মুক্তিযুদ্ধ

বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে কোটি টাকার ধান্ধা করছে কারা?

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান

সময়টা ১৯৬৮। একদিন বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য চাচারা তাকে চাঁদপুর নিয়ে যায়। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেননি। ওখানেই মারা যান। আমাদের ওপর তখন আকাশ ভেঙে পড়ে। বাবার ব্যবসা, গরু আর হাল ছিল। সেগুলো ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে অভাব-অনটন হয় আমাদের নিত্যসঙ্গী।

বাবা ছাড়া এক বছর কেটে গেল। নবম শ্রেণিতে পড়ি তখন। স্টিমারঘাটে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের নিয়োগ চলছে। প্রতিবেশী চাচা আব্দুল হালিম আমাদের পারিবারিক অবস্থাটা জানতেন। ইপিআরে লোক নেওয়ার খবরটি নিয়ে আসেন তিনিই। বললেন–‘তুমি গিয়া দাঁড়াও’।

পরদিন স্কুলে না গিয়ে বই হাতেই স্টিমার ঘাটে যাই। বড় একটা জাহাজ ছিল ওদের। সেখানেই রিক্রুটিং চলছে। দাঁড়াতেই অফিসার মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর বুকে একটা সিল মেরে দেন। অনেকের ভেতর টিকে গেলাম। মনে তখন অন্যরকম আনন্দ!

জাহাজের ভেতরই চলে মেডিকেল পরীক্ষা। এরপর বলা হলো বরিশাল সর্কিট হাউজে যেতে। ওই চাচার ছোট ভাই ইউসুফ চাচা আমাকে নিয়ে যান সেখানে। তাদের ঋণ শোধ হবার নয়। এর পরই ট্রেনিংয়ে যেতে হয়। মা খুব কাঁদছিলেন। কেননা জীবনসংগ্রামে ওটাই আমার প্রথম যাত্রা।

রাতে স্টিমারে করে নেওয়া হয় খুলনায়। সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরগাঁওয়ে, ইপিআর ক্যাম্পে। তিন মাসের বেসিক ট্রেনিং হয় ওখানেই। ইপিআরের জিডি সিপাই ছিলাম, বডি নম্বর ছিল ১৯২৭৫। ট্রেনিং শেষে পোস্টিং হয় প্রথমে সেক্টর হেড কোয়ার্টাস, দিনাজপুরে। পরে সতেরো উইংসহ আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঢাকার পিলখানায়।

ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ যোগদানের প্রেক্ষাপট এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ চলে যুদ্ধদিনের নানা বিষয় নিয়ে।

আব্দুল সামাদ হাওলাদার ও লালবরু বেগমের বড় সন্তান মাকসুদুর রহমান। বর্তমান বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার সারদল গ্রামে। এক সময় তাদের বাড়ি ছিল খোজাখালি গ্রামে। ভাঙনে সুগন্ধা নদীগর্ভে বিলীন হয় ওই বাড়ি। ফলে তারা বসতি গড়েন সারদলে। মাকসুদুরের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি খোজাখালি প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন নলছিটি মারচেন্ট হাই স্কুলে।

ইপিআর ক্যাম্পে বেশিভাগই ছিলেন পাকিস্তানি সৈন্য। তাদের সঙ্গে বাঙালি সৈন্যদের সম্পর্ক কেমন ছিল? তা জানাতে একটি ঘটনার কথা তুলে ধরেন মাকসুদুর রহমান। তার ভাষায়– “পিটি-প্যারেডের সময় একটু উনিশ-বিশ হলেই শীতের কুয়াশায় ক্রলিং করনো হতো বাঙালি সৈন্যদের। পাকিস্তানিদের দেওয়া হতো অন্য শাস্তি।“

মাকসুদুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সনদ

সত্তরের নির্বাচনে ইপিআরদের ডিউটি দেওয়া হয় বাইরে। আমার প্লাটুনের ডিউটি ছিল পুরান ঢাকায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিল্ডিংয়ে। কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তানি অফিসার, নাম জাফরুল্লাহ। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আমাদের নিয়ে পেট্রোলে বের হতেন। আলু বাজার, চক বাজার, ইসলামপুর, নয়া হাটখোল–এসব জায়গায় টহল হতো। থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে আমরা গাড়িতে বসে থাকতাম।

