বিজয়ের গৌরবগাথা: ‘গেরিলা আতিউরের একাত্তর’
“ছয় দফা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। ক্লাসের বাইরে থেকে সেøাগান কানে এলেই বসে থাকতে পারতাম না। মিছিলে মিশে যেতাম। অন্যরকম লাগত তখন। ছাত্রনেতারা দেশ নিয়ে বৈষম্যের কথাগুলো শোনাতেন। সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ছিল ৯০ পার্সেন্ট, আমরা ১০ পার্সেন্ট মাত্র। তখন চাল, আটা ও সরিষার তেলের দাম পূর্ব পাকিস্তানে ছিল যথাক্রমে ৫০ টাকা, ৩০ টাকা ও ৫ টাকা। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল প্রায় অর্ধেক যথাক্রমে ২৫ টাকা, ১৫ টাকা ও ২ টাকা। রাজস্বের মাত্র ১৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে আর পশ্চিম পাকিস্তানে এ ব্যয় ছিল ৫ হাজার কোটি। এ বৈষম্য মেনে নেওয়াটা সত্যি কষ্টের ছিল। পাকিস্তানিরা আমাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চলছে। কায়েদে আজম কলেজে হেলাল, এলাহী, মজিবর আর জগন্নাথ কলেজে জিন্নাহ প্রমুখ নেতৃত্ব দিতেন। ছাত্রলীগের চার খলিফার নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ওই সময় এনএসএফের নামকরা গু-া ছিল খসরু আর পাঁচপাত্তু। ওরা ছিল ভয়ংকর। তা ছাড়া বিহারি ছাত্ররা আমাদের দেখতে পারত না। প্রায়ই ওদের সঙ্গে মারামারি হতো। দেশ আমাদের অথচ মাস্তানি করছে অন্যরা। এটা ভেবে ঠিক থাকতে পারতাম না। মিছিলের রাস্তায় ছিলাম সব সময়। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক ছিল কেন্দ্রবিন্দু। মিছিল শুরু হতো সেখান থেকেই। শেষ হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই ব্যস্ত হতাম আরেক কা-ে। সাইনবোর্ডের উর্দু লেখাগুলোতে আলকাতরা লাগিয়ে নষ্ট করে দিতাম। আমাদের চিন্তা-চেতনার মূলে ছিলেন শেখ মুজিব। ছাত্র আন্দোলনের পর পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় তাকে মুক্তি দিতে। ছাত্রসমাজ তখন শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে অভিহিত করে।
তখন সত্তরের নির্বাচন শেষ। ম্যাট্রিক পাস করেছি মাত্র। আনন্দ নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি গ্রামের বাড়িতে, শরীয়তপুরের জাজিরায়। সঙ্গে বন্ধু সাদেক। আমরা ঘাটপাড়ে ঘুরছি। হঠাৎ খবর আসে চরে আটকে গেছে বঙ্গবন্ধুর লঞ্চ। নির্বাচনে একটি হত্যাকা- হয়েছিল পাবনায়। আওয়ামী লীগের এক নেতাও নিহত হন সেখানে। তাই বঙ্গবন্ধু গিয়েছেন। ফেরার পথেই তার লঞ্চ চরে আটকে যায়। এ খবর পেয়ে ঘাটের লোকজন নিয়ে ছুটে যাই। বিশটার মতো নৌকা রশি দিয়ে টেনে লঞ্চটাকে ছাড়িয়ে আনি। বঙ্গবন্ধু তখন চলে যাবেন। আমরা বললাম, না, আমাদের ঘাটে নামতে হবে। সম্মতি দিয়ে তিনি শুধু মুচকি হাসলেন। জাজিরা লঞ্চঘাটে ভিড়ে বঙ্গবন্ধুর লঞ্চ। নেমেই তিনি প্রশ্ন করলেন তুই কোথায় থাকিস? আমি বললাম, ঢাকায়। তিনি বললেন, বাড়িতে আসিস তুই। তিনি বেশ লম্বা। আমি তার বুকের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তার স্নেহের হাতটি তিনি আমার মাথায় রেখেছিলেন ওইদিন। সে স্পর্শই প্রেরণা হয়ে আছে। এরপর তার দেখানো পথেই আমরা হেঁটেছি। তার নির্দেশে তাকে মুক্ত করতেই ঘর ছেড়েছি একাত্তরে। রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতাকে।”
স্মৃতি হাতড়ে একাত্তর-পূর্ববর্তী নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম আতিউর রহমান। তার বাবা ডা. আবদুর রহমান ও মায়ের নাম হাসিনা বানু। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরের (তখন ছিল ফরিদপুরে) জাজিরা উপজেলায়। বাবা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। একবার পদ্মা গ্রাস করে নেয় তাদের সবকিছু। ১৯৫৮ সালে তারা চলে আসে ঢাকায়, ১২৮ নম্বর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বাড়িতেই কাটে তার শৈশব ও কৈশোর। মুক্তিযুদ্ধের সময় আতিউর ছিলেন কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ক্র্যাক ডাউন শুরু হয়। কয়েক দিন পরেই আতিউর চলে যান ট্রেনিংয়ে। তার ভাষায়, ‘এক দিন খুব সকালে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চলে যাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বর্ডার ক্রস করে প্রথমে আগড়তলা টাউনে এবং পরে কলেজ টিলায় যাই। ওখানে রব ও মাখন ভাই ছেলেদের রিক্রুট করছিলেন। নাম লেখাতেই ১১৩ জনের একটা ব্যাচ হয়। