এ দেশে ভ্রমণপিয়াসু মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অবসর মিললেই সবাই ছোটে প্রকৃতির টানে। কেউ পাহাড়ে, কেউ সমুদ্রে, কেউ চা বাগানে। কেউ আবার নৌকা ভাসায় হাওরের বুকে। ছোট ছোট অ্যাডভেঞ্চার গ্রুপের সংখ্যাও কম নয়। অজানা সব স্থান খুঁজে সেখানকার অপরূপ দৃশ্য অবগাহন করে তৃপ্ত হয় তারা। এভাবে তাদের মাধ্যমে ভ্রমণের নতুন নতুন জায়গার খোঁজ পাই আমরা। ডিজিটাল এ যুগে ভ্রমণপাগল এই মানুষদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য গ্রুপ, পেজ ও হেল্পলাইন। সেখানে ভ্রমণের নানা ইভেন্টগুলোতেও অংশ নিচ্ছে অসংখ্য ভ্রমণপিয়াসুরা, যা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকেই স্পষ্ট করে।
ঋতুবৈচিত্র্যে আমাদের দেশ অপরূপ। শীতে যে পাহাড় দেখলে শুষ্ক ও রুক্ষ মনে হয়; বর্ষার পর সেসব পাহাড়ই সবুজতায় স্নিগ্ধ ও সজীব হয়ে ওঠে। মানুষ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যের যেমন শেষ নেই, তেমনি এ দেশে ঘুরে বেড়ানোর জায়গারও অভাব নেই। একেক জায়গার
প্রকৃতি, মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার আমাদের মনকে একেকভাবে স্পর্শ করে। ভ্রমণের সে মনছোঁয়া অনুভূতিগুলো ছবিসহ মানুষ এখন প্রকাশ করছে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটারসহ সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফলে ভ্রমণে আগ্রহীর সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি দ্রুত প্রচার পাচ্ছে পর্যটনের নতুন নতুন স্থানগুলো। কিন্তু পর্যটনের এই সম্ভাবনার যুগে পর্যটন মন্ত্রণালয় কতটা সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে? চলুন সেদিকটাতে একটু চোখ ফেরাই।
দেশের ভেতর কোথাও ঘুরতে যেতে কিছু তথ্য আগেই জেনে নিই আমরা। কীভাবে যাওয়া যায়, কোন সময় যেতে হয়, থাকার জায়গা কেমন ও কোথায়, খাবারের ব্যবস্থা কেমন, নিরাপত্তাজনিত সমস্যা আছে কি না, থাকলে সমাধানে কোথায় যোগাযোগ করতে হবে, ভ্রমণ কতটা ব্যয়বহুল প্রভৃতি। উত্তরগুলো খুঁজতে প্রথম সবাই গুগল ও ফেইসবুকে ভ্রমণ গ্রুপগুলোর সহযোগিতা নেয়। ইউটিউবে ওই জায়গার ভিডিও কেউ আপ করে থাকলে সেটিও বিবেচনার অংশ হয়। অথচ সরকারের ডিজিটাল এ যুগে ভ্রমণের এসব তথ্যের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জায়গা হওয়ার কথা পর্যটন মন্ত্রণালয় বা তাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন করপোরেশনের। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। সাধারণের কাছে পর্যটনসেবা হিসেবে নানা স্থানে ভ্রমণের তথ্যগুলো উপস্থাপনে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রচারণা কার্যক্রম আমরা খুব একটা দেখি না। পাশাপাশি এদের অয়েব পোর্টালগুলোতেও হালনাগাদ তথ্য নেই। ফেইসবুক পেজ, টুইটার ও ইউটিউব চ্যানেল থাকলেও তা চলছে দায়সারাভাবে। ভ্রমণের নিয়মিত পোস্ট বা প্রমোশন নেই সেখানে। যখন লিখছি তখন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ইউটিউবে পোস্ট সর্বমোট চারটি আর সাবস্ক্রাইবের সংখ্যা মাত্র ১৬। যেখানে পর্যটন মন্ত্রণালয়ই সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে প্রচার কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে সেখানে এ দেশের ভ্রমণের জায়গাগুলোর কথা দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে পৌঁছাবে কীভাবে?