জটলা দেখলেই ক্যাপ্টেন বলতেন– ‘এ লোক কেয়া কারতাহে, দেখো, এ লোককো ভাগাও।’ নেমেই বাঙালিদের সাথে নমনীয়ভাবে কথা বলতাম। তাতেই সবাই সরে পড়ত। বাঙালিদের কেন মারধর করলাম না–এতে তিনি নানাভাবে আমাদের সন্দেহ করতেন।

ফেরার সময় আজাদ সিনেমা হল, কোর্ট-কাচারীর সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসার নির্দেশ করলেন। নামার পরপরই বললেন– ‘লেট যাও।’

তাই করলাম। এরপর বলেন–‘ক্রলিং’।

আমরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। কথাও বলতে পারছি না। কারণ কথা বললেই তিনি লাথি মারেন। রাস্তায় রাইফেল নিয়ে ক্রলিং করতে গিয়ে ওইদিন কনুই ছিড়ে রক্ত ঝরছিল। তবুও পাকিস্তানি ওই ক্যাপ্টেন বলতে থাকেন– ‘শালা, মাদারচোদ, শেখ মুজিব তেরা বাপ লাগতা হে। কেয়া বলতাহে তুম। কেয়া বগ বগ করতাহে বাঙালিকা সাথ।’

সত্তরের নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু তবুও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বাঙালিদের দমাতে ভেতরে ভেতরে তারা নানা সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। ওই সময় মাকসুদুর রহমানদের সতেরো উইংসহ পুরো ব্যাটেলিয়ানকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাপ্তাইয়ে। মূলত কাপ্তাই বিদুৎকেন্দ্র আর বাঁধের ৩৬টি স্পটে ডিউটি ছিল ইপিআরের সৈনিকদের। ওখানে তিনি ছিলেন সি কোম্পানিতে। ওটা ছিল হেডকোয়ার্টার কোম্পানি। উইংয়ের কমান্ডার ছিলেন একজন পাকিস্তানি, নাম মেজর পীর মোহাম্মদ। তবে তার কোম্পানির কমান্ড করতেন বাঙালি ক্যাপ্টেন হারুনুর রশিদ চৌধুরী। উনি ছিলেন উইং টুয়াসিও।

এনসিও–হাবিলদার, নায়েক, নায়েক সুবেদাররা বেশ সচেতন ছিলেন। নির্বাচনের পর তারা কনফার্ম হয়ে যান–কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে দেশে। কেউ কেউ বাইরের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে থাকেন।

মাকসুদুরের ভাষায়– ‘আমরা তাদের ওস্তাদ ডাকতাম। তারা কৌশলে নানা ইঙ্গিত দিতেন। তখন বড় বড় মটোলা ওয়্যারলেস ছিল। ওয়্যারলেসে যারা ডিউটি করত তারা সবাই ছিলেন বাঙালি। নায়েক সুবেদার শফিউল্লাহ ওয়্যারলেসের ইনচার্জ। এছাড়া স্বাধীনতার পক্ষে উদ্যোগী ছিলেন নায়েক সুবেদার খোরশেদ আলম, হাবিলদার আক্তার, হাবিলদার বজলু, সুবেদার জববুল হোসেন প্রমুখ। তারা বলতেন– ‘হুশিয়ার, যে কোন সময় কিছু হতে পারে।’ পরে ক্লাস নেওয়ার সময় গোপানে ডিটেইল জানাতেন।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন রেসকোর্স ময়দানে। ওই ভাষণ আমরা শুনি পরদিন, রেডিওতে। আমরা উদ্দীপ্ত হই। মূলত ওই ভাষণের পরই ব্যারাকে ননবেঙ্গলি ও বেঙ্গলি–দুটি ভাগ হয়ে যায়। ওরা বেলুচ, পাঞ্জাব ভাষায় নিজেদের মধ্যে ও উচ্চমহলে কথা বলত। এগুলো সিনিয়ররা বুঝতেন। তারা তা আমাদের জানিয়ে ঐক্যবদ্ধ ও সর্তক থাকতে বলতেন।’

