একাত্তরে বীরের জাতি ছিলাম, পঁচাত্তরে হয়েছি নিমকহারাম জাতি
বীরপ্রতীক সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল
বাবা তখন আওয়ামী লীগ করতেন, দুমোট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি যোগ দিই ছাত্র ইউনিয়নে, মতিয়া গ্রুপে। জামালপুর মহকুমার শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলাম। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ সাল। সকল আন্দোলনেই যুক্ত থেকেছি।
মতিয়া চৌধুরী খুব জ্বালময়ী বক্তৃতা দিতেন। এ জন্যই নাম হয় অগ্নিকন্যা। তখন এগার দফা বাস্তবায়নে জামালপুরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেটার সক্রিয় সদস্যও হই তখন। কিন্তু গোটা জামালপুরে এগার দফা আন্দোলনটা চোরপোড়ানো আন্দোলনে রূপ নেয়। সে সময় খুব চোরের উৎপাত শুরু হয়। গ্রামের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে চোর ধরেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারত। চোরপোড়ানো ঠেকাতে মাঠে নামি আমরা। এরপরই এগার দফা দাবী নিয়ে মিছিল মিটিং চলে জামালপুর শহরে।
এক সময় দাবীগুলো সহিংস আন্দোলনে রূপ নেয়। পাকিস্তান সরকার তখন মার্শাল ল জারি করে। জামালপুরে আমরা বারোজন মার্শাল ল ব্রেক করি। কামালতোরা মোড়ে ছাত্র ইউনিয়নের অফিস থেকে এন্টি মার্শাল ল স্লোগান দিয়েই মিছিল নিয়ে এসডিও’র বাড়ি পর্যন্ত যাই। পরে অ্যারেস্ট হয় ফয়জুর রহমান, মাহবুবুর রহমান আনসারি, তপন দেব, সুবীর চৌধুরী, সুকুমার চৌধুরী, শাহ নেওয়াজ, খায়রুল, হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
জামালপুরে বামপন্থি নেতা ছিলেন রবী নিয়োগী। আন্দামানে জেল খেটেছেন তিনি। রবীদা যা বলতেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। ন্যাপের সভাপতি তখন তাসির উদ্দিন। তার ছেলে আলী আসাদ কালাখোকা, শেখ মুজিবের বন্ধু ছিলেন তিনি। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন শাহবুদ্দিন, ইসহাক আলী, সিদ্দিকুর রহমান প্রমুখ। অন্য দলগুলোর সাথে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আন্দোলনের স্বার্থে সবাই এক হয়ে যেতাম। একবার এসেছিলেন মওলানা ভাসানী আর মনি সিংহ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন দ্বিমত তখন ছিল না। তার নেতৃত্বেই কিছু একটা হবে- এ বিষয়ে সবাই আস্থাশীল ছিলাম।
১৯৭০-এর নির্বাচনে কাজ করি ন্যাপের পক্ষে। বন্ধু সুকুমার চৌধুরীসহ দায়িত্ব পরে সিরাজগঞ্জে, ন্যাপের সাইফুল ইসলামের ক্যাম্পিং করার। ওখানে উনি ছিলেন এমএনএ ক্যান্ডিডেট। আমাদের ওখানে ক্যান্ডিডেট ছিল না। নির্বাচনে ন্যাপ না জিতলেও আওয়ামী লীগ সারাদেশে সংখ্যাগিরষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তবুও বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ফলে সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
জামালপুরে কাজিমুদ্দিন অ্যাভোকেট ছিলেন মুসলিম লীগের সভাপতি। জামায়াতে ইসলামির নেতা মক্তব কবিরাজ, ইসলামি ছাত্র সংগের আশরাফ আর কামরুজ্জামান, স্টুডেন্ট ফ্রন্টে ছিল মান্নান।
