১৯৭১: কীভাবে এলো আত্মসমর্পণের সেই টেবিল?
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে তড়িঘড়ি করেই আয়োজন করা হয় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান।
দুই বাহিনীর শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা তৈরি। সামরিক আয়োজনও প্রায় শেষ। কিন্তু দলিলে সই করতে গেলে লাগবে একটি টেবিল। তড়িঘড়ি করে সেটাও জোগাড় করে ফেলা হলো।
জাতীয় জাদুঘরে রাখা আছে ওই টেবিলটি। তিন হাত বাই দেড় হাত টেবিল। ওপরের কাঠে চারদিকে ঢেউ-খেলানো নকশা। পায়ার নকশা বলতে লম্বা দুটি খাঁজ, বিশেষ কোনো কারুকাজ নেই। পায়াগুলো ক্রমশ ওপর থেকে নিচের দিকে সরু।
এমন একটি সাদামাটা টেবিলের ওপরই দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল যা মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্তের সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু কারা ও কীভাবে এনে দেয় আত্মসমর্পণের ওই টেবিলটি? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই একবার ঢাকার গেরিলা বীরপ্রতীক বজলুল মাহমুদ বাবলুর মুখোমুখি হই।
এ এস ইসমাইল ও মাহমুদা বেগমের পঞ্চম সন্তান বাবলু। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ধানমন্ডি হাই স্কুলে। পরে আজিমপুরের ওয়েস্টঅ্যান্ড হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তারপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন কায়েদে আজম (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী) কলেজে।
১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। একাত্তরের নানা অজানা তথ্য দিয়েই তিনি কথা শুরু করেন। তার ভাষায়, আমাদের একটা ক্লাব ছিল ভূতের গলিতে, নাম ‘উদিতি ক্লাব’। শেখ কামাল এসেও সেখানে খেলতেন। আমার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। ধানমন্ডি মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। ফলে আন্তরিকতা ছিল শেখ কামালের সঙ্গে। গোটা ধানমন্ডিকেই তখন আমরা একই মহল্লা ভাবতাম।
মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। রেজাল্টও বের হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের ঘটনা। শেখ মুজিবকে আনকন্ডিশনালি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার। ওইদিন হাজার হাজার লোক জড়ো হতে থাকে বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। তারা একনজর দেখতে চান তাকে। ওখানে যেতেই শেখ কামাল বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়।
তখন ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নেন ওপেন জিপে করেই শেখ মুজিবকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাবেন। ওই জিপে কামাল আমাকেও তুলে নেয়। তোফায়েল আহমেদ, মহিউদ্দিন, শেখ সেলিম, আবাহনীর বাচ্চু ভাইও ছিলেন। কলাভবন হয়ে কার্জন হলের ফার্মাসি ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবকে নিয়ে যাই। কিন্তু তাকে নিয়ে ওভাবে বের হওয়াটা ঠিক ছিল না। নিরাপত্তার ঝুঁকি ছিল। এ খবর আসতেই আমরা সর্তক হয়ে যাই। খোলা জিপে আমি আর শেখ কামাল শরীর দিয়ে আড়াল করে রাখি শেখ মুজিবকে। ওই স্মৃতি আজও আমাকে উদ্দীপ্ত করে।
পাকিস্তানিরা বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবতো। একজন বাঙালি সে ভাল খেললেও পাকিস্তান টিমে চান্স পেত না। মিলিটারিতে আমরা ছিলাম মাত্র ৫%। বাঙালিরা কর্নেলের ওপর যেতে পারত না। কোনো কারখানা বাঙালি ব্যবসায়ীদের দেওয়া হতো না। তেজগাঁওয়ের কারখানাগুলো নন বেঙ্গলিরাই কন্ট্রোল করতো। এভাবে বাঙালিদের চরম বঞ্চিত করে ওরা।
