আদিবাসী

অভাবের দিনে প্রান্তজনের কারমা উৎসব

ভাদ্র মাস। সারা দেশে তাই কারমা বা কারাম উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। কড়ারা এটিকে কারমা বললেও সাঁওতাল, তুরি, ওঁরাও, পাহান মাহালিদের কাছে এটি কারাম উৎসব, যা পালিত হয় প্রতি ভাদ্রে, চাঁদের পূর্ণিমায়। উৎসবে বিরল প্রজাতির খিল কদমগাছের ডাল কেটে এনে বিশেষ আচারের সঙ্গে পূজা করেন কড়াসহ অন্যরা। উৎসবের নানা আনুষ্ঠানিকতায় মূলত তারা অভাবমুক্তি সৌভাগ্য লাভের আকুতি জানান দেবতা কারাম গোঁসাইয়ের কাছে।

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম ঝিনাইকুড়ি। এখানেই বসবাস নিশ্চিহ্নপ্রায় কড়া জাতির মানুষদের। পরপর চার বছর কড়াদের কারমা উৎসব দেখেছি খুব কাছ থেকে, তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে। সে অভিজ্ঞতা থেকেই কারমা বা কারাম উৎসবের বৃত্তান্ত তুলে ধরছি।

উৎসবের দিন বিকেলের দিকে যুবকরা খিল কদমগাছের ডাল কাটতে ছুটে ধর্মপুর শালবনের গহিনে। কড়াদের গোত্রপ্রধান বা মাহাতো জগেন কড়া। তিনি আগে থেকেই ডাল কেটে আনা এবং তা বিসর্জনের জন্য মনোনীত করে দেন অবিবাহিত কোনো যুবককে। বিবাহিতদের দিয়ে ওই ডাল কাটা একেবারেই নিষেধ। ওই গাছের ডাল কেটে আনার রয়েছে বিশেষ নিয়ম। যে ডালটি কাটবে সে গাছটির কাছে গিয়ে গোড়ার জংলা পরিষ্কার করে, পানি দিয়ে তাতে মাটি লেপে, পাটকাঠি জ্বালিয়ে, ধূপ দিয়ে, গাছে মাটিতে তিনটি সিঁদুর ফোঁটা দিয়ে ভক্তি করবেন। সময় গাছের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় দুটি তেলের পিঠা। মনে মনে বলতে হয় ‘কারাম গোঁসাই প্রতি বছরের মতো আজও আমরা তোমাকে নিতে এসেছি, পূজা দেব বলে। অতঃপর বিসক্রম বলে এক বা তিন কোপে কেটে নিতে হয় খিল কদমগাছের বড় একটি ডাল বা ছোট তিনটি ডাল। সে ডাল মাটিতে পড়ার আগেই যুবকটি তা তুলে নেয় ঘাড়ে। ডালসহ সে গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছালে ঢোল বাজিয়ে বিশেষ ভক্তি দিয়ে দেবতারূপী ডালটিকে কড়ারা নিয়ে আসে পূজাস্থলে। সেখানে বাঁশ দিয়ে মাড়োয়া তৈরি করে তা শাপলা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। অতঃপর খিল কদমগাছের ডালটিকে বরণ করে মাড়োয়ার চারপাশে আড়াই পাক ঘুরে তা মাটিতে গেড়ে দেওয়া হয়।

সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। প্রতিটি বাড়ি পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করে আঙিনা পরিপাটি করে সাজানো হয়। সবার ঘরেই সময় তেলের পিঠা ভাজার শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যায়। কড়ারা বলে তেলের পিঠা ছাড়া কারমা উৎসব হয় না। উৎসবের শুরুতেই গ্রামপ্রধান বা তার মনোনীত কোনো ব্যক্তি ধুতি পরে ডালটির সামনে পূজা দেন। সময় দুটি লাল মুরগা (মোরগ) বলি দিয়ে কারমা উৎসবের শুভসূচনা করা হয়। এরপরই উপোসের ডালা দুটি এনে রাখা হয় কারমা ডালের (খিল কদম) সামনে।

কী এই উপোসের ডালা?

কারমা উৎসবের পাঁচ দিন আগ থেকে কড়ারা ধর্মের পরীক্ষা শুরু করে। বাঁশ দিয়ে এরা দুটি ডালা তৈরি করে নেয়। একটি ডালা থাকে ছোট, অন্যটি বড়। কড়াদের কাছে একটি কারমা অপরটি ধারমা। ডালা দুটির মধ্যে এরা কালাই বীজ রেখে বালু মাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয় এবং নিয়মানুসারে ওই দিন থেকেই তারা উপাস (উপোস) শুরু করে। সময়টাতে মাছ, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ খাওয়া নিষেধ। খেতে হয় শুধুই নিরামিষ। যে কয়জন উপোস থাকে, সে কয়টি ছোট্ট কাঠি পুঁতে দেওয়া হয় ডালায়। উপোসকারী অবিবাহিত হলে কাঠির গায়ে কাজল আর বিবাহিত হলে সিঁদুর লাগানো হয়। ডালাতে প্রতিদিন ছিটানো হয় হলুদ ধোয়া পানি। তাদের বিশ্বাস উপোস অবস্থায় ধর্মমতে না চললে ডালায় তাদের হাতে লাগানো বীজ থেকে কোনো চারা গজাবে না। উৎসবের দিন নতুন চারা গজানো ডালা দুটিকে রাখা হয় খিল কদমগাছের ডালের সঙ্গেই।

