উচিতপুর: যাওয়া কি উচিত?
বিকেল হয় হয়। কয়ার হাওরের মাঝে ভাসছি। হঠাত্ দুলে ওঠে ট্রলারটি। চারপাশে দমকা হাওয়ার ঝাপটা। বড় বড় ঢেউ এসে দোলা দিচ্ছে। শব্দও হচ্ছে ছলাত্ ছলাত্। কী হলো হঠাত্! ট্রলারের ভেতর থেকে চোখ রাখি আকাশে। কখন যে মেঘ জমেছে, টেরই পাইনি। আকাশে কালো মেঘের এক বড় টুকরো। ক্রমেই তা ঢেকে দিচ্ছে তপ্ত সূর্যটাকে। মেঘ-সূর্যের এ এক অনন্য খেলা।
কালো মেঘটাকে সূর্য থোরাই কেয়ার করল। মেঘের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে তার রশ্মি। হাওরের এক পাশে তখন অন্ধকার। কিন্তু চারপাশে পড়েছে আলোকচ্ছটা। অপরূপ এক দৃশ্য। দেখতে বেশ লাগছে। আলোহীন জগত্ থেকে যেন ছুটে চলেছি আলোর দেশে।
সবাই তখন আনমনা। নানা কিছু ভাবছে। হঠাত্ ছাদে দুম দুম কয়েকটি শব্দ! দেখলাম, ট্রলারের মাঝির মুখে হাসি। কী হলো? ওপরে উঠতেই হাসির রোল ওঠে। দৃষ্টি সবার আলোকচিত্রী বন্ধু হূদয়ের দিকে। দাঁড়িয়েই ছবি তুলছিল সে। ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলে তার শরীরও। মোটা শরীরে তৈরি হয় নানা ভঙ্গি। তা দেখে গম্ভীরমুখো বন্ধু আলমও মুখ টিপে হাসে। হূদয়ের হূদয়ে তখন বিদ্রূপের খোঁচা লাগে। ঢেউয়ের কথা ভুলে আলমের দিকেই তেড়ে আসে সে।
নানা দৃশ্যে মন ভুলিয়ে এগিয়ে চলি। খুব কাছেই ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা। পাল তোলা। ঢেউয়ের তালে দুলছিল নৌকায় বসা দুজন। তবু জাল ফেলে আপন মনে বিশেষ কায়দায় মাছ ধরছে তারা। দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি গাছ। শরীরটা জলে ডুবিয়ে কোঁকড়ানো সবুজ চুলগুলো যেন ভাসিয়ে রেখেছে গাছগুলো। দূর থেকে তা চমত্কার দেখায়।
মাঝি জানাল, ওগুলো হিজলগাছ। কাছে যেতেই অবাক হতে হয়। সব কয়টি গাছেই ঠায় দাঁড়িয়ে মাছরাঙার দল। একেকটার রূপ একেক রকম। নানা রঙে বর্ণিল। মন চায় ছুঁয়ে দেখি। হঠাত্ চোখের সামনেই একটি মাছরাঙা হাওরের পানিতে দেয় ডুব। খানিক পরে উঠতেই অবাক হই। মাছরাঙার ঠোঁটে নড়ছে ছোট্ট একটি মাছ। বন্ধু মৃদুলের মুখে উচ্চারিত হয়—‘ওয়াও’… অদ্ভুত শব্দগুলো। হূদয়ের ক্যামেরায় তখন ক্লিক ক্লিক শব্দ।
হাওরের রূপে উদাস হই আমরা। মৃদুল আনমনে বাতাসের মাঝে ছড়িয়ে দেয় জলের গানের সুর—
‘বাউলা বাতাস আউলা চুলে
লাগলো দোলা,
গান ধরেছে পথের ধারে আত্মভোলা…।’
আমরা তখন হারিয়ে যাই অন্য কোনোখানে, অন্য কোনো এক স্বপ্নরাজ্যে।
এই ফাঁকে একটু বলে নেই কয়েক দিন আগের গিয়েছিলাম উচিতপুর। ওটা নেত্রকোনার মদন উপজেলায়। হাওর দেখার কথা শুনে সঙ্গী হয় বন্ধু হূদয় ও মৃদুল। আরেক বন্ধু আলমের গ্রামের বাড়ি ওখানেই। মদনে যখন পৌঁছি, তখন মধ্যদুপুর। বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল আলম। আমাদের গন্তব্য উচিতপুর। কিন্তু পেট বাবাজি বিদ্রোহ করে আছে। আগে তাই খেতে হবে।
মহিউদ্দিন মার্কেটের পাশেই ছোট্ট নিরালা হোটেল। ওখানকার সব রান্নাই ঘরোয়া। তাই নিরালায়ই চলে আমাদের ভূরিভোজ। অতঃপর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় রওনা হই উচিতপুর ঘাটে।
উচিতপুরে পৌঁছেই চোখ তো ছানাবড়া। এরই মধ্যে ভিড় লেগেছে শত শত মানুষের। পাকা একটি রাস্তা চলে গেছে গোবিন্দশ্রীর দিকে। কিন্তু গোটা রাস্তার বেশির ভাগই এখন হাওরের পানির নিচে। সে পানিতে গা ভিজিয়েই আনন্দ করছে সবাই। দূরে রাস্তাটি উঠে গেছে বড় একটি ব্রিজের ওপর। চারপাশে পানি আর পানি। হাওরের দৃশ্য দেখার ওই ব্রিজটিই এখন বিনোদনের মূল কেন্দ্র। অনেকেই তাই ওদিকে নৌকা ভাসায়।
