প্রকৃতি বিনষ্ট করে হাসপাতাল নয়
চট্টগ্রাম নগরীর সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকায় শতবর্ষী গাছগাছালি ও নজরকাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট করে হাসপাতাল নির্মাণের তোড়জোড় চলছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে এই হাসপাতাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে চমকে উঠি। ব্রিটিশ আমলের চুন-সুরকির সিআরবি ভবনকে ঘিরে শতবর্ষী গাছগাছালি, আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট-বড় পাহাড়-টিলা আর নজরকাড়া বাংলোগুলো নাগরিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এখানকার গাছগুলো নগরবাসীর অক্সিজেনের জোগানদাতা। তাই অনেকেই এলাকাটিকে চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ বলে অভিহিত করেন। তাহলে উন্নয়নের নামে সেই ফুসফুসকেই ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত কীভাবে হচ্ছে! চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) যে মাস্টারপ্ল্যান এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর ১ হাজার ১৫২ বর্গ কিলোমিটার এলাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে সিআরবিকে গুরুত্বপূর্ণ ‘কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ’ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা আছে। তবুও কেন সেখানকার সবুজ ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনায় হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে?
শতবর্ষী গাছগাছালি কেটে সিআরবি এলাকায় স্থাপনা গড়ে তোলার বিষয়ে ওই এলাকার স্থানীয় এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হয় মুঠোফোনে। হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গে কলেজ শিক্ষক ওই বন্ধু বেশ আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েন। অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন সিআরবি এলাকাটি আমাদের আবেগের জায়গা। অনেক বছর ধরে যাই। ভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলনী ওখানেই হয়। প্রায় বিকেলেই যাই ঘুরতে। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক পরিসরের প্রাণকেন্দ্র এই সিআরবি। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হয় এখানেই। সেখানে যদি হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় তাহলে তো সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, নির্জনতা, ঐতিহ্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্যও থাকবে না। সিআরবির গোটা এলাকাটাই তো বড় এক হাসপাতাল, নগরবাসীর প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল হাসপাতাল। অসম্ভব নিরিবিলি, শান্ত, সুন্দর, মনোমুগ্ধকর জায়গাটি। বিশাল বিশাল শতবর্ষী গাছ, পাহাড়, বৃক্ষ, রেলওয়ের পুরনো লাল ইটের দালানকোঠা। সবমিলিয়ে ঐতিহ্য, বিনোদন, অবসর কাটানোর জন্য চট্টগ্রামের বেস্ট জায়গা। এখানে এলে, দুদন্ড বসলে মানুষের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এর চেয়ে প্রশান্তির জায়গা আর কী হতে পারে!
ওই কলেজ শিক্ষকের ভাষ্য : অক্সিজেন কত দামি করোনা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে এখনো। কিন্তু আমরা কি শিক্ষা নিয়েছি? করোনায় আক্রান্তদের বুকভরা নিঃশ্বাস নেওয়ার আকুতি কি আমাদের ভেতরটাকে নাড়া দিয়েছে? উত্তরটি অবশ্যই ‘না’। যার প্রমাণ সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ওই এলাকার পরিবেশ নষ্ট করে হাসপাতাল গড়ে তোলা হলে সেটা হবে জঘন্যতম ঘটনা। আমি বলব পাপই হবে। উন্নয়নের নামে চট্টগ্রামের সবুজ তো ক্রমশ কমছে। সবদিকে ফ্লাইওভার, ঝকঝকে চকচকে রাস্তা, দামি গাড়ির শাঁই শাঁই করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু খালি ইট, কাঠ, পাথরের জঞ্জালে উন্নয়ন মাপলেই হবে কি! ওখানে বসেও তো নিঃশ্বাসটা নিতে হবে? সেই নিঃশ^াসের অক্সিজেনটা কীভাবে আসবে? সেই চিন্তা কি আমরা করছি? চট্টগ্রামের বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় সত্যিকারভাবে আমরা কোন পথে এগোচ্ছি?