মার্চের বিশ তারিখের পর থেকে ওদের অ্যাকটিভিটি বেড়ে যেতে থাকল। বিভিন্ন কোম্পানি হিলের বিভিন্ন জায়গায় ডিউটিরত ছিল। নতুন ল্যাঙ্গুয়েজ প্রশিক্ষণের কথা বলে তাদের ডাকা হলো হেডকোয়াটার্সে। যাদের ডাকা হলো তারা সব ছিল ননবেঙ্গলি–পাঠান, বেলুচ ও পাঞ্জাবি। নায়েক ও হাবিলদার এদের ক্লোজ করে নেওয়া হয়। সার্পোট প্লাটুনের জোয়ানদের পোস্টিং দিয়ে প্রতি জায়গায় বসিয়ে দেওয়া হয় একজন পাঞ্জাবি। এর ফলে বাঙালি সৈন্যদের সন্দেহ যায় বেড়ে।

ভিডিও: কেমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো.মাকসুদুর রহমান

২৫ মার্চ তারিখে ব্যারাকে ঘটে আরও ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের সেসব অজানা ইতিহাস শুনি মাকসুদুর রহমানের জবানিতে–

‘ওইদিন কাপ্তাই বাঁধের ৩৬টি স্পটের পাহারায় বসানো হয় নতুন সৈন্য। একেকটা স্পটে দুইজন সৈনিক ও একজন এনসিও থাকত। এনসিও দেওয়া হলো ননবেঙ্গলি আর দুই সৈনিক হিসেবে থাকে বাঙালি। এটা সব জায়গাতেই করা হলো। বিকেল ৫টায় ফলিং করানো হয়। সাধারণত সেখানে সুবেদার মেজররা থাকেন। কিন্তু ওইদিন পীর মোহাম্মদ সাহেব চলে আসলেন। তাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। দ্রুত কেন এত রদবদল! ধরেই নিই– খারাপ কিছু ঘটবে।

সন্ধ্যার পর ক্যাম্পের পাশ দিয়ে মশাল মিছিল যায়। আমাদের মনেও তখন নানা উৎকণ্ঠা। রাতে খাওয়া শেষে রোলকল হলো। তখন জানানো হয় পরদিন সকালে দরবার প্যারেড হবে। সকল সৈনিককে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে।

২৫ মার্চ গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মেসেজটি ইপিআরের ওয়্যারলেসেই থ্রো করা হয়েছিল। ওয়্যারলেসের ইনচার্জ নায়েক সুবেদার শফিউল্লাহ সেটি পেয়ে ছুটে যান হারুন সাহেবের বাংলোতে। তিনিই ছিলেন একমাত্র বাঙালি অফিসার, আমাদের ভরসার জায়গা।

তিনি দ্রুত ওয়্যারলেস সেন্টারে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধুর মেসেজসহ ওয়্যারলেসে ঢাকার পিলখানা, রাজারবাগ ও ইউনিভার্সিটি আক্রমণের খবর নিশ্চিত হন। তখন সুবেদারদের নিয়ে ৩৬টা পোস্টে ননবেঙ্গলি এনসিওদের অ্যারেস্ট করান। আমরা তখনও ব্যারাকের ভেতর।

রাত তখন পৌনে একটার মতো। ব্যারাকের দরজার পাশেই পাকিস্তানি জাফরুল্লার খাট। সে হাবিলদার হায়াতুল্লাহকে উঠাতে এসে বলে– ‘উঠো, ক্যাপ্টেন হারুনকো পাকারকো আনো, শালা লোককে মার ডালেগা।’ আমরা চিৎ হয়ে শুয়ে সব শুনছিলাম। মনে তখন অজানা আতঙ্ক।

কিছুক্ষণ পরেই ক্যাপ্টেন হারুন তার দল নিয়ে চলে আসেন। অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন এক পাঠান, নাম হাবিলদার কুদ্দুস। তাকে অ্যারেস্ট করার পরই হারুন সাহেব বললেন– ‘যারা ননবেঙ্গলি আছো এনসিও, জেসিও অথবা সিপাহি তোমরা ব্যারাকের ভেতর বসে থাকবে। যারা বাঙালি আছো তাড়াতাড়ি অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে নাও।’ আমরা দ্রুত অস্ত্র নিয়ে ব্যারাকের ভেতর ওদের অ্যারেস্ট করি।

এর পরই পুরো একটা কোম্পানি বের হয়ে আসি। পাশেই ছিল ফায়ার ব্রিগেডের অফিস। সিনিয়ররা পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন খারাপ কিছু ঘটলে তাদের মাধ্যমে শহরে সাইরেন বাজানো হবে। তাই করা হলো। দেখলাম শত শত মানুষ সাহায্য করার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এই সাধারণ মানুষগুলোই আমাদের সাহস জুগিয়েছিল।

