন চালানো হতো মুক্তিকামী মানুষের ওপর। স্বাধীনতা লাভের মাত্র এক দিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর ডালিম হোটেল থেকেই লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল ৩৫০টি। বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়নেও যুক্ত ছিল এই যুদ্ধাপরাধী।
স্বাধীনতার পর আত্মগোপনে চলে যান কাসেম। তখন নিষিদ্ধ হয় ছাত্রসংঘ ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিও। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জামায়াতের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনিও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। পরে তার হাত ধরেই ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাতা পায়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ (মজলিসে শুরার) সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মীর কাসেম। তার পরিচিতি ছিল জামায়াতে ইসলামীর অর্থের জোগানদাতা হিসেবে। ১৯৮৩ সালে এরশাদ সরকারের আমলে তার প্রাতিষ্ঠানিক উত্থান হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠনের মাধ্যমে। অতঃপর চিকিৎসাসেবা, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম, শিক্ষাসহ সব খাতেই ব্যবসার ডালপালা ছড়াতে থাকে তার। ইবনে সিনা ট্রাস্ট, দিগন্ত মিডিয়াসহ বেশ কিছু ব্যবসায়িক গ্রুপের উদ্যোক্তাও তিনি।
২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন মীর কাসেম। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তার ফাঁসি এবং আটটি অভিযোগে কারাদণ্ড হয়। তার বিরুদ্ধে আদালতে প্রমাণিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো এক দিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা এবং নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে নির্যাতন কেন্দ্র ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। জসিমকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয় তারা। এই অপরাধে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া আরও ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৫৮ বছরের কারাদ-ের রায় হয় কাসেমের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানকে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার দিয়েছিলেন মীর কাসেম। উচ্চমূল্যে টবি ক্যাডম্যানের সঙ্গে চুক্তি করে দেশি-বিদেশি মহলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে নেতিবাচক প্রচারও চালান যুদ্ধাপরাধী এবং এই জামায়াত নেতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় শত শত লোককে যিনি হত্যা করেছিলেন, এ দেশের স্বাধীনতাকে যিনি স্বীকার করেননি, এ দেশের বিচার বিভাগ তথা সরকারকে সারা পৃথিবীর কাছে হেয় করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন যিনি, সেই কাসেম আলীর সম্পদ রক্ষায় কাজ করছে কারা?
‘মীর কাসেম আলীর ১৪টি ফ্ল্যাট-দোকানের মালিকানা পরিবর্তন’ শিরোনামে ২৩ আগস্ট বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ২৪ এপ্রিল ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার দ্বীপক কুমার সরকার ‘মীর কাসেম আলী ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর এবং দলিল রেজিস্ট্রেশন না করা প্রসঙ্গে’ নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি পাঠান। এ বিষয়ে জানানো হয় আইন মন্ত্রণালয়কেও। আইনমন্ত্রী যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ হস্তান্তর, দলিল রেজিস্ট্রি না করার নির্দেশ দেন। ফলে ২০১৮ সালের ১৯ জুন নিবন্ধন পরিদপ্তরের মহাপরিদর্শক খান মো. আবদুল মান্নান ‘যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী ও তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের জমি বিক্রি বা কোনো প্রকল্প হস্তান্তর না করা প্রসঙ্গে’ আদেশ জারি করেন। আদেশটি সারা দেশের সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি অ্যান্ড ফার্মস এবং মানি এক্সচেঞ্জে পাঠানো হয়। তা সত্ত্বেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মীর কাসেমের সম্পদ হস্তান্তরে তৎপর ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অধিশাখা-৭-এর দুই কর্মকর্তা। সম্পদ হস্তান্তর ও নাম জারির বিষয়ে গত বছরের ২৯ নভেম্বর থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ জারি করে তারা কাসেম আলীর তিনটি ফ্ল্যাট ও ১১টি দোকান হস্তান্তরের ব্যবস্থা করেছে।
এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এ বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের সম্পদ হস্তান্তর, বিক্রি এবং দলিল রেজিস্ট্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এসব হস্তান্তর হয়েছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন তার মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি এড়াল, তা তিনি স্পষ্ট করেননি! মীর কাসেমের দুটি ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয় গত ২৯ জানুয়ারি। গণমাধ্যমে ধানমন্ডি এলাকার সাব-রেজিস্ট্রার বলেছেন, “সম্পদের কোথাও ‘যুদ্ধাপরাধীর সম্পদ’ লেখা নেই। তাই দলিল রেজিস্ট্রিতেও বাধা নেই।” যদি তাই হয়, তাহলে এই নির্দেশনার বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় বা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন দৃষ্টি দিল না? কেন আইনের ফাঁকফোকর রেখে সরকারি নির্দেশনা জারি করা হলো?
মীর কাসেম আলীর মতো যুদ্ধাপরাধীরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে টাকা কামানোর পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার সুযোগে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসার মালিকানা নিয়ে হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে তাদের। যুদ্ধাপরাধীদের ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আয়কর রিটার্নে যেসব সম্পদের কথা বলা হয়েছে, সেটিই ছিল হাজার কোটি টাকার সমান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদের মালিক যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলী। তারা কীভাবে এত বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, তাদের অর্জিত অর্থ কোথায়, কীভাবে ব্যয়িত হচ্ছে, সেটি এখনো অজানা রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও হস্তান্তর রহিতকরণে স্পষ্ট নির্দেশনা জারি হওয়া প্রয়োজন। তাই নির্বাহী আদেশে বা প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে মীর কাসেমসহ দণ্ডিত সব মানবতাবিরোধী অপরাধীর সম্পদ বাজেয়াপ্ত বা হস্তান্তর রহিত করতে হবে। সরকারি যেসব সম্পত্তি এখনো যুদ্ধাপরাধীদের নামে রয়েছে, নির্বাহী আদেশে সেগুলোও বাজেয়াপ্ত করতে হবে। মীর কাসেম আলীর মতো যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ রক্ষায় বা হস্তান্তরে ভেতর থেকে কারা কাজ করছেন তা বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ২৮ আগস্ট ২০১৯
© 2019, https:.