খড়ে ঢাকা রাস্তায় খানিক এগোতেই ছোট্ট একটি পাড়া। ছন আর মাটির আলিঙ্গনের ছোট ছোট খুপরি ঘর পাড়াটিতে। গায়ে গা লাগানো ঘরগুলোর ঢং দেখেই মনে হয় এটি কোন বাঙালিপাড়া নয়। এটিই কড়াপাড়া। বাংলাদেশে টিকে থাকা কড়া আদিবাসীদের ১৯টি পরিবারের বাস এখানেই।
সময়টা ফসল কাটার। এসময় কোনো আদিবাসীর দেখা মেলাই দায়। কিন্তু তেমনটি ঘটল না আজ। গোটাপাড়ার কেউই কাজে যায়নি। কী কারণ? গোত্রের মাহাতো বা প্রধান জগেন বলেন, হামনি ঘার আইজ লবান।
‘লবান’ মানে নবান্ন উৎসব। নতুন ধান ঘরে তোলার দিন। সবাই অপেক্ষা করছে কৃষ্ণ আর থোপাল কড়ার জন্য। উপোস তারা। খুব ভোরে গেছে নিজের জমির ধান কেটে আনতে।
কৃষ্ণ আর থোপাল ছাড়া এ পাড়ার অন্যদের জমি নেই। মাহাতো জানালো এক সময় কড়াদের জমি ছিল। প্রতি অগ্রহায়ণে তাদের নিজের গোলায় উঠত ধান। কিন্তু দিনে দিনে পাল্টে যায় সবকিছু। পূর্বপুরুষের জমিগুলোও আজ চলে গেছে স্থানীয় বাঙালিদের দখলে।
লবান দেখতে সবার সঙ্গে কৃষ্ণ ও থোপালের জন্য আমরাও অপেক্ষায় থাকি। মাহাতো জগেন জানালেন প্রতি অগ্রহায়ণে নিয়ম মেনে কড়াদের প্রত্যেক পরিবারকে পৃথকভাবে পালন করতে হয় লবান অনুষ্ঠানটি। এক সময় এরা লবান পালন করত ধুমধামের সঙ্গে। কিন্তু অভাবের কারণে আজ উৎসবগুলোতে পড়েছে ভাটার টান।
কথায় কথায় আসরে আসেন এক বৃদ্ধা। নাম সেড়তি কড়া। তিনি জানালেন আচারগুলো। লবানে যে আরোয়া ধান (নতুন ধান) কাটতে যাবে তাকে থাকতে হয় উপোস। উপোস অবস্থায় সে মাঠ থেকে কেটে আনে এক গোছা পাকা ধান। ধান নিয়ে বাড়িতে ঢোকার আগেই বাড়ির নারীরা তাকে প্রণাম করে। উলুধ্বনি দিয়ে তার পা ধুয়ে দেয়।
অতঃপর দুর্বাঘাস, প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে তাকে বরণ করে নেয় বাড়ির ভেতরে। এদের বিশ্বাস এভাবে ফসলরূপী লক্ষ্মীকে তারা বরণ করে। অতঃপর ধান থেকে চাল বের করে, ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলসীতলায় ভক্তি দিয়ে সেখানে একটি মুরগি বলি দেয় কড়ারা।
পরে মুরগির মাংসের সঙ্গে নতুন চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে উপোসকারী উপোস ভাঙে। এছাড়া কড়ারা কিছু চাল বেটে গোটা বাড়িতে ছিটিয়ে দেয়। এদের বিশ্বাস এতে সারা বছরই খাদ্যের অভাব হবে না। কিন্তু কেন পালন করতে হয় নবান্ন বা লবান?
এ নিয়ে কড়াদের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি কাহিনী। সেড়তির জবানিতে শুনি কাহিনীটি।
এক গ্রামে ছিল উচ্চবংশীয় দুই ভাই। তাদের মধ্যে বেজায় ভাব। বড় ভাইয়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো ছোট ভাই। ভাইয়ের নির্দেশে ছোট ভাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ে ঠিক হয় পাশের গ্রামের এক মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের নাম লক্ষ্মী। লক্ষ্মীকে বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আছে একটি শর্ত। মেয়ের বাবা জানালেন শর্তটি।
মেয়ে লক্ষ্মী প্রতি অগ্রহায়ণে পালন করে বিশেষ এক ব্রত। বিয়ের পরও কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না ব্রতটির। শর্ত মেনে ধুমধামের সাথে লক্ষ্মীর বিয়ে হয় ছোট ভাইটির সঙ্গে।
বিয়ের পর আসে প্রথম অগ্রহায়ণ। শ্বশুরবাড়িতে লক্ষ্মীর ব্রত পালনের সময়। ওইদিন খুব ভোরে সে ঘুম থেকে উঠে গ্রামের রাস্তায় হেঁটে যেতে থাকে। লক্ষ্মী দেখে গ্রামের বেশির ভাগ লোক তখনো ঘুমাচ্ছে। তাদের ঘরবাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। বাড়িঘরের অবস্থা নোংরা, অপরিষ্কার ও আবর্জনাময়।
গ্রামের মানুষদের এমন অবস্থা দেখে ব্যথিত হন লক্ষ্মী। মন খারাপ করে লক্ষ্মী চলে আসে গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে। সেখানে ছোট্ট একটি বাড়িতে বাস করত নীচু বংশীয় একটি পরিবার। সমাজের অন্যরা ওই পরিবারের সঙ্গে মিশতো না। লক্ষ্মী দেখল ওই বাড়িটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোবরের ছিটা দিয়ে উঠোন লেপা। আতপ চালের গুঁড়া দিয়ে বাড়ির দেয়ালে আলপনা আঁকা। পুজোর ঘরটিও পরিচ্ছন্ন। পুজোর ঘরে ধানের শিষ, ফুল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে দেবতার আরাধনা করছে বাড়ির কর্ত্রী।