কারমা উৎসবে কড়ারা তাদের আত্মীয়স্বজনদের সবাইকে দাওয়াত করে। সবার উপস্থিতিতেই শুরু হয় উৎসবের পৌরাণিক কাহিনী বলার আসর। মূলত কারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে কারমা বা কারাম উৎসবের বিশ্বাসটি। এসব লোককথা বা মিথগুলোও সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সাহিত্যকে, যা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ।

কাহিনী বলার পর্বে খিল কদম বা কারাম ডালটিকে ঘিরে বসেন নারীরা। সেজেগুজে ঘোমটা টেনে বসেন তারা। সামনে কাঁসার পেয়ালায় রাখা হয় প্রদীপ, তেলের পিঠা, ছোলা, দূর্বা ঘাস জুঁই ফুল। গোত্রপ্রধান বা মাহাতো বলতে থাকেন কাহিনীটি। মাঝেমধ্যে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলেন ‘ফুল ফেকিয়ে। ঠিক তখনই সবাই এক মুঠো জুঁই ফুল বা ঘাস ছুড়ে দেয় ডালটির দিকে। শেষে মনের নানা ইচ্ছা নিয়ে সবাই তাদের বানানো তেলের পিঠা বেঁধে দেয় কারমা ডালটির সঙ্গে। কারমা উৎসবের পূজার এই পর্বটিতে শুধু মেয়েরাই অংশ নিতে পারেন। পূজা শেষে উপোসকারীরা উপোস ভাঙে।

অতঃপর রাতভর তারা ডালটির চারদিকে নেচেগেয়ে হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে। নারীরা হাত ধরাধরি করে নাচে আর কণ্ঠ আকাশে তুলে গান গায় ‘তারক পাতা তেরকি/খেজুর পাতা দনা/নাচ গেয়ে ময়না/ভাতারে দেতো আয়না।

ভোরবেলা গ্রামপ্রধান বা মাহাতো স্নান সেরে প্রথমে এক বাটি দুধ ঢেলে দেন খিল কদমগাছের ডালের মাথায়। এর পরপরই অন্যরা একে একে দুধ ঢালতে থাকে। অতঃপর যে যুবকটি ডাল কেটেছিল, সে প্রথমে ডালটির চারদিকে তিন পাক ঘুরে সেটি কাঁধে তুলে ঢাকঢোলের তালে তালে বিসর্জন দেয় নিকটবর্তী নদী বা পুকুরে। এভাবেই কারমা বা কারাম উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

কড়াসহ সমতলের আদিবাসীরা মূলত কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। ভাদ্র তাদের অভাবের মাস। জমিতে তখন কাঁচা ফসল থাকে। ফলে কাজের সুযোগ তেমন থাকে না। সময় তারা হয়ে পড়ে কর্মহীন। সরকারিভাবেও পায় না কোনো সাহায্যসহযোগিতা। ফলে সময় সমতলের প্রান্তজনদের জীবন কাটে কষ্টে। মহাজনদের কাছে চড়া সুদে আগাম শ্রম বিক্রি করেই চলে কেউ কেউ। যেটুকু জমি আছে তাদের তাও দখলে রাখতে পারছে না কড়াসহ অন্য জাতির মানুষরা। স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের শকুনদৃষ্টি পড়েছে তাতে।

শত অবহেলা, অত্যাচার অভাবঅনটনের মধ্যেও সমতলের প্রান্তজনরা প্রতি ভাদ্রে ধুমধামের সঙ্গে পালন করেন কারমা বা কারাম উৎসবটি। উৎসবে আজও তারা আশায় বুক বাঁধেন। সামনের বছরে নিশ্চয়ই দূর হয়ে যাবে তাদের সব অভাবঅনটন। দেখা মিলবে সৌভাগ্য সফলতার। তাদের বিশ্বাস, কারাম গোঁসাই এক দিন ঠিক ঠিক তাদের ঘরে আসবেন। দুঃখে ভরা জীবনে তখন লাগবে আনন্দের সুবাতাস। বেঁচে থাকা টিকে থাকার সংগ্রামে কারমা উৎসব এভাবেই প্রান্তজনের প্রেরণা মানসিক শক্তি জুগিয়ে আসছে যুগে যুগে।

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১ সেপ্টেম্বর ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button