কলেজে পিএনসিসি (পাকিস্তান ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) করতাম। রাইফেল চালানোটা ওখানেই শিখি। তখনই বুঝি গিয়েছিলাম সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যাচ্ছে দেশ। বোমা বানানো শিখলাম। এ কাজে ক্যামেস্টির টিচাররা সাহায্য করতেন। জামালপুর হাই স্কুল মাঠে চলে রাইফেল ট্রেনিংও। সেখানে অংশ নেয় শতাধিক যুবক। আনসার অ্যাডজুটেন্ট কবির চাচা ট্রেনিং করায়। সর্ব দলীয় কমিটির মাধ্যমে ট্রেনিং পরিচালিত হতো। ওই কমিটিরও সক্রিয় সদস্য ছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটি আমরা শুনি রেডিওতে। তিনি বললেনÑ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো…সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারব না….রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব-এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।’ সবকিছু তখনই ক্লিয়ার হয়ে যায়। বুঝে যাই, সঠিক পথেই আছি আমরা। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া মুক্তির পথ নেই।”
মুক্তিযুদ্ধের আগে জামালপুরের নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য তিনি বীরপ্রতীক খেতাব লাভ করেন, যুদ্ধেও আহত হয়েছেন। কিন্তু তবুও নেন না কোনো যুদ্ধাহত ভাতা। সত্তর বছর বয়সী এই বীর ক্যান্সারে আক্রান্ত। স্বাধীনতার জন্য একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন। এখন যুদ্ধ করছেন নিজের শরীরের সঙ্গে। ক্যান্সার কাবু করতে পারেনি তাকে। একাত্তরে মরতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে চলছে তার বোনাস লাইফ- এমনটাই মনে করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলায় ক্লান্তি নেই এই যোদ্ধার। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় নানা বিষয় নিয়ে।
সৈয়দ বদরুজ্জামান ও সৈয়দা খোদেজা জামানের বড় সন্তান সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল। সবাই ডাকে হেলাল বলেই। পূর্বপুরুষদের আমল থেকেই অগাধ সম্পত্তি তাদের। বাবা প্রচুর দান খয়রাত করতেন। ফলে সমাজে নামডাক ছিল অনেক। তাদের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট গ্রামে।
হেলালের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কলাবাদা প্রাইমারি স্কুলে। ক্লাস ফাইভ পাশের পর তিনি ভর্তি হন কলাবাদা হাই স্কুলে। মেট্রিক পাশ করেন ইসলামপুরের নেক জাহান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, ১৯৬৫ সালে। এরপর জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ওখানেই ডিগ্রিতে ভর্তি হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
এই বীরপ্রতীক বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করেন ঠিক এভাবে- ‘লেখাপড়া মন বসতো না। খেলাধুলা করতাম খুব। ফুটবল আর অ্যাথলেটিক্স ছিল প্রিয়। সিনিয়রদের সামনে দিয়ে সহজে যেতাম না। বড়দের প্রতি অন্যরকম শ্রদ্ধা ছিল তখন। কোন বিষয়ে কোন ছাত্র যদি উইক থাকত তখন শিক্ষক সপ্রণোদিত হয়ে তার বাড়িতে গিয়ে পড়ায়া আসতো। আজকে প্রাইভেট ছাড়া লেখাপড়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। মানুষ আগে সহজ সরল ছিল। সবাই এখন আত্মকেন্দ্রিক। শিশু ধর্ষনের কথা চিন্তাও করা যেত না। উন্নত হয়েছি সত্য। কিন্তু মানবিক জায়গায় আমাদের উন্নতিটা হয়নি তেমন।’
২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। লোকমুখে সে খবর পান হেলালরা। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আশ্রয় নিতে আসে জামালপুরে। সবার মুখে মুখে আর্মি আসার খবর। জামালপুর দখল হয়ে গেলে হেলালরা শহর ছেড়ে চলে যান গ্রামে।