ফজরের আজানের সময় আমরা কালুরঘাটে পৌঁছি। ব্রিজ পার হয়ে রেললাইনের বাম সাইডে পাহাড়ি গ্রাম, ওটা বোয়ালখালি এলাকা। ২৬ মার্চ মাগরিবের আগ পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান নিই। সন্ধ্যায় বিভিন্ন জায়গায় ডিউটি দেওয়া হয়। আমার সেকশনটার দায়িত্ব ছিল বদ্ধারহাট এলাকায়। নায়েক ইউনুস সাহেব তখন সেকশনের কমান্ড করছিলেন। এর পর ডিউটি করি কালুরঘাট রেডিও সম্প্রচার কেন্দ্রে। ওখানে সকাল থেকে গেইটের পাশে পাহারায় থাকতাম। পরে চলে যাই এ কে খান ম্যাচ ফ্যাক্টরির একটা স্কুলে।

এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনারা কালুরঘাটের দিকে আক্রমণ করে। মধ্যরাত থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। তখন মাকসুদুর রহমানরা কী করলেন?

তার উত্তর- ‘এ কে খান ম্যাচ ফ্যাক্টরির দিকে ওরা আসলে পজিশনে চলে যাই। আমির আলী আর কালু মিয়া নামে দুইজন এলএমজি ম্যান ছিলেন। ব্রাশফায়ার করলে ওরা পড়ে যায়। আমরা তখন প্রায় ১০ জন ইস্পাহানিতে ঢুকে পড়ি। ওখানে আরেক কোম্পানি নিয়ে অবস্থান করছিলেন নায়েক সুবেদার রহিম। তাদের সঙ্গেই থাকতে থাকি।

ইস্পাহানির একদিকে কর্ণফুলী নদী, তিনদিকে ঘিরে থাকে পাকিস্তানিরা। ভেতরে আমরা আটকা। নদীপাড় থেকে এক মাঝি এসে বলে–‘আপনাদের বিভিন্ন জায়গার লোক নদীর ওপারে আছে, বোয়ালখালি স্কুলে। কিন্তু দিনে যাওয়ার উপায় নাই। যেতে হবে রাতে, নদী পথে।’

গেইটে এলএমজি বসানো ছিল। ওখানেই ডিউটিতে আমি। দেখলাম খুব কাছেই ওয়্যারলেসের এরিয়াল দেখা যায়। বুঝে যাই পাকিস্তানি সেনারা চলে আসছে। আমাদের বলা হলো ড্রেন দিয়ে নদীর দিকে চলে যেতে। তাই করি। কিন্তু তখনই বোম্বিং শুরু হয়। নদীতে খুব জোয়ার ছিল। পাশেই একটা খাল ধরে এগোতে থাকি। স্রোতের কারণে অস্ত্র পার্ট বাই পার্ট আলাদা করে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে পোশাক খুলে ফেলি। হঠাৎ চলে আসে পাকিস্তানিদের গানবোট। আমরা তখন কচুরিপানায় শরীর লুকাই। ডুব দিয়ে কোনোরকমে নাকটা ভাসিয়ে রাখি। ক্ষণেক্ষণে ছিল মৃত্যুভয়। বহুকষ্টে বোয়ালখালিতে গিয়ে দেখি কেউ নেই। পরে পটিয়া ও বান্দারবান হয়ে চলে যাই ভারতের দেমাগ্রিতে।’

ভারতে গিয়ে কি আবার ট্রেনিং করতে হলো?

‘আফসার আলী সরকার, আব্দুল হাকিম, আরেক হাকিম, রফিকসহ চলে যাই ভারতের লোহারবনে। অস্ত্র প্রশিক্ষণ তো আগেই ছিল। ওখানে হাই এক্সপ্লোসিভের, পিকে ওয়ান, বুবিট্রুপস, মাইনস, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি পারসোনাল মাইনস প্রভৃতির ওপর বিশ থেকে পঁচিশদিন ট্রেনিং করানো হয়। জুনের দিকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার নম্বর সেক্টরের কমলগঞ্জে। ক্যাপ্টেন এনাম ছিলেন কমান্ডে।