এ দৃশ্য দেখে লক্ষ্মী মুগ্ধ হয়। বাড়িতে ঢুকে সে গৃহকর্ত্রীকে আশীর্বাদ করে। নীচু বংশীয় সে বাড়ি থেকে লক্ষ্মী বের হতেই চারদিকে রটে গেল সে খবরটি। লক্ষ্মী পৌঁছানোর আগে এ খবর পৌঁছে যায় তার শ্বশুরবাড়িতে। বড় ভাইয়ের নির্দেশে লক্ষ্মীর স্বামী গ্রহণ করে না লক্ষ্মীকে। তার অপরাধ, ঘরের বউ নীচু জাতের সঙ্গে উঠাবসা করেছে। ফলে জাত চলে গেছে তার।
স্বামীর আচরণে লক্ষ্মী দুঃখ পায়। মর্মাহত হয়। ফলে স্বামীর বাড়ি থেকে সে চলে আসে এক কাপড়ে। মনের কষ্টে লক্ষ্মী চলে যায় দূরের কোনো গ্রামে।
এদিকে লক্ষ্মী চলে যাওয়ার পর দুই ভাইয়ের সংসারে নামে চরম অশান্তি। ধীরে ধীরে তারা গরিব হয়ে এক সময় পথে নামে। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘোরে মানুষের দ্বারে দ্বারে। তারা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একদিন চলে যায় দূর গ্রামে, লক্ষ্মীর বাড়িতে।
বাড়ির দাসীরা দুই ভাইকে খেতে দেয় প্রসাদ। কিন্তু তারা তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। দুই ভাই বলে আমরা উচ্চবংশীয়। তাই তোমাদের খাবার খেতে পারি না। তারা অনুরোধ করে তাদের রান্নার সামগ্রী দিলে তারা তা রান্না করে খাবে। দাসীরা তাই করল। দুই ভাই রান্নার সামগ্রী পেল।
কিন্তু তাতেও তারা রান্না করতে পারল না। চাল তো সিদ্ধ হয় না আর তরকারিও পুড়ে ছাই। লবণও হয় না কোনো কিছুতেই। নিরুপায় হয়ে ক্ষুধার্ত দুই ভাই তখন দাসীদের ডেকে বলে, যাও খাবার নিয়ে আস। তোমাদের হাতের খাবার আমরা খাব।
বাড়ির ভেতর থেকে সবকিছু দেখছিল লক্ষ্মী। লক্ষ্মীর কথা মতো দাসীরা দুই ভাইকে খাবার পরিবেশন করে। নানা পদের খাবার সাজিয়ে দেয় তারা। ক্ষুধার্ত দুই ভাই যেই খাবার মুখে নেবে অমনি সেখানে হাজির হয় লক্ষ্মী নিজে। দুই ভাই তাকে চিনতে পারে। লক্ষ্মী তাদের উদ্দেশে বলে, আপনারা তো উচ্চবংশীয়। এসব নীচু জাতের স্ত্রীদের হাতের ছোঁয়ায় কি আপনাদের জাত থাকবে?
লক্ষ্মীর কথায় দুই ভাই লজ্জিত হয়। তাদের ভুল ভাঙে। অবশেষে দুই ভাই উপলব্ধি করে সংসারে জাত বলতে কিছু নেই। একই সঙ্গে তারা বুঝতে পারে সংসারে নারী-পুরুষের সমান ভূমিকা রয়েছে। তারা একে অপরকে ছাড়া অচল।
বড় ভাই তখন নিজের ভুলের জন্য লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ছোট ভাইকে নির্দেশ দেয় লক্ষ্মীকে নিয়ে নিজ ঘরে ফিরতে। লক্ষ্মী স্বামীর সংসারে ফিরতে রাজি হয়, কিন্ত জুড়ে দেয় একটি শর্ত। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার ঘরে ঘরে মেয়েরা লক্ষ্মীর ব্রত করবে। ব্রতের সময় সে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যাবে। জাতপাতের ভেদ ভুলে সবাই একত্রে বসে খাবে। এটি তার শর্ত।
দুই ভাই লক্ষ্মীর শর্তটি মেনে নেয়। লক্ষ্মীও ফিরে আসে স্বামীর সংসারে। দুই ভাইয়ের অবস্থাও ধীরে ধীরে আবার ভালো হতে থাকে। কড়ারা বিশ্বাস করে এরপর থেকেই লক্ষ্মীর শর্তমতে ঘরে ঘরে মানুষ পূজার মাধ্যমে লবান পালন করে আসছে।
এরই মধ্যে মাঠ থেকে চলে আসে কৃষ্ণ ও থোপাল কড়া। তাদের মাথায় পাকা ধানের গোছা। নানা আচারের মাধ্যমে কড়ারা গ্রহণ করে তাদের। ঢাক-ঢোলের শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ। দিনভর চলে লক্ষ্মীর আরাধনা। দারিদ্র্যের কষাঘাতে তিনবেলা খেতে পারে না কড়ারা। কিন্তু তবুও প্রতি অগ্রহায়ণে এরা পালন করে লবান অনুষ্ঠানটি।
প্রতি লবানেই এরা আশায় বুক বাঁধে। হয়তো এবার তাদের ঘরে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ পড়বে। দারিদ্র্য থেকে মিলবে মুক্তি। লক্ষ্মীর আশায় এভাবেই কেটে যায় কড়াদের একেকটি দিন।
অলঙ্করণ: সোহাগ পারভেজ
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ১৪ এপ্রিল ২০২০
© 2020, https:.