পাকিস্তানি সেনারা জামালপুর শহরে প্রথম ঘাঁটি গাড়ে। অতঃপর বিভিন্ন এলাকায় মুভ করা শুরু করে। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে শান্তি কমিটির লোকেরা। আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন হেলাল। আর্মিরা পেলেই মেরে ফেলবে তাকে। তাই পরিবারের সম্মতিতেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঘর ছাড়েন। মোখলেসুর রহমান আনসারীসহ চলে যান ভারতের মহেন্দগঞ্জে।
এরপর কী ঘটলো- সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে।
তার ভাষায়, “প্রথমে মহেন্দগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে গিয়ে উঠি। এরপর ওখানে রিক্রুট শুরু হয়। এর দায়িত্বে থাকে মেইনলি ছাত্রলীগের ছেলেরা। ছিলেন ভিপি রিয়াজুল, সাবেক ভিপি সুলায়মান আর ছাত্রলীগের সেক্রেটারি সিদ্দিক। নাম লিখে ওরা পাঠাত জামালপুরের এমএনএ আব্দুল হাকিমের কাছে। উনি রিকমেন্ড করলে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ইয়ুথ ক্যাম্পে। সেখানে প্রাথমিক ট্রেনিং করিয়ে দুই সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হতো তুরাতে। এটাই ছিল সিসটেম।
ফাস্ট ব্যাচ রিক্রুট হয়ে গেল। যেতে পারলাম না। দাঁড়ালেই ছাত্রলীগের ওরা রিজেক্ট করে দেয়। বলে- ‘তোমাদের নেওয়া হবে না।’
পাশেই ছিল শরণার্থী ক্যাম্প। ঘটনাটি দেখে ক্যাম্পের লোকেরা চড়াও হয়। তখন আমাদের নিতে বাধ্য হয়।
মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পটি কন্ট্রোল করতো বিএসএফ। আমি পিএনসিসি করতাম। তাই রাইফেল ট্রেনিং আগেই ছিল। সুুকুমার চৌধুরীকে প্লাটুন কমান্ডার আর আমাকে করা হয় সেকশন কমান্ডার। পরে সুকুরমার অসুস্থ হলে আমি প্লাটুন কমান্ডার হয়ে যাই। ১০ দিন পর ক্যাপ্টেন নেগি (নিয়োগি) আমাকে কোম্পানি কমান্ডার বানিয়ে দেন। ১০০জনে ছিল এক কোম্পানি। ওই ক্যাম্পে ট্রেনিং করান হাবিলদার ধন বাহাদুর সিং।”
এরপর কি হায়ার ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলেন?
“না। তুরা থেকে একটা ব্যাচ ফিরে আসলে ওদের মুখে শুনলাম ওখানে জোক খুব বেশি। জোক ভয় পাই। বিষয়টি ধন বাহাদুরকে বললাম। উনি বললেন, ‘যুদ্ধ করতে করতেই বাকী ট্রেনিং হয়ে যাবে। তুমি পরে যেও। ক্যাম্পেই উনি আমায় ট্রেনিং করান প্রায় মাসখানেক। আমার কোম্পানিটা হায়ার ট্রেনিংয়ে চলে গেলেন সেখানে যুক্ত হয় তুরা থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা একটি গ্রুপ। তখন হই ১৭৪জন। ম্যাকসিমাম ছেলেই ছিল ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ আর ধানুয়া কামালপুরের।”
জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর। এখানকার বিওপি এলাকায় প্রায় দেড়শ সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি বেলুচ রেজিমেন্ট শক্ত ঘাঁটি গাড়ে। চারদিকে মোটা গাছের গুঁড়ি ও কংক্রিটের সাহায্যে তারা গড়ে তুলে দুর্ভেদ্য বান্কার। তাদের সঙ্গে ছিল রাজাকাররাও।
৩১ জুলাইয়ের কথা। ফাস্ট ও এইট বেঙ্গল এসে কামালপুর অ্যাটাক করে। সেখানে ম্যাসাকার হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজমহ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩৫ জন সোলজারও শহীদ হয়েছিল। এরপরই সেখানে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয় হেলালকে। ওটা ছিল তার প্রথম অপরেশন।
কেমন ছিল সেই যুদ্ধটি?
