সাহরাই ও সহুরাই উৎসবে গবাদি
নৃতাত্ত্বিকদের মতে ওরাওঁরা এ উপমহাদেশের ভূমিজ সন্তান। আচার–আচরণ, রীতি–নীতি ও নিজস্ব ঐতিহ্যে তারা উজ্জ্বল।
আদিতে এ আদিবাসীরা বসতি স্থাপনের লক্ষ্যে কংকা নদীর উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে কনাটকা হয়ে অমরকন্টক ফরেস্ট রেঞ্জে এসে পৌঁছায়। অনেকেই মনে করেন, খ্রিস্ট জন্মের ১৭৫০ বছর আগে হরপ্পা থেকে ওরাওঁরা শাহাবাদের রোহটাস অঞ্চলে চলে আসে। যা বর্তমানে হরিয়ানা এবং যমুনার সমতলভূমি হিসেবে পরিচিত।
শারীরিক গঠন ও ভাষাগত বিচারে ওরাওঁরা দ্রাবিরিয়ান গোষ্ঠীর। এদের বসবাস ছিল ভারতের উড়িষ্যা, ছোট নাগপুর ও রাজমহল অঞ্চলের পার্বত্য এলাকায়। দেশভাগের আগেও দিনাজপুরে বহুসংখ্যক ওরাওঁদের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দলিলে। বাংলাদেশের দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, রংপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় ওরাওঁ আদিবাসীদের বাস।
ওরাওঁরা গবাদিপশুর কল্যাণে সাহরাই উৎসবটি পালন করে ধুমধামের সঙ্গে। প্রতি আশ্বিনের চাঁদের অমাবস্যার পরের দিন চলে এ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। উৎসবটি তিন দিনের হয়। প্রথম দিন তারা ঘরে, উঠানে, জমিতে, গোবর ফেলার জায়গাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রদীপ জ্বালায়।
দ্বিতীয় দিন গরু, মহিষ, ছাগল প্রভৃতিকে স্নান করিয়ে তেল ও সিঁদুর মাখানো হয়। লাঙল, জোয়ালসহ চাষাবাদের সব যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করে মাখানো হয় সিঁদুরের রং। এ উৎসবে ওরাওঁরা গান গায়;
আরে ও ওরে
রেহি রে রে রে রে রে
দিয়া যে রায়ঝ দিয়ারা রে দিয়ারা
কা করে উরোজনা বাড়িরে
আরে-আগে যে জাগাওয়ে গজোমতি গাহা হো
তোকোর পিছে জাগারো কৃষানোরে।
ভাবার্থ: বাড়িওয়ালা তুমি বাতি জ্বালিয়ে কী করো, কীসের জন্য বাতি জ্বালাও, বাতি জ্বালিয়ে গোয়ালে গরুগুলোকে জাগিয়ে তুলছি এবং পরে কৃষককে জাগিয়ে তুলবো পূজার জন্য।
উৎসবের তৃতীয়দিন মূল পূজাটির আগেই তারা গোয়ালঘর মাটি দিয়ে লেপে পরিষ্কার করে। শালবন থেকে উলুর ডিবির মাটি এনে তিন ভাগে উঁচু করে দেয় মেঝেতে। একইসঙ্গে সেখানে সিঁদুর, বেলপাতা, কলাপাতা, দুর্বাঘাস, আতপ চাল, জবা ফুল দিয়ে এবং ধূপ জ্বালিয়ে মুরগি বলি দিয়ে পূজা করে ওরাওঁরা। পূজা শেষে প্রথমেই গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হয়। এরপর বাড়ির সবাইকে গোয়ালঘরে বসেই সেরে নিতে হয় খাওয়াদাওয়া। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানো হয় গোয়ালসহ বাড়ির বিভিন্ন স্থানে। সাহরাই উৎসবের রাতে ওরাওঁ গ্রামগুলো থাকে আলোকোজ্জ্বল।
ওরাওঁদের এ উৎসবের মতোই পাহানরা পালন করে সহুরাই উৎসবটি। এরা কালিপূজার পরদিন সহুরাই উৎসব পালন করে। এদিন প্রতি বাড়ির গোয়াল ঘরসহ গোটা বাড়িটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়। পূজার জন্য প্রয়োজন হয় লাল মোরগ। পাহানরা বলে- কলানিয়া মুরগা লাগতই না হলে নে হোতো। এছাড়াও ধুপ, তেলুয়া (তেলের পিঠা), সিন্দুর প্রভৃতি উপকরণ লাগে।
উৎসবে প্রথমে আতপ চাল গুড়ো করে গোয়ালঘরের চারপাশের মেঝেতে সাজানো হয়। ওইদিন বিকেলে ভগবান বা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে গোয়াল ঘরেই এরা মোরগটি বলি দেয়। বলি দেওয়ার দায়িত্বটি থাকে বাড়ির পুরুষের। অতঃপর নারীরা গরুর পা ধুয়ে দেয়। শিং, মাথা ও শরীরে মেখে দেয় সরিষার তেল। গলায় পরিয়ে দেয় সোলার ফুল। গরুর শিং-এ দেওয়া হয় সিঁদুর ফোঁটা। গরুটিকে পশ্চিমে রেখে পূর্বদিক থেকে তাকে ভক্তি দেয় বাড়ির নারীরা।
সন্ধ্যা হলে আতপ গুড়া পানিতে মাখিয়ে তা প্রদীপের আলোতে রেখে আবার গরুর শরীরে লাগিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর গরুকে খেতে দেওয়া হয় হাড়িয়া পানি ও রান্না করা ভাত। গরুর খাওয়ার পরই বাড়ির সবাইকে খেতে হয় গোয়ালঘরে বসেই। ওই রাতে প্রতিটি গোয়াল ঘরে আলোসহ গোটা গ্রামটিকে প্রদীপ বা মোমের আলোতে আলোকিত রাখা হয়। পাহানদের বিশ্বাস এ পূজার কারণে তাদের গবাদি পশুর রোগব্যাধি থেকে মুক্তি মিলে এবং বংশবৃদ্ধি ঘটে। পূজার রাতে পাহানরা সারারাত নাচগান আর হাড়িয়া খেয়ে আনন্দ করে।
এসময় এরা গান গায়:
খ-যাইতে খ-যাইতে আজই পুজাব
কেরে চুমায়ল গরুকা রে রে
কেরে পুজাইবে ধনুকা চারাইরে,
ফালনা বাবু ঘর আয়রে
জলতি ফালদি বিদায় দে,
মহারাণি বেটিয়া
নাই নিল তেলেকা সিন্দুয়ারে….
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কিডজে, প্রকাশকাল: ৫ নভেম্বর ২০২১
© 2021, https:.