উন্নয়ন মানে পাহাড়ের চূড়ায় পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ নয়!
৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখ। সকালে এক সাংস্কৃতিক প্রদশর্নী ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে ম্রোরা। বান্দরবান জেলা শহর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ে কাপ্রু পাড়ায় অনুষ্ঠিত হয় এ কর্মসূচি। সেখানে দেওয়া রেং ইয়ং ম্রো নামক যুবকের বক্তৃতাটি ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যা আমাদের ভেতরটাকে নাড়া দেয় প্রবলভাবে। উন্নত বাংলাদেশের পাশে খুঁজে পাই রুগ্ন দেশকেও।
রেং ইয়ং ম্রো বলেছেন: ‘নীলগিরি কোনোদিন আমাদের নাম ছিল না, চন্দ্রপাহাড় কোনোদিন আমরা চিনি না। আমরা শোং নাম হুং নামে চিনেছি, আমরা তেংপ্লং চূট নামে চিনেছি। এই শোং নাম হুং কিভাবে চন্দ্রপাহাড় হয়ে যায়, এই তংপ্লং চূট কিভাবে নীলগিরি হয়ে যায়? এই জীবননগর কিভাবে তোমাদের জীবননগর হয়ে যায়? এই ভূমি, এই মাটির প্রত্যেকটা ইঞ্চি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি।
এই চিম্বুক পাহাড়ে একটাও প্রাইমারি স্কুল নেই, একটাও সরকারি হাইস্কুল নেই। কোন মুখে আপনারা এখানে উন্নয়নের কথা বলেন, কোন মুখে বলেন আমরা ম্রোদের জন্য উন্নয়ন করছি, ম্রোদের উন্নতির জন্য পর্যটন করছি। আপনাদের ভিটেমাটিতে যদি কোনো ম্রো জনগোষ্ঠী গিয়ে জায়গা দখল করে, আপনাদের জায়গায় গিয়ে যদি আমরা বলতাম এটা আমাদের পর্যটন স্পট, আপনাদের কেমন লাগত একবার নিজের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করুন। যেদিন আপনারা এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবেন, সেদিন আমাদের প্রশ্নও বুঝতে পারবেন।’
রেং ইয়ং ম্রোয়ের প্রশ্নগুলোর উত্তর কি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কেউ দিয়েছেন? আমাদের জানা নেই।
বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এখনও চলছে বিভিন্ন স্থানে। হোটেলটি নির্মাণ করবে সিকদার গ্রুপের ‘আর এন্ড আর হোল্ডিংস। হোটেল নির্মাণের জন্য ৩০ একর জমি ইজারা পাওয়ার দাবি করলেও এর বাইরে গিয়ে তারা ফ্ল্যাগ ও নানা ধরনের সাইনবোর্ড স্থাপন করে। ফলে প্রায় ‘এক হাজার একর’ জুমচাষের জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছে ম্রো আদিবাসীরা।
তারা বলছেন, সিকদার গ্রুপ সেনা কল্যাণ ট্রাস্টকে নিয়ে কাপ্রুপাড়া থেকে নাইতং পাহাড় হয়ে জীবননগর পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণের জন্য জমি দখলের পাঁয়তারা করছে। যার ফলে ম্রোদের চারটি গ্রাম পরোক্ষভাবে এবং ৭০ থেকে ১১৬টি পাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং ১০ হাজারের মতো জুমচাষি উদ্বাস্তু হওয়ারও শঙ্কা তৈরি হবে। এ নিয়ে ৭ অক্টোবর চিম্বুক পাহাড়ের ওপর পাঁচ তারা হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়াবাসী এবং চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসরত ম্রো জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় দেড়শো আদিবাসীর স্বাক্ষর সম্মলিত একটি স্মারকলিপি প্রধানমন্ত্রীর বরাবরের পাঠানোর জন্য বান্দরবান জেলা প্রশাসকের নিকট প্রদান করেছে তারা। কিন্তু সেটির বিষয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ বা বক্তব্য এখনও মেলেনি। জেলা প্রশাসন কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায়, চিম্বুক পাহাড়ে সিকদার গ্রুপের ‘আর এন্ড আর হোল্ডিংস’কে কতটুকু জমি ইজারা প্রদান করেছে-সেটিও স্পষ্ট করা বিশেষ প্রয়োজন।
পর্যটনের নামে পাহাড়ের পরিবেশ বিপন্ন করে ম্রোদের প্রাচীণ ভূমিকে দখলের ঝুঁকিতে রেখে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ কতটা যৌক্তিক সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকেই বলছেন, পর্যটনের উন্নয়ন করার অর্থ কোনোভাবেই পাহাড়ে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ নয়। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত উদ্যোগও আশা করেন তারা।
আদিবাসীরা বলছেন- চিম্বুক পাহাড়ে আদিকাল থেকে জুমচাষ করে বসবাস করে আসছে ম্রোরা। আর এখন নিজেদের ভূমি রক্ষা করার জন্যই পথে নামতে হচ্ছে। সিকদার গ্রুপের পর্যটন স্থাপনার জন্য পাড়ার কবরস্থানে গত বছর থেকে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া চলছে ছড়ায় পানির ট্যাংক বসানোর জন্য মাটি খোঁড়াখুঁড়ি। ফলে এরইমধ্যে পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
পাহাড়ে জনবসতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানির সংকটও বাড়বে। সরকারিভাবে যে নলকূপগুলো এ অঞ্চলে বসানো হয়েছে, সেগুলোর অর্ধেকেই পানি ওঠে না। এসব অঞ্চলে বিদ্যালয়ের সংখ্যাও নগন্য। আবার বেশির ভাগ বিদ্যালয়েই নেই পানির ব্যবস্থা। পাহাড়ের ঝিরিগুলোতে শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে যায়। তলানিতে যেটুকু থাকে তাও হয় ময়লাযুক্ত। সে পানিই ছেঁকে ব্যবহার করতে হয় আদিবাসীদের। পানি ফুটিয়ে পান করারও উপায় নেই। ফলে শুকনো মৌসুমে ডায়রিয়াসহ পেটের পীড়ায় ভোগেন এখানকার মানুষ। অনেক জায়গায় কুয়োর ব্যবস্থা থাকলেও বর্ষায় ময়লাতে ভরে যায় কুয়োগুলো। তখন বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা। মূলত পানির জন্য এক ধরনের সংগ্রাম করেই টিকে থাকতে হচ্ছে পাহাড়ের আদিবাসীদের।