তিনি বলেন- “অগাস্টের ৯ তারিখ হবে। ক্যাপ্টেন নেগি (নিয়োগি) এসে ফলইন করিয়ে বললেন উঠানিপাড়া নামক জায়গায় তুমি অ্যাম্বুশ করে থাকবে। কাউকে ঢোকার সুযোগ দিবে না। অন্যান্য কোম্পানি তখন কামালপুর অ্যাটাক করবে। এসএমজিতে তিনটা ব্রাস্ট হলেই বুঝবা কামালপুর দখল হইছে। তখনই তোমরা অ্যাডভান্স করবা। এই ছিল নির্দেশনা।
৩৭জন নিয়ে দুপুরের ভেতরই চলে গেলাম। সঙ্গে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ৬টা শেল্ফ লোডেড রাইফেল, একটা এলএমজি, একটা এসএমজি। উথানিপাড়ায় অ্যাম্বুশ করে বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে যায়। কিন্তু কোনো সিগনাল নাই। গুরি গুরি বৃষ্টি হচ্ছে। ছোট্ট একটা পোস্ট অফিস। চারাদিকে বেড়া। উপরে টিনের চাল। ওখানে কুপি জ্বালিয়ে একটা পত্রিকা দেখছি। দরজায় পাহারায় সামিউল নামের এক মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ সে বলে ওঠে- ‘ওই, কে যায় রে? বলি- ‘আমরা।’ কোথায় থেকে আসছো- ‘পোড়াখাসিয়া থেকে আসছি।’ সে বলে- ‘এদিকে আসো।’ দুইজন এগিয়ে আসে। ওয়ালিউজ্জামান আশরাফি লতা ছিল টোয়াইসি। সে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে থার্ট ইয়ারে পরত। ওদের ইন্টারোগেট করে সে। পায়ে তাদের জঙ্গল সু। হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল।
লতা তাদের হ্যান্ডস আপ করিয়ে জেরা শুরু করে। ওরা ছিল রাজাকার, বকশীগঞ্জ থেকে আসছে। পেছনে কতজন আছে? ওরা বলে- ‘বারো জনের মতো।’ লতাকে বলি- ‘পজিশনে যাও। বক্স অ্যাম্বুশ করে থাকো। ওরা ঢুকলেই ফায়ার করবা।’ দশ মিনিট পর দেখলাম বারোজন নয়, পাকিস্তানি সেনাদের একটা ফুল কোম্পানি মার্চ করে আসছে। ওদের দেখেই লতা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। ফায়ার ওপেন করে দেয়।
দশ মিনিট ঠেকিয়েছিলাম ওদের। হেভি গোলাগুলি চলে। ওরা রেগুলার আর্মি। ওদের সামনে আমরা টিকতে পারি না। তাই উইথড্র করি। রাজাকার দুটোকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরি, ভোরের দিকে। ওইদিন বিকেলেই কর্নেল আবু তাহের (তখন মেজর ছিলেন) জয়েন করেন। দুই রাজাকারকে তার কাছেই প্লেস করেছিলাম।
২৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করতাম। আবার ২৪ ঘণ্টা ছিল রেস্ট। কর্নেল তাহের আসার পর হায়ার ট্রেনিংয়ে আমাকে আর তুরাতে পাঠালেন না। বললেন- ‘গেরিলাদের কোন ট্রেনিং নাই। যাবা, গুলি করবা, আবার চলে আসবা। হিট অ্যান্ড রান। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে তিন কিলোমিটার সামনে এসে কামালপুর বিওপিতে ফায়ার করেই চলে যেতাম। একাত্তরে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়েছিল কামালপুরে। বেশি ম্যাসাকারও হয়। কোম্পানিগুলো মেইনলি কোম্পানি কমান্ডারের নামেই হইত। আমার হেলাল কোম্পানি ছাড়াও ওখানে ছিল নাসির, খায়রুল, বদি, পান্না কোম্পানি। তাহের সাহেব একদিন বললেন কামারপুর ছাড়া কোথাও যাবি না তুই। বিভিন্ন জায়গার ছেলেরা তখন রিলিজ নিয়ে অন্য কোম্পানিতে চলে যায়। থাকে মাত্র ৫৬জন। উনি ওটাকেই কোম্পানি ঘোষণা করেন। এরপর কামালপুরেই সব অপারেশন করছি। কামালপুরে ১৮বার অ্যাটাকের মধ্যে উপস্থিত ছিলাম ১৪বার।”
কর্নেল তাহের যেদিন আহত হয়েছিলেন ওইদিনই বীরপ্রতীক হেলালও স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হন। কীভাবে? সেই ইতিহাস শুনি তার জবানিতে। তিনি বলেন-