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই)’ শীর্ষক যৌথ এক গবেষণায় কোনো দেশের ১০টি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়। যেগুলো হলো : বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ ও কৃষি। কিছুদিন আগে প্রকাশিত পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শিতাবিষয়ক সূচকে দেখা যায় ২০২০ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মতো উচ্চমাত্রার জনঘনত্বপূর্ণ দেশ পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শী না হলে দেশবাসীর স্বাস্থ্যসহ সামগ্রিক জীবনমান ক্রমেই হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাহলে এমন নির্বিচার উন্নয়নের পরিকল্পনা কি আমাদের সে পথেই ঠেলে দিচ্ছে! যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্পের আগে তার পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা জরুরি। সংবিধানের ১৮ (এ) অনুচ্ছেদ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, সরকারের দায়িত্ব পরিবেশ সংরক্ষণ করা; কেননা, গাছ পরিবেশের অপরিহার্য উপাদান এবং আমাদের জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কিন্তু আমরা কি হিসাব করেছি যে সিআরবি এলাকার উদ্ভিদ ও বাস্তুসংস্থানের ওপর কত প্রাণের জীবন নির্ভর করে, আর এসব গাছপালার উৎপাদিত অক্সিজেন এবং শোষিত কার্বন-ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কত? এই সবুজ না থাকলে ওই এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর তার কোন ধরনের প্রভাব পড়বে, উদ্যানের গাছগুলোতে পাখি, কাঠবিড়ালি, বাঁদুড়সহ কত প্রজাতির প্রাণী বছরের কখন কী কারণে আসে, তা নিবিড়ভাবে সমীক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে কি এমন কোনো সমীক্ষা করা হয়েছে?
সিআরবি ভবনটির ঐতিহ্যগত বা ‘হেরিটেজ’ মূল্য অনেক। প্রায় দেড়শ বছর আগে নির্মিত এই ভবন ও সংলগ্ন এলাকা সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। তা না করে হেরিটেজ এলাকার প্রকৃতি নষ্ট করে কেন সেখানে স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত হলো? সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছে নাগরিকরা। এটি সত্য যে, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে চিকিৎসা সেবা এখনো অপ্রতুল। করোনাকাল এসে সেটা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই নতুন অনেক হাসপাতাল নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সিআরবি এলাকার বাইরেও তা হতে পারে। চট্টগ্রামে অনেক জায়গাও রয়েছে। এভারকেয়ার নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালও হয়েছে শহর থেকে সামান্য দূরে। সেটি করতে তো গাছ আর পাহাড় কাটা, নদীও ভরাট করতে হয়নি। নিরিবিলি পরিবেশে, জমি ভরাট করেই হাসপাতালটি গড়ে তোলা হয়েছে। সচেতন নাগরিক সমাজ ছাড়াও রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারীরাও সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিপক্ষে। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি এবং রেলওয়ের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। তারা বলছে, শহরের অদূরে কুমিরায় রেলের যে পরিত্যক্ত বক্ষব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে, তার আশপাশে খালি পড়ে থাকা কমবেশি ১০ একর জমিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্পটি স্থানান্তর করা যেতে পারে। এমন খালি জায়গা থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে সামষ্টিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সিআরবি এলাকায় পিপিপি বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে হাসপাতাল নির্মাণের তোড়জোড়ের মূল কারণ কী, তাও খতিয়ে দেখা যৌক্তিক বলে মনে করি।
চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকা পুরোটাই গড়ে উঠেছে পাহাড় এবং টিলার ওপর। পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে শতবর্ষী গর্জন, শিরীষসহ অন্যান্য গাছ। বিশাল বিশাল গাছগুলো কত শত পাখির আবাস। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ দেশের অন্য শহরগুলো থেকেও হারিয়ে গেছে। এলাকাটি নগরবাসীর জন্য শুধু স্বস্তিদায়কই নয়, বরং এটি জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার। অপরিকল্পিত নগরায়ণ নয়, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার মাধ্যমে গোটা দেশেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ তৈরি হোক। চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্য ঘোষণা করে জায়গাটিকে সংরক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নেবে সরকার এমনটাই আশা চট্টগ্রাম নগরবাসী আর দেশের সচেতন মানুষের।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৪ জুলাই ২০২১
© 2021, https:.