প্রথম প্রথম ভারত থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করেই ফিরে যেতাম। পরে অপারেশন করি সিলেট কমলগঞ্জের ধলাই, পাথরঘাটা ব্রিজ, খুরমা প্রভৃতি স্থানে। সিলেটে প্রচুর জোঁক ছিল। আমরা জঙ্গল বা চা বাগানে পজিশন নিতাম। সারা শরীরে জোঁক লেগে থাকত। ফিরে এসে শরীর থেকে জোঁক ছাড়াতাম। রক্তে লাল হয়ে যেত গোটা শরীর।’

এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন এই বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া আর্টিলারির স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হয় তার মাথা, নাক, পা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ। কী ঘটেছিল ওইদিন? বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মাকসুদুর রহমান। একাত্তরের স্মৃতি তাকে অশ্রুসিক্ত করে। খানিক পরে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন ওইদিনের আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়–

‘সিলেট কমলগঞ্জের ধলাইতে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালি ঘাঁটি। তারিখটা সম্ভবত ১৭ জুলাই। আমরা তখন ভারতের বালুগাঁ নামক জায়গায় পজিশনে। হঠাৎ এনাম সাহেব ডেকে নিলেন। সবাইকে ফলিং করালেন। এরপর একজন ভারতীয় আর্মি ব্রিফ করে জানালেন ধলাই অপারেশনের কথা। বলা হলো রাত ১২টায় সেখানে পজিশন নিতে হবে। ছোট ছোট ট্রুপ করা হলো। এলএমজি ম্যান আফসার আলী সরকারের সঙ্গে দেওয়া হলো আমাকে।

ভারত থেকে প্যারাসুট বোমা মারা হবে প্রথমে, ভোরের দিকে আমরা অ্যাটাকে যাব– এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু বোম্বিং শুরু হলে পাকিস্তানি সেনারা বিকল্প অবস্থানে সরে পড়ে। ভোরের দিকে আমরা জয় বাংলা বলে আক্রমণ করি। চা বাগান ছিল ওখানে। ওদের খুব কাছাকাছি চলে আসলেও কোনো বাধার মুখে পড়ি না।

আফসারের কাছে ছিল এলএমজি। মনসুরের কাছে আরেকটা। ফায়ার করতে করতে সামনে এগোই। সকাল হয়-হয়। হঠাৎ আফসারের এলএমজি বন্ধ হয়ে যায়। ম্যাগজিন আমার কাছে। দুইজনে মিলে এলএমজির ব্যারেলটা খুলে দেখছি কি হলো। এমন সময় আকাশে বিজলি চমকানোর মতো কিছু ঘটল। পাকিস্তানিরা তখন বোম্বিং শুরু করেছে। গর্জে ওঠে ওদের মেশিনগানগুলোও।

মাকসুদুর রহমানের ডান পায়ে এখনও দুটো স্প্লিন্টার রয়েছে

গুলির তোড়ে আমরা পেছনে ছিটকে পড়ি। এরপর চা বাগানের একটা গাছের ওপর এসে আর্টিলারি পড়ে। সেটা বার্স্ট হতেই স্প্লিন্টার এসে লাগে আমার মাথায়, নাকে, পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। পেছনে হাকিমসহ অন্যরা আমাদের উঠায়। সারা শরীর তখন রক্তাক্ত। ব্যাচমেট ছিল হাকিম। ও আমাকে বুকে জড়ায়া ধরেই কেঁদে দেয়। একাত্তরে আপন ভাইয়ের চেয়েও বড় ছিল সহযোদ্ধারা। আমি বলি– আফসার ভাইকে ধরো। সে তাই করে। ছুটে আসে মনসুরও। কাঁধে তুলে আমাদের সরিয়ে নেয়। গোটা মুখমণ্ডল রক্তাক্ত। চোখ বন্ধ। মনে করেছি চোখ চলে গেছে। তখন তো কোনো কিছুই অনুভব হচ্ছিল না। ভেবেছিলাম মরেই যাব। ওইদিন মফিজকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। ওর চোখে ও নাভির নিচে গুলি করে সমশেরনগর পাকিস্তানি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার লাশটাও পাইনি আমরা।