“ফাস্ট কমিশনের অফিসাররা বেশ কয়জন তখন জয়েন করেছেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজান আর বেঙ্গল রেজেমেন্টের এক হাবিলদারকে দেওয়া হয় আমার সঙ্গে। ১৩ নভেম্বর ১৯৭১। কামালপুর অ্যাটাকের জন্য একটা কনফারেন্স হয় কমান্ডারদের নিয়ে। কর্নেল তাহের ব্রিফ করছেন। সমরে পাকিস্তানিদের অংশে ফাস্ট লাইন, সেকেন্ড লাইন ও সেন্টার- এই তিনটি ভাগ ছিল। রাতে পাকিস্তানি সেনারা সেন্টারে গিয়ে থাকছে। তাই সোলজার আজ কম। এটা ছিল কর্নেল তাহেরের ইনফরমেশন।
তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন- ‘তুই অ্যাটাক করে ফাস্ট লাইন ও সেকেন্ড লাইন দখল করে ফেলবি। ওদের বান্কারেও ঢুকে যাবি, দখল নিয়ে থাকবি। সকালে আমি যাব। ওয়াকিটকি ভোর ৬টার আগে খোলা যাবে না। কোনো ফায়ারও ওপেন হবে না।’
আমরা তাই করি। ফাস্ট লাইনের পাঁচটা বান্কার ফাঁকা পেয়ে পজিশনে চলে যাই। রাত তখন একটা। মানে ১৪ নভেম্বর ১৯৭১। সেকেন্ড লাইন সার্চ করি। সেগুলোও খালি। দুইটা বান্কারে পজিশন নিই। লে. মিজান বললেন- দখল তো হয়েই গেছে। এবার চলেন। সকালে এসে সেক্টর কমান্ডারকে নিয়ে ঢুকে পড়মু। আমি বলি ‘স্যার তো বলেছেন দখল করে বসে থাকতে। তিনি বললেন- ‘দখল তো হয়েই গেছে। আমরা বরং বানরোডে অপেক্ষা করি।’ হাবিলদারও আমাকে কনভিন্স করে বলেন- ‘উনিও তো অফিসার। তার কমান্ডও শোনা দরকার।’ আমরা তখন বান্কারগুলো ছেড়ে চলে আসি বানরোডে।
ভোরে কর্নেল তাহের ওয়াকিটকিতে কথা বলেন- ‘তুই কোথায়?’ বলি- ‘বানরোডে’। সঙ্গে সঙ্গে রেগে যান-বানরোডে কেন? বানকার খালি ছিল না? আমি পুরো ঘটনা খুলে বলি। বলেন- ‘সর্বনাশটা করছিস তুই। দেখতো পাখিটা আছে কিনা।
পাকিস্তানি সেনাদের একজন একটা বড় গাছের ওপর বসে নির্দেশ দিত। ওরা তখন সে অনুসারে টুই মর্টার মারত। ওটাকে ওপি বা পাখি বলতাম আমরা। দেখলাম ওপি আছে। তাহের সাহেব বললেন- ওটা আগে ফেল। গুলি করে মেরে ফেললাম।
বানরোডের ওপরে রাইফেল তুলে দেখতে বললেন, কী হয়। সেটা করতে যেতেই সমানে গুলি আসতে থাকে। বুঝে যাই ওরা বান্কারগুলোতে এসে পজিশন নিয়ে বসে আছে। উনি বললেন- ‘সব লস করলি।’ পুরো প্ল্যানিংটাই মাটি হয় যায়। তা না হলে ওইদিনই কামালপুর দখল করে ফেলতে পারতাম।
কর্নেল তাহের আসলেন সকাল নয়টার দিকে। সঙ্গে উনার গানম্যান, ভাই সাঈদ, বেলাল, শ্যালক সাব্বির। ফায়ারও চলছিল তখন। তার মুখে সিগারেট। মজা করে বললেন, চা আছে? বললাম- চা পাব কোথায়? গোলাগুলি চলছে তুমুল। আমাদের স্বাভাবিক রাখতে উনি হেসে বললেন- ‘ওয়ার ফিল্ডে চা বানানো শিখাব তোদের আজ।’ কয়েকজনকে শালপাতা নিয়ে আসতে বললেন।
হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ হয়। টুই মর্টার এসে পড়ে তার পায়ের সামনে। দেখলাম স্প্লিন্টারের আঘাতে তার একটা পা চামড়ার সাথে ঝুলে আছে কোনোরকমে। আমরা তখন ঘাবড়ে যাই। মিজানসহ কয়েকজনকে দিয়ে কর্নেল তাহেরকে পেছনে পাঠিয়ে দিই। তখনও ফুল সেন্স ছিল তার। পা উড়ে গেছে। তবুও যাওয়ার সময় বলছেন- ‘খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসতেছি। এ পথে তোদের নিয়েই ঢাকা যাব। সবচেয়ে আগেই যাব আমরা।’ এতোটা কনফিডেন্ট ছিলেন এই সেক্টর কমান্ডার।
তখনও আমি রণাঙ্গনে। কর্নেল তাহের আহত হয়েছেন। ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রাণপণে লড়ছি। খানিক পরেই শেলের স্প্লিন্টার এসে লাগে আমার ডান পায়ের রানে ও হাঁটুর নিচে। পিনপিন করে রক্ত বেরুতে থাকে। ক্যাম্পে ফিরেই ক্ষত স্থানের চিকিৎসা চলে। জখমটা খুব মেজর ছিল না। তাই যুদ্ধাহতের আবেদনও করিনি কখনও। এই প্রথম শুধু আপনাকেই দেখালাম। এরপরই আবার রণাঙ্গনে ফিরি। কর্নেল তাহেরের স্বপ্নটা শেষে বাস্তবায়িত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান আর্মিদের সহযোগিতায় আমার কামালপুরে পাকিস্তান সেনাদের সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছিলাম।”
একাত্তরের রণাঙ্গনে কর্নেল আবু তাহেরকে কেমন দেখেছেন?