ঘাটের ডুবো রাস্তার দুই পাশে বড় বড় ট্রলার বাঁধা। নামগুলোও বেশ—স্বাধীন পরিবহন, ভাই ভাই পরিবহন, আশিক পরিবহন প্রভৃতি। এখান থেকেই যাওয়া যায় মাগান, জয় বাংলা, গোবিন্দশ্রী, কদমশ্রী, জগন্নাথপুর, খালিয়াজুড়ি, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও টাঙ্গুয়ার হাওর অঞ্চলে। দরদাম ঠিক করে একটি ট্রলার ভাসাই কয়ার হাওরের উদ্দেশে। বালুই নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই হাওরের বুকেই ভেসে বেড়াই রাত পর্যন্ত।
মধ্যবিকেল তখন। আকাশের কালো মেঘও কেটে গেছে। সূর্যের নীলাভ আলোয় অপরূপ হয়ে উঠেছে হাওরটি। হাওরের বুকে ভাসছে অসংখ্য কেয়ারা, ডিঙি আর কিস্তি নৌকা। জেলেরা জাল টেনে বেড় দিয়ে মাছ ধরছে। আবার ডিঙিতে বসে চিংড়ি ধরার বাইর ফাঁদ পাতছে কেউ কেউ। দূরে কোনো এক গ্রামের পাশে হাঁসের দল খেলা করছে দল বেঁধে। নৌকায় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যের ওপাশে নীলাভ আকাশ। দূর থেকে তা ছবির মতো দেখায়। হূদয় ছবি তুলছে হূদয় দিয়েই। আমরা তখন বিভোর হই হাওরে সূর্য ডোবার দৃশ্যে।
হঠাত্ ভাটি বাংলার গানের সুর বাতাসে ভেসে আসে—‘মাটিরও পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে, তোমারে পুষিলাম কত আদরে…।’ আমাদের দৃষ্টি তখন অনেক দূরে, মানুষভর্তি একটি ট্রলারের দিকে। ছুটে আসছে সেটি। মুচকি হেসে মাঝি বলল, ‘বিয়ের ট্রলার’। দূরের গ্রাম থেকে কনে নিয়ে ফিরছে বরপক্ষ। কাছে আসতেই দেখি, ট্রলারের মধ্যে চলছে হৈ-হুলোড় আর হাসি-তামাশা। লম্বা ঘোমটা টেনে বসে আছে কনে। তার পাশে বসা বরের মুখে সেকি হাসি! আমাদের চোখে চোখ রাখে বরপক্ষের অনেকেই। যুবক-যুবতীরা হাত নেড়ে ইশারাও করে। একসময় ট্রলারটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় দূর হাওরে।
সূর্য ডুবতেই কয়ার হাওরের দৃশ্যগুলোও বদলে যেতে থাকে। দূরে জেলেদের নৌকাগুলোয় জ্বলে ওঠে হারিকেনের আলো। হাওরের জলে যেন ভাসছে অসংখ্য প্রদীপ। দেখতে অসাধারণ লাগে। খানিক পরই চাঁদ উঁকি দেয় আকাশে। জ্যোত্স্নার আলো গায়ে মেখে আমরাও তখন বিভোর হই আনন্দ-আড্ডায়। ভুলে যাই নগরজীবনের যান্ত্রিকতা আর ক্লান্তির স্মৃতিগুলো।
যাওয়া–আসা ও অন্যান্য তথ্য:
মদনগামী বাসগুলো ছাড়ে ঢাকার মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে। দিনের বেলায় শাহাজালাল, রাতে ঢাকা থেকে মদনে আশিক এবং রাতে মদন থেকে ঢাকায় আরাফ পরিবহন আসে। এছাড়া শাহজালাল পরিবহনে নেত্রকোণায় এসে লোকাল বাসে মদন যাওয়া যাবে। রাতের ভাড়া: ৩৫০ টাকা। সেখান থেকে ৬০ টাকায় যাওয়া যাবে উচিতপুর ঘাটে। হাওর ঘুরতে ট্রলার ভাড়া নিতে হবে দর-দাম করে। মদনে থাকার একমাত্র জায়গা উপজেলা পরিষদ ডাকবাংলো। তবে নেত্রকোনা শহরে একাধিক থাকার জায়গা রয়েছে। ভরা বর্ষা উচিতপুরের হাওর ঘুরার উপযুক্ত সময়। সাতার না জানলে হাওরে না নামাই ভাল। ট্রলারে ঘুরতে সর্তকতা অবলম্বন করুন। হাওরে ও ঘাটে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, বিস্কুট ও চানাচুরের প্যাকেট, পলিথিন প্রভৃতি না ফেলে পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক থাকুন।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনীর প্রভাতফেরী পত্রিকায়, প্রকাশকাল: ০৯ জুলাই ২০২০
© 2020, https:.