বিজয়ের গৌরবগাথা: ‘বাঙ্গালের হনুমান কোম্পানি’
“১৯৭০-এর নির্বাচনের পরের ঘটনা। সারা দেশে চলছে অসহযোগ আন্দোলন। মিছিল-মিটিং হলেই পুলিশ গুলি চালাত। তখন টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক আমি। সভাপতি এনায়েত করিম আর সেক্রেটারি ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়ে একদিন মিটিং করি, কালিহাতীর চারান এলাকায়। সবকিছুকে উপেক্ষা করে মিছিলও বের করি। পরে একদিন কাদের সিদ্দিকী নিয়ে যান ঢাকায়। দেখা করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িতে। নেতার সঙ্গে ওটাই আমার প্রথম দেখা। মিটিং-মিছিলের খবরগুলো শুনে তিনি খুব খুশি হলেন। বসে ছিলেন। উঠে সামনে দাঁড়ালেন। অতঃপর তার মুষ্টিবদ্ধ হাত আমাদের বুকে হালকা স্পর্শ করিয়ে বললেন, ‘শাবাশ বাঙ্গাল’। বলেই সঙ্গে সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ওই স্পর্শ ও স্মৃতিটা কোনো দিনও ভুলব না। এখনো মনে হলে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে। চোখ ভিজে যায় জলে।
আমার নাম ছিল কাজী আশরাফ হুমায়ুন। ওইদিনের পর নামের শেষে ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা লাগাই। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সান্নিধ্যেই বদলে গিয়ে পুরো নাম হয় ‘কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল’। এখনো ‘বাঙ্গাল’ বললে সবাই একনামেই চিনে। ‘বাঙ্গাল’ শব্দটা শুনলেই গর্বিত হই, তখন মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর কথা।” বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে ধারণ করতে নিজের নাম বদলে ফেলার ইতিহাসটি এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল।
কাজী রিয়াজউদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের চতুর্থ সন্তান কাজী আশরাফ হুমায়ুন বাঙ্গাল। বাবা ছিলেন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বেতডোবা গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন টাঙ্গাইল সাদাত কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
৭ মার্চ ১৯৭১। হুমায়ুন বাঙ্গাল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে যান রেসকোর্স ময়দানে। ফিরে এসেই প্রস্তুতি নেন সশস্ত্র সংগ্রামের। তার ভাষায়, ‘কালিহাতী রামগতি শ্রী গোবিন্দ (আরএস) স্কুল মাঠে ছাত্র, কৃষক, জনতাসহ পাঁচ শতাধিক মানুষকে বাঁশের লাঠি দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু করি। এ উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন মির্জা ফরহাদ, আলী আজগর, আবুল কাশেম ভূঁইয়া, লাল মিয়া, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। ট্রেনিং করান মোতালেব নামের একজন রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। থানায় ছিলেন জহির দারোগা। তিনিও সাহায্য করেছেন। পরে কালিহাতী থানার ভেতরের মাঠে আমাদের বিশ-পঁচিশজনকে গোপনে হাতিয়ার চালানো শেখান তৎকালীন ওসি শাহ নেওয়াজ ফরাজি। পাকিস্তানের চাকরি করলেও তিনি সহযোগিতা করেছিলেন।’ ২৫ মার্চের পর টাঙ্গাইলের নেতারা যুদ্ধ পরিচালনায় দুজনকে দায়িত্ব দিয়ে কমিটি করেন। একজন বদিউজ্জামান, আরেকজন ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ওই সময়ই হুমায়ুন বাঙ্গালকে টাঙ্গাইল শহরে যেতে খবর পাঠান লতিফ সিদ্দিকী। আনিসুর রহমান, লাল মিয়া, মতিন প্রমুখ সাতজনকে নিয়ে তিনিও চলে যান সেখানে।
হুমায়ুন বাঙ্গাল বলেন, ‘ওখানে একটা বাড়ি থেকে লতিফ সিদ্দিকী প্রত্যেককে দুইশো রাউন্ড গুলি ও একটি করে রাইফেল দেন। ওটা নিয়ে আমরা চলে যাই নাটিয়াপাড়ায়। ৪ এপ্রিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় ওখানেই। আমরা পেরে উঠি না। বহু কষ্টে চলে আসি কালিহাতীতে।’ টাঙ্গাইল শহর দখলে নিয়ে আর্মিরা কালিহাতীর দিকে অগ্রসর হলে হুমায়ুন বাঙ্গালরা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু অস্ত্রের মুখে টিকতে পারেন না। ১৭ এপ্রিল তারিখে কালিহাতী পাকিস্তানি আর্মিদের দখলে চলে যায়। তারা তখন প্রথমে বাগুন্ডিয়ায় এবং পরে চলে যান বহেরাতলী ক্যাম্পে। সেখানে কিছুদিন মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালানো শেখান হুমায়ুন বাঙ্গাল। এরপর একটি গ্রুপ নিয়ে চলে যান গোপালপুরে। সেখানে গিয়ে ঝাওয়াইল, বেংগুলা প্রভৃতি এলাকায় যুবকদের ট্রেনিং করান এই বীর। ফলে বাড়তে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা। ৩০ আগস্ট প্রায় ১০০ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গোপালপুর থেকে নদীপথে তিনি চলে যান ভারতের মানকাচরে। সেখানে হিরো ক্যাম্পে সাত দিনের উচ্চতর ট্রেনিং হয় তাদের। এরপরই সাতটা নৌকায় করে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রচুর আর্মস-অ্যামুনেশান নিয়ে বেংগুলা হয়ে চলে আসেন গোপালপুরের করিয়াটায়। তার অধীনে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি ক্যাম্প। একটি ক্যারামজানি, আরেকটি বেংগুলায়। তিনি অপারেশন করেন পানকাতা, বেংগুলা, সুন্দরপাড়া, গোপালপুর থানাসহ বিভিন্ন এলাকায়।
মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন বাঙ্গাল ছিলেন ‘হনুমান’ কোম্পানির কমান্ডার। কোম্পানির নাম কেন এমন? তার ভাষায় : “একাত্তরে গোপালপুর ও তার আশপাশের এলাকায় প্রায়ই সশস্ত্র অপারেশন করতাম। আমাদের ভয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা সব সময় তটস্থ থাকত। ওইসময় আর্মিরা মাইক মারে গোটা গোপালপুরে। জীবিত কিংবা মৃত আমাকে ধরিয়ে দিতে পারলেই মিলবে দশ হাজার টাকা পুরস্কার। পাকিস্তানি সেনারা আমার ‘হুমায়ুন’ নাম বলতে পারত না। বলত, ‘হনুমান’। আক্ষেপ করে বলত, ‘হনুমান কেসা চিজ?’ এরপর থেকেই মানুষের মুখে-মুখেই আমার নাম হয়ে যায় ‘হনুমান’। এভাবে কোম্পানির নামও হয় ‘হনুমান কোম্পানি’।”৩০ নভেম্বর ১৯৭১। সকালবেলা। টাঙ্গাইলের নাগরপুর থানা অপারেশনের সময় তিনি মারাত্মকভাবে রক্তাক্ত হন। পাকিস্তানি সেনাদের এলএমজির একটি গুলি এই যোদ্ধার পিঠের ডান পাশে ঢুকে বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। দেশের স্বাধীনতার জন্য দেশের মাটিতেই রক্ত দিতে পেরেছেন এটাকে পরম পাওয়া বলে মনে করেন হুমায়ুন বাঙ্গাল। বললেনÑ ‘এ দেশে একটা সময় ছিল বাঙালিরা এসপি, ডিসি, টিএনও, বড় কর্মকর্তা হতে পারত না। এখন তো অনেক অফিসার, সবাই বাঙালি। সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। আমার রক্ত আছে এই মাটিতে। এর চেয়ে বড় শান্তি নাই ভাই। কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি। বেঁচে থাকব এমন চিন্তাও ছিল না তখন।’
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি। তার ভাষায় ‘আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা। পরে তো জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। এখন রেহেনা পারভীন খবর পড়ছে, তার মানে কি রেহেনা পারভীন ওটা তৈরি করেছে? জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হলে সেক্টর কমান্ডার হবেন কেন? দুঃখ লাগে, এখনো ইতিহাস বিকৃত করছে তার দল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতি ও সেসব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলেছে বহু বছর।’
কী করলে দেশটা আরও এগিয়ে যাবে? কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গালের অকপট উত্তর : ‘রাজনীতির ভেতরে যে দুর্নীতিবাজরা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে। এখন যে রাজনীতিতে যুক্ত হয় সে একটা কাজ বা সুবিধার চিন্তা করে। ফলে নিজেও নষ্ট হয় আর রাজনীতিটাকেও নষ্ট করে। ভালোদের রাজনীতিতে আনার ও টিকিয়ে রাখার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমরা তো দেখি রাজাকার ফ্যামিলির লোকরাও আওয়ামী লীগের নেতা বনে যাচ্ছে। এটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো প্রয়োজন।’ ১৯৭১ সালে বাংলার জমিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করেছিলেন হুমায়ুন বাঙ্গালের মতো যোদ্ধারা। তারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের গৌরবগাথা অনাগতকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১
একাত্তরকে জানতে যুক্ত থাকুন ইউটিউব চ্যানেলটিতে: সালেকখোকন
© 2021, https:.