আমার চিকিৎসা হয় ভারতের কমলপুর হাসাপাতালে। স্প্লিন্টার ওখানেই অপারেশন করে বের করে আনা হয়। ডান পায়ের ভেতরে দুটি স্প্লিন্টার এখনও রয়ে গেছে। ওই পায়ে ব্যথা হয় প্রায়ই। পা-টা কারেন্টের শক দিলে যেমন হয় তেমন লাগে। লাথি দেওয়ার মতো করে তখন পা ঝাঁকি দিতে হয়। রাতে ঘুমের ভেতর কোথায় বাড়ি দিলাম খেয়াল নেই। পায়ের নখ গিয়ে লাগে স্ত্রীর পায়ে। ওর পায়ে আমার নখের আঘাতে ঘা হয়ে গেছে। কিন্তু সবকিছু সহ্য করছে স্বামীর কষ্টের কথা ভেবে। একজন যুদ্ধাহতকে নিয়ে পরিবারের যুদ্ধটাও কিন্তু কম নয়, ভাই। আর শরীরের যুদ্ধটা তো চলবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।’

চিকিৎসা শেষে এই যোদ্ধা আবারও ফিরে যান রণাঙ্গনে। ডিসেম্বরের তিন বা চার তারিখ বানুগাছায় ছিলেন। এর পর চলে যান শ্রীমঙ্গলে। সিলেট মুক্ত হলে জামিয়াতে অস্ত্র জমা দিয়ে চলে আসেন ঢাকায়, পিলখানাতে।

যে দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?

প্রশ্ন শুনে মুক্তিযোদ্ধা মাকসুদুর রহমানের অকপট উত্তর- ‘সে দেশ তো পেয়েছিলাম। আবার হারিয়ে ফেলেছি। আবার হয়তো পাব। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ উল্টো দিক চলতে থেকে। সম্পূর্ণ চিত্রটাই পাল্টে যায়। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার কারণে আমাকেও বিডিআর থেকে তখন চাকরি হারাতে হয়েছে। হবিলাদার পর্যন্ত হয়েছিলাম। সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীতে ফাইটার ও ননফাইটার দ্বন্দ্ব শুরু হতে থাকে তখন। সিনিয়ররা অধিকাংশই ছিলেন ননফাইটার। তারা আমাদের দেখতে পারতেন না। মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই বলতেন– থোও তোমার ওই যুদ্ধটুদ্ধর কথা। মুক্তিযুদ্ধকে কেউ কেউ বলত– গণ্ডগোল। খুব খারাপ লাগত তখন। তর্ক করে রোষানলেও পড়েছি কয়েকবার। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কোনো দাম ছিল না মুক্তিযোদ্ধাদের।’

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন দেশ নাই যেখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করতে পারে। এটা ছিল ও আছে শুধু বাংলাদেশে। জিয়ার পাকিস্তানপ্রীতির কারণেই স্বাধীনতাবিরোধীরা রাজনীতি করার বৈধতা পেয়েছে বলে মত দেন মুক্তিযোদ্ধা মাকসুদুর রহমান। তিনি মনে করেন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধসহ এদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি বন্ধ করা উচিত।

আজকে যখন অকপটে শিশুরা জয় বাংলা বলে, বঙ্গবন্ধুকে অঙ্কন করে, তাকে অনুভব করতে পারে–তখন মন ভরে যায় এই বীরের। তিনি মনে করেন কমলমতির অন্তরে যদি বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা স্থান করে নেয় তবে ওই শিশুর হাত ধরেই সোনার বাংলা হবে। কেননা রক্ত দিয়ে আনা স্বাধীনতা ও ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণ বৃথা যেতে পারে না।

তার ভাষায়– ‘এখনও জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু বলতে পারলে আমি সুস্থ থাকি। আজ আপনার মতো ছেলেরা স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করছে। প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে চাচ্ছে ও পারছে। এটাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’

খারাপ লাগে কখন?

‘বড়লোক হওয়ার পাড়াপাড়ি দেখলে। কেন এত সম্পদের দরকার মানুষের। আমার নেতা বঙ্গবন্ধু। যিনি বাংলাদেশ দিলেন, তার কি সম্পদ ছিল? এ দেশের এক শ্রেণির মানুষ এখনও মাতৃভূমিকে ভালোবাসতে শেখেনি। স্বার্থের জন্য জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করছে যারা তারাই আওয়ামী লীগ ও দেশের শত্রু। আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে কোটি টাকার ধান্ধা করছে কারা? তাদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। আবার নেতাকর্মীদেরও বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। তা না হলে তার স্বপ্নকে তারা অনুভবও করতে পারবে না!’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান

কী করলে দেশ আরও এগিয়ে যাবে?