“কর্নেল তাহের আমাদের প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত করত। কোম্পানি কমান্ডারদের মধ্যে সবচেয়ে কাছে ছিলাম আমি। খুব স্নেহও করতেন আমাকে। একমাত্র সেক্টর কমান্ডার উনি যার কাছে কোনো আর্মস থাকত না। হাতে থাকত একটা গল্ফ স্টিক। সেটা যখন ভেঙে যায় তখন একটা লাঠি রাখতেন। উনি কখনও ট্রুপসকে যুদ্ধে পাঠিয়ে চুপচাপ বসে থাকতেন না। যেটা অন্যরা করতেন। উনি নিয়মিত ওয়ার ফিল্ডে যেতেন, সরাসরি ট্রেনিংও দিতেন। যুদ্ধের বিভিন্ন ট্যাকটিস বোঝাতেন। বলতেন- ‘গেরিলা তোমরা। ওদের আর্মস নিয়েই ওদের মারতে হবে, ভিয়েতনামের গেরিলাদের মতো। তোমরাও অবশ্যই পারবে।’ কর্নেল তাহেরের মতো যোদ্ধা হয় না। মানুষের মনকে জাগিয়ে তোলার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তার। কথা শুনলেই আমাদের মনোবল বেড়ে যেত।”
যে দেশের জন্য রক্ত দিলেন সে দেশ কি পেয়েছেন?
বীরপ্রতীক সদরুজ্জামান হেলালের উত্তর- “পুরোপুরি পাইনি। স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটা দেশ হবে, যেখানে শোষণ বলে কিছু থাকবে না। সবার লাইফ গ্যারান্টেট থাকবে। কিন্তু সেটা কি হয়েছে?”
বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে এই বীর অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায়- “মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ঠিক ছিল না তখন। হয় আমাদের মেরে ফেলতে হতো। না হয় দেশের কাজে লাগানো দরকার ছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্যই দেশটা স্বাধীন হয়েছে। উনি রিয়েল প্যাটরিয়ট, গুড লিডার ছিলেন। বাট নট আ গুড অ্যাডমেনিশট্রেটর। তখন উনি বলেছিলেন- ‘আমার কম্বলটা কই’। তার মানে কি? তখনকার রাজনীতি ও প্রশাসনেও করাপশন ঢুকে গিয়েছিল। যেটা তিনিও আশা করেননি। করাপশন এখনও আছে। কিন্তু সেটা শক্ত হাতে দমন করার চেষ্টা করছেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা।”
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা হেয় হয়েছি বলে মনে করেন এই সূর্যসন্তান। তিনি বলেন- “সারা বিশ্ব এখনও বলে- ‘তোমরা এমন জাতি যে, তোমাদের নেতাকেই তোমরা মেরে ফেলেছো! উনি তোমাদের জাতির পিতা ছিলেন। তাকে কীভাবে হত্যা করলা?’ এই প্রশ্নের উত্তর আজও দিতে পারি না। একাত্তরে আমরা বীরের জাতি ছিলাম পঁচাত্তরে হয়েছি নিমকহারাম জাতি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই কারো। বঙ্গবন্ধুর সরকারে যারা ছিল, তাদের অধিকাংশই পরে খুনিদের সরকারে চলে গিয়েছিল। এর চেয়ে নিমকহারামি আর কি হতে পারে! ”
শেখ হাসিনার শাসনামল প্রসঙ্গে এই যোদ্ধার মত এমন- “সব দিক দিয়ে উনি সফল। দেশের ভালোর জন্য চিন্তা করেন, চেষ্টাও কম করছেন না। কিন্তু শেখ হাসিনা যতটা সৎ। তার দলের তৃণমূল ততটা নয়। এখন রাজনীতিতে রাজনীবিদ কম। ব্যবসায়ীরা আজ মন্ত্রী হয়ে বসে আছে। তাই ভালদের স্থান দেওয়াটা অনেক জরুরী। এখন যেটা চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনা। দলের লাগাম শক্ত হাতে ধরতে না পারলে সোনার বাংলা হবে না। এখন তো তার জন্যও রীতিমত ভয় হয়।”