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় নাইনটি ওয়ান বিএসএফে। ওখান থেকে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট হয়ে চলে আসি বিহারের চাকুলিয়ায়। সেখানেই আট সপ্তাহ ট্রেনিং হয়। এফএফদের সিএনসি স্পেশাল ব্যাচ ছিল ওটা। ফেনির জয়নাল হাজারী, যশোরের টিপু সুলতান খান, সিলেটের প্রিন্সিপাল আহাদ চৌধুরী, কুমিল্লার কাশেম, জনকণ্ঠের আতিকুল হক মাসুদ, মুন্সীগঞ্জের ফজলে এলাহী, সুলতান উদ্দিন রাজাসহ ১৩ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রনেতা ও আওয়ামী আদর্শের নেতারা ছিলেন ওই ব্যাচে। ওটা ছিল স্পেশাল ট্রেনিং। আমি ছিলাম এলএমজি স্পেশালিস্ট। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মেলাঘরে। সেখান থেকেই পাই অস্ত্র।’
অস্ত্র নিয়ে তারা গোপনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও নরসিংদীর শিবপুর হয়ে বেলাব দিয়ে বেরাইদ ও ইছাপুরার দিকে চলে আসেন। দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে রমনা ও তেজগাঁওয়ের গ্রুপে তারা ছিলেন ৪৮ গেরিলা, কমান্ড করতেন আবদুল্লাহ হিল বাকী। এ ছাড়া এ গ্রুপটিকে যাত্রাবাড়ী, গেন্ডারিয়া, খিলগাঁও, পল্টন, রমনা এ রকম আটটি সেকশনে ভাগ করা হয়। লোকমারফত অপারেশনের নির্দেশ আসত দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এ টি এম হায়দারের কাছ থেকে। আরবান গেরিলাদের কাজ ছিল ‘হিট অ্যান্ড রান’। মারো আর ভাগো। গেরিলা হিসেবে আতিউর অপারেশন করেন ঢাকার গে-ারিয়া রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ ব্রিজ, গুলবাগ পাওয়ার স্টেশন, উলন পাওয়ার স্টেশন প্রভৃতি জায়গায়।
২৮ নভেম্বর ১৯৭১। দুুপুর বেলা। ত্রিমোহনী গ্রামে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের হাড় গুঁড়ো হয়ে যায়। পরে যুগোসেøাভিয়ার সামরিক হাসপাতালে ক্ষত স্থানে প্রথমে বোন গ্রাফটিং এবং পরে স্কিন গ্রাফটিং করা হয়। পায়ে ব্যথা হয় এখনো। ফলে স্বাভাবিকভাবে চলাচলও করতে পারেন না তিনি।
একাত্তরের যুদ্ধ শেষ কিন্তু এ বীরের শরীরের সঙ্গে যুদ্ধটা চলছেই। তবু দুঃখ নেই, রক্ত দিয়ে পেয়েছেন প্রিয় দেশ আর স্বাধীনতা এটা ভেবেই তৃপ্ত হন তিনি। শুধু বললেন ‘নোংরামি আর ধান্দাবাজদের ঠেকাতে হবে। ওয়ার্ড নেতারেও দেখি গাড়ি নিয়ে ঘুরে। এটা কোন তামাশা! এ টাকার খনির উৎস কোথায়? এগুলোকে কন্ট্রোল করা না গেলে শত উন্নয়নেও সরকারের ভাবমূর্তি মুখ থুবড়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর কন্যার সরকার শুধু মন্দের ভালো সরকার হলেই হবে না। সত্যিকারভাবে ভালো সরকার হতে হবে। তাই বন্ধ করতে হবে রাজনৈতিক করাপশন। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের রক্তঋণ শোধ হওয়ার নয়। তাই প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু উৎসবই নয়, সত্যিকারভাবে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনাকে বুকে ধারণ করতে হবে। তার রাজনৈতিক গুণগুলোকে নেতাকর্মীদের ভেতরও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তবেই দেশটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে।’
আতিউর রহমানের মতো মুক্তিযোদ্ধারা পৌরাণিক কোনো চরিত্র নন, বাঙালি বীর। তাদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। তাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী বীরদের এমন গৌরবগাথা প্রজন্মকে অনন্তকাল পর্যন্ত আলোড়িত করবে।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
একাত্তরকে জানতে যুক্ত থাকুন ইউটিউব চ্যানেলটিতে: সালেকখোকন
© 2021, https:.