মুচকি হেসে এই যুদ্ধাহত বলেন– ‘আমাদের কথার কি কোনো মূল্য আছে? আমি বলব প্রশাসনের দিকে নজর দিতে হবে। মুখে জয় বাংলা বলে কারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় সেটা খেয়াল করতে হবে। বিচার ব্যবস্থাকে গতিশীল করা খুব দরকার। কাদের হাত ধরে আওয়ামী লীগের ভেতর বহিরাগতরা ঢুকেছে? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সরকারের সুনাম বাধাগ্রস্থ হবে। এক শেখ হাসিনা কি করবেন? তিনি তো রাতদিন দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। প্রত্যেককে নিজের জায়গা থেকে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার মতো সৎ হলে দেশটা সত্যি বদলে যাবে। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না ভাই।’

দুর্নীতিবাজ ও অসৎ লোকের সংখ্যা খুব কম, বাংলাদেশে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি–এমনটাই মনে করেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান। দেশের খেটে-খাওয়া তরুণ ও যুবকরাই একাত্তরে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই এ দেশ একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবে–এমনটাই বিশ্বাস এই যোদ্ধার। তাই তাদের উদ্দেশ্যেই তিনি বললেন শেষ কথাগুলো– ‘তোমরা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেস। প্রকৃত বীরত্বের ইতিহাসটাকে ছড়িয়ে দিও। রক্তে পাওয়া এই স্বাধীন দেশটাকে তোমরাই পারবে সোনার বাংলা করতে।’

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. মাকসুদুর রহমান।

ছিলেন: ইপিআরের জিডি সিপাই। বডি নম্বর ছিল ১৯২৭৫। এছাড়া ভারতের লোহারবন থেকে হাই এক্সপ্লোসিভের, পিকে ওয়ান, বুবিট্রুপস, মাইনস, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক, অ্যান্টি পারসোনাল মাইনস প্রভৃতির ওপর বিশ থেকে পঁচিশদিনের ট্রেনিং নেন।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: চার নম্বর সেক্টরের অধীনে সিলেট কমলগঞ্জের ধলাই, পাথরঘাটা ব্রিজ, খুরমা প্রভৃতি জায়গায়।

যুদ্ধাহত: তারিখটা সম্ভবত ১৭ জুলাই। সিলেট কমলগঞ্জের ধলাইতে পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালি ঘাঁটি অপারেশনের সময় আর্টিলারির স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয় তার মাথায়, নাকে, পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। ডান পায়ের ভেতরে দুটি স্প্লিন্টার এখনও রয়ে গেছে।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন

লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০

© 2020, https:.

এই ওয়েবসাইটটি কপিরাইট আইনে নিবন্ধিত। নিবন্ধন নং: 14864-copr । সাইটটিতে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো তথ্য, সংবাদ, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Show More

Salek Khokon

সালেক খোকনের জন্ম ঢাকায়। পৈতৃক ভিটে ঢাকার বাড্ডা থানাধীন বড় বেরাইদে। কিন্তু তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা, শিক্ষা ও কর্মজীবন। ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক সংস্কৃতির প্রতি। নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। যুক্ত ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও থিয়েটারের সঙ্গেও। তাঁর রচিত ‘যুদ্ধদিনের গদ্য ও প্রামাণ্য’ গ্রন্থটি ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে ‘কালি ও কলম’পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী ও ভ্রমণবিষয়ক লেখায় আগ্রহ বেশি। নিয়মিত লিখছেন দেশের প্রথম সারির দৈনিক, সাপ্তাহিক, ব্লগ এবং অনলাইন পত্রিকায়। লেখার পাশাপাশি আলোকচিত্রে নানা ঘটনা তুলে আনতে ‘পাঠশালা’ ও ‘কাউন্টার ফটো’ থেকে সমাপ্ত করেছেন ফটোগ্রাফির বিশেষ কোর্স। স্বপ্ন দেখেন মুক্তিযুদ্ধ, আদিবাসী এবং দেশের কৃষ্টি নিয়ে ভিন্ন ধরনের তথ্য ও গবেষণামূলক কাজ করার। সহধর্মিণী তানিয়া আক্তার মিমি এবং দুই মেয়ে পৃথা প্রণোদনা ও আদিবা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back to top button