ভ্রমণ নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগগুলো যখন সম্ভাবনার কথা বলছে, তখন তা বাস্তবায়নে যাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার কথা তারা চলছে উল্টো পথে। তাই পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উচিত জরুরি ভিত্তিতে দেশে ভ্রমণের নানা স্থানের তথ্য নিয়ে নির্ভরযোগ্য ডেটা ব্যাংক তৈরি এবং তা মানুষের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া। বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা কতটুকু? বর্তমানে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন বাজারের মধ্যে অন্যতম। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের এক গবেষণা বলছে ‘২০১৪ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই বছর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর এ দেশে কর্মসংস্থান গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। সে হিসেবে ২০২৪ সালে মোট কর্মসংস্থানের মধ্যে পর্যটন খাতের অবদান দাঁড়াবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ।’ বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা এখন প্রায় ১০০ কোটি। ২০২০ সাল নাগাদ তা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এই বিশাল বাজারে টিকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার। যেখানে ভারত আয় করেছে ১০ হাজার ৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপ ৬০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার এবং নেপালে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার।
পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরিবহন, যোগাযোগ, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট ও নিরাপত্তার বিষয়টি। তাই আমাদের উচিত সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ হাতে নেওয়া। পাশাপাশি নতুন নতুন স্থানকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া ভ্রমণ এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকদের সঙ্গে ভালো আচরণ ও পরিবেশ রক্ষা বিষয়েও সচেতনতা তৈরিতে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগী ভ‚মিকা নেওয়াও প্রয়োজন। ২০১৮ সালে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের একটি পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ২০০টি শহরের মধ্যে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পর্যটকরা ভ্রমণ করেছেন সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া পর্যটকদের কাছে বিশ্বের জনপ্রিয় শহরগুলোর মধ্যে হলো প্যারিস, দুবাই, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, নিউ ইয়র্ক, ইস্তাম্বুল ও টোকিও উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে পর্যটকরা সবচেয়ে বেশি খরচ করেছেন দুবাই, সৌদি আরব ও ব্যাংককে। তাই ভ্রমণপিপাসুদের আকৃষ্ট করতে আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণে প্রাণান্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিভিন্ন দেশ। সেখানে আমরা রয়েছি অনেক পিছিয়ে।
এ দেশে পর্যটন এলাকাগুলোতে পরিবহন, হোটেল ও খাওয়ার উচ্চমূল্য নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ একেবারেই নেই। অনেকেরই ধারণা সাজেক, কক্সবাজার ও বান্দরবানে থাকা ও যাওয়া-আসায় যে খরচ পড়ে, সেই খরচে বা তার চেয়ে কমেই ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আসা যায়। ফলে ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে ভারত ভ্রমণের প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মিনিস্ট্রি অব ট্যুরিজম, ইন্ডিয়ার এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভ্রমণ করেছে ২২ লাখ পর্যটক। অথচ ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখের মতো। কিন্তু আমাদের দেশে প্রতি বছর কতজন পর্যটক কোন কোন দেশ থেকে আসছে, তার পূর্ণাঙ্গ কোনো ডেটা নেই পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে। তাই এই ডেটা সংরক্ষণসহ দেশি ও বিদেশি পর্যটকরা যেন এ দেশের পর্যটন থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেন, সে কারণে এখনই ভ্রমণ এলাকাগুলোতে সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রত্ন স্থান রয়েছে। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, এ প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো বিশ্বজুড়ে পরিচিত করতে পারলে বিশ্ব পর্যটনের নতুন গন্তব্য তৈরি হতে পারে বাংলাদেশে। এ বিষয়েও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
আবার বর্তমান সরকার নারীদের ক্ষমতায়নে গুরুত্ব দিলেও আমাদের পর্যটনশিল্প এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। নারী এখন সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পুরুষের মতো তারাও বেরিয়ে পড়তে চায় তাদের পছন্দের জায়গায়। কিন্তু শুধু নারীদের হোটেল ভাড়া দেওয়া এবং নিজের মতো তাদের ভ্রমণের নিরাপত্তা কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। পর্যটন এলাকাগুলোকে আরও বেশি নারীবান্ধব করতে পৃথক ও পরিচ্ছন্ন বিশ্রামাগার এবং নিরাপত্তার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পর্যটনে অধিকসংখ্যক নারী কর্মীদের নিয়োজিত করাও যেতে পারে। পর্যটন এলাকায় নারীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে পারলে বিদেশি নারী পর্যটকরাও এ দেশে আসতে আগ্রহী হবে। এটি সার্বিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ আকর্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের মানসিকতার যেমন পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন, তেমনি সরকারের পরিকল্পনা ও উদ্যোগও হাতে নিতে হবে।
আমাদের পাশের দেশগুলো পর্যটনশিল্পকে প্রাধান্য দিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করছে। পর্যটনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও বেসরকারি উদ্যোগ ও ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ পর্যটনের পথে সফলতাকেই ইঙ্গিত করে। নতুন নতুন পর্যটন এলাকা তৈরি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পর্যটন এলাকা নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা, পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নারীবান্ধব পর্যটনশিল্প গড়ে তুলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ৫ অক্টোবর ২০১৯
© 2019, https:.