পানির উৎস থেকে পাথর তুলে নেওয়ায় এবং পাহাড়ে বন উজাড় হওয়ায় পাহাড়ি ঝিরিগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার পাহাড়ধস এবং জনবসতি বাড়ার কারণে অনেক পানির উৎস ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেক ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে। ফলে পানির সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। পাহাড়ে ঝিরি ও ছড়াগুলো বাঁচাতে না পারলে পানির এই কষ্ট আরও বাড়বে। হোটেল স্থাপনের সংখ্যা বাড়লে এটি আরও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
চিম্বুক পাহাড়ে পর্যটন স্থাপনার নামে এর আগেও শত শত জুমচাষের জমি দখল করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ। কিন্তু পর্যটন স্থাপনার নামে ম্রোদের ভূমি যদি দখল বা উচ্ছেদ করা হয় তবে সে পর্যটন তাদের কি উপকারে আসবে?
ম্রো আদিবাসীদের সংখ্যা এদেশে খুবই কম। এ জাতির মানুষদের অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেই বরং সুরক্ষার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। সেটি তো হয়ইনি, উল্টো বিলাসী জীবনের ব্যবসার জন্য ক্রমেই বেদখল হচ্ছে ম্রোদের বাপ-দাদার আমলের ভূমিটুকুও। যা তাদের প্রতি অবহেলাকেই স্পষ্ট করে।
এটি শুরু হয়েছে আরও আগে। পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়ে তোলার ফলে সে সময় ভূমি হারায় প্রায় এক লাখ আদিবাসী। তখন প্লাবিত হয় তাদের ৫৪ হাজার একর জমি। ফলে বিপুল সংখ্যক চাকমা চিরতরে আশ্রয় নেয় ভারতের অরুণাচল প্রদেশে। এর পর নানা কারণেই বাস্তচ্যূত হয়েছে আদিবাসীরা, এখনও হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি হয়। ফলে পাহাড়ে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে। এ চুক্তির জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইউনেসকো শান্তি পুরস্কার’ লাভ করেন। অথচ পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার এখন নিশ্চিত হয়নি।
আবার পার্বত্য অঞ্চলে সেটেলার বাঙালিদের পুনর্বাসনের সময় প্রতিটি পরিবারকে কিছু জমির মালিকানাসংক্রান্ত কবুলিয়তনামা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলোর অধিকাংশই তারা নিয়মবর্হিভুতভাবে বিক্রি করে দিয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানের কাছে। বর্তমানে এই প্রভাবশালী চক্রের মাধ্যমে পাহাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে হোটেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প। কয়েক বছর আগে পার্বত্য বিষয়ক সংসদীয় কমিটির অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।
তাই শুধু সেটেলার বাঙালিরাই নয়, পার্বত্য অঞ্চলে এখন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে কাজ করছে এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চক্রটিও। এ ধরনের ভূমি দখলের কারণে সাজেক, রামগড়, মহালছড়ি, বরইতলীতে সংঘাত হয়েছে। এবং এখনো তা থেমে নেই। এভাবেই আদিবাসীরা পাহাড়ে হারাচ্ছে ভূমির অধিকার। বাড়ছে রক্তপাত। বাড়ছে আদিবাসীদের কান্না।
পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এই মালিকানা বংশ পরম্পরায় মৌখিক। তিনটি সার্কেলের আওতায় পার্বত্য পাড়ার হেডম্যান এবং কারবারিরা এর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। পরিসংখ্যান বলছে গত ৩০ বছরে পার্বত্য অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণাধীন ভূমির পরিমাণ কমেছে শতকরা ৫১ ভাগ। তিন দশক আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ। যা এখন ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে।
বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি সকলের জন্য আবাসন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করছেন। যাদের জমি আছে, তাদের ঘর করে দিচ্ছেন। যাদের জমি নেই তাদেরও সরকারি খাস জমিতে আবাসনের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু কেন পার্বত্য অঞ্চলে ম্রোদের নিজের ভূমি রক্ষায় পথে নামতে হচ্ছে?
চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের বুকে জমানো কষ্টের কথাগুলো হয়তো সরকারপ্রধানের কাছে পৌঁছাবে না। কিন্তু আমরা চাই ম্রো জাতিসহ পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত হোক। উন্নয়ন মানে পাহাড়ের চূড়ায় পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ নয়! কার ইশারায়, কোন ক্ষমতায় বদলে যায় পাহাড়ের নাম-সেটিও বন্ধ হোক।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ১৭ নভেম্বর ২০২০
© 2020, https:.