সেই বঞ্চনা আর বৈষম্যের কথাই বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেই রেসকোর্স ময়দানে একত্রিত হয়েছিলাম ওইদিন। বাঙালির দাবি সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মুখে। তিনি বললেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্’।
বাঙালির হাতে অস্ত্র নেই। তবুও প্রস্তুত থাকতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের কাছে ওই নির্দেশই ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। রাত তখন আটটা। আর্মি নামার খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। বাবার একটা দোনালা বন্দুক ছিল। সেটি নিয়ে গ্রিনরোডে চলে যাই। উদ্দেশ্য পাকিস্তান আর্মিদের প্রতিহত করা। এলাকার খালেদ, মনির, কবির, লুৎফরসহ আরও অনেকেই রাস্তায় নামে। গাছ কেটে নর্থরোড, সেন্ট্রালরোড, গ্রিনরোড এলাকায় রাস্তা বন্ধ করে দিতে থাকি। পেট্রোল বোমা বানাতে পাম্প থেকে ড্রামে করে পেট্রোল এনেও জমা করি।
কিন্তু এলাকার মানুষ আমাদের ফিরিয়ে আনে। কারণ পাকিস্তানিরা ট্রেন্ড সোলজার। আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারব না। আমরা আক্রমণ করলে উল্টো ওরা গোটা এলাকা ম্যাসাকার করবে। বাড়ি-ঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। তাই বাড়ির ছাদে বসেই আমরা ওদের তাণ্ডব দেখি। সারারাত শুনেছি মানুষের চিৎকার ও গুলির শব্দ।
২৭ মার্চ ১৯৭১। কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ ওঠে। মানুষ তখন ঢাকা থেকে পালাতে থাকে। মোড়ে মোড়ে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি আর্মি। নিউ মার্কেটের দিকে এগোতেই দেখি লাশের স্তুপ। পলাশি হয়ে ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) দিকে যেতেই চোখে পড়ে শত শত লাশ।
ওইদিন ঢাকার রাজপথে ছিল পঁচা লাশের গন্ধ। মুসলিম হয়েও পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলিমকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল একাত্তরে। তখনই বুঝে যাই, আমাদের কোনো চয়েজ নাই। ডু ওর ডাই। যুদ্ধ করতেই হবে। নিতে হবে ট্রেনিং। আনতে হবে অস্ত্র। দেশটা ছোট হতে পারে, কিন্তু একাত্তরে আমাদের মনোবলটা ছিল অনেক বড়।
বাবলুরা এরপর চলে যান ভারতের মেলাঘরে। সাতদিনের ট্রেনিংয়ে শিখে নেন স্টেনগান, এসএলআর, গ্রেনেড ও মাইন বিস্ফোরণের টেকনিক। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে তিনি গেরিলা অপারেশন করেন ঢাকার গ্রিনরোড, কলাবাগান, গ্রিনসুপার মার্কেট, নীলক্ষেত প্রভৃতি জায়গায়। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পনের দলিল যে টেবিলে রেখে স্বাক্ষর করেছিলেন সেটি এনে দেন মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মাহমুদ বাবলুরা।
কীভাবে? তিনি বলেন, সারেন্ডারের খবরটা আমরা আগেই পাই। অস্ত্র নিয়ে ওইদিন সকালেই একটা ওপেন জিপে অবস্থান নিই ঢাকা ক্লাবের কাছে, বটগাছের নিচে। জাহেদ আনোয়ার ছিলেন ড্রাইভিংয়ে। সঙ্গে মিলুও ছিল। ইন্ডিয়ান আর্মিরা বিমানে লিফলেট ছড়াচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ভারতীয় মিগও চলে যায়।
এখন যেখানে শিশু পার্ক তার ভেতরেই হয়েছিল আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠানটি। ইন্ডিয়ান আর্মিদের কয়েকজন এসে বলল একটা টেবিল দরকার। তখন ঢাকা ক্লাব থেকে বের করে আনলাম একটি টেবিল। সেই টেবিলেই ইতিহাস হয়ে গেল। সারেন্ডারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। এটা পরম পাওয়া। ওই মুহূর্তটির কথা ঠিক বোঝাতে পারব না। হাজারো ঈদের মতো আনন্দ ছিল ১৬ ডিসেম্বরের দিনটিতে।
লেখাটি প্রকাশিত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, প্রকাশকাল: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০
© 2021, https:.