বীরপ্রতীক হেলালের মেয়ে সৈয়দা ফারিয়া জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেছেন, বাংলায়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরির সুবিধা নেননি তিনি। শুধু বললেন- ‘জামালপুরে একটা হাই স্কুলে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সবকিছু ভাল হয়েছে। কিন্তু তবুও চাকুরিটা হয়নি। এক বির্তকিত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পেয়েছেন ওই চাকরিটা। তখন খুব খারাপও লেগেছে। পেপারে দেখলাম, একটা সেতু নির্মানের চেয়ে সংস্কারে খরচ হয়েছে অনেক বেশি। সবাই যেন সবার মতো লুটে নিচ্ছে সব। কেউ চিন্তা করছে না এ দেশটাকে নিয়ে।’
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে কেমন বাংলাদেশ চান?
‘সবকিছু থেকে অস্বচ্ছতা আর লুটপাট বন্ধ করতে হবে। আজ মুষ্টিগত হয়ে আছে খারাপরা। নিয়োগে যদি যোগ্যরা স্থান না পায়, তবে সোনার বাংলাদেশ কাদের নিয়ে গড়বেন? তাই নিয়োগটা স্বচ্ছ হওয়া প্রয়োজন। সৎ দেশ গড়তে সততার মূল্যায়ন করতে হবে। একইভাবে শিশুদেরকে বাধ্যতামূলক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে হবে। এটার দায়িত্ব পরিবারেরও।’
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট লাগে না বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল। তিনি বলেন- “ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাওয়ার জন্য তো মুক্তিযুদ্ধ করিনি। বিগত সময়ে সচিব মহোদয়রা নিজেরাই ছিলেন দুই নম্বর। তারাই তালিকাটাকে বির্তকিত করার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই মাইনোরিটিতে। স্বাধীনের পর জামালপুর-শেরপুর মিলে ৩৫২৩জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা ছিল। এখন শুধু জামালপুরেই ভাতা তুলে ৪৫০০জন আর শেরপুরে ২৬০০জনের মতো। বাকীরা কোথা থেকে আসলো! জানা নাই আমার।”
“এই প্রজন্মকে দেশ আইনা দিছি, ফ্ল্যাগ আইনা দিছি। এবার রক্ষা করুক তারা।”- প্রজন্মের উদ্দেশে এমনটাই বললেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল। তার ভাষায়- “রাজাকারদের কথাবার্তা শুনলে সহ্য করতে পারি না। এ প্রজন্মও সেটা পারে না। এটা আশার কথা। সেক্টর কমান্ডার ফোরামের ফাইন্ডার মেম্বার ছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সারা দেশ ঘুরেছি। প্রজন্মের ফিলিক্সটা কাছ থেকে দেখেছি। ওরা পারবে। রিয়েল পেট্রিয়ট হওয়ার চেষ্টাটা প্রজন্মের আছে। তবে আমাদের উচিত তাদের গাইড করা, পাশে থাকা।”
সংক্ষিপ্ত তথ্য
নাম : যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল।
ট্রেনিং: ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ ট্রেনিং ক্যাম্পে হাবিলদার ধন বাহাদুর সিংয়ের কাছে এক মাসের ট্রেনিং নেন। এছাড়া আগেই পিএনসিস (পাকিস্তান ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) করতেন। সেখানেও শিখেছেন রাইফেল চালানো।
মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: এগার নম্বর সেক্টরের কামালপুর বিওপি অপারেশনে।
যুদ্ধাহত: ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১। কামালপুর অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া শেলের স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষত হয় তার ডান পায়ের রানে ও হাঁটুর নিচে।
ছবি : সালেক খোকন
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ অক্টোবর
© 2019, https:.