মতিয়া চৌধুরী খুব জ্বালময়ী বক্তৃতা দিতেন। এজন্যই নাম হয় অগ্নিকন্যা। তখন এগারো দফা বাস্তবায়নে জামালপুরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সেটার সক্রিয় সদস্যও হই তখন। কিন্তু গোটা জামালপুরে এগারো দফা আন্দোলনটা চোর পোড়ানো আন্দোলনে রূপ নেয়! সে সময় খুব চোরের উৎপাত শুরু হয়। গ্রামের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে চোর ধরেই জ্যান্ত পুড়িয়ে মারত। চোর পোড়ানো ঠেকাতে মাঠে নামি আমরা। এরপরই এগারো দফা দাবি নিয়ে মিছিল-মিটিং চলে জামালপুর শহরে। মুক্তিযুদ্ধের আগে জামালপুরের নানা ঘটনাপ্রবাহের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল।
মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বীর-প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত হেলাল বলেন, ১৯৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানিরা ক্ষমতা না দিলে সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কলেজে পিএনসিসি (পাকিস্তান ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর) করতাম। রাইফেল চালানোটা ওখানেই শিখি। তখনই বুঝি গিয়েছিলাম সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে যাচ্ছে দেশ। বোমা বানানো শিখলাম। এ কাজে কেমিস্ট্রির টিচাররা সাহায্য করতেন। জামালপুর হাই স্কুল মাঠে চলে রাইফেল ট্রেনিং। সেখানে অংশ নেয় শতাধিক যুবক। আনসার অ্যাডজুট্যান্ট কবির চাচা ট্রেনিং করায়। সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে ট্রেনিং পরিচালিত হতো। ওই কমিটিরও সক্রিয় সদস্য ছিলাম।
বর্তমানে সত্তর বছর বয়সী এই বীর ক্যানসারে আক্রান্ত। তবে ক্যানসার কাবু করতে পারেনি তাকে। যুদ্ধদিনের কথা বলায় ক্লান্তি নেই এই যোদ্ধার। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় নানা বিষয় নিয়ে। সৈয়দ বদরুজ্জামান ও সৈয়দা খোদেজা জামানের বড় সন্তান সৈয়দ সদরুজ্জামান হেলাল। বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার দুরমুট গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ডিগ্রি থার্ড ইয়ারের ছাত্র। পাকিস্তানি সেনারা জামালপুর শহর দখলে নিলে হেলালরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঘর ছাড়েন। তার ভাষায়, ‘মাহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পটি কন্ট্রোল করত বিএসএফ। আমি পিএনসিসি করতাম। তাই রাইফেল ট্রেনিং আগেই ছিল। সুুকুমার চৌধুরীকে প্লাটুন কমান্ডার আর আমাকে করা হয় সেকশন কমান্ডার। পরে সুকুরমার অসুস্থ হলে আমি প্লাটুন কমান্ডার হয়ে যাই। ১০ দিন পর ক্যাপ্টেন নেগি (নিয়োগী) আমাকে কোম্পানি কমান্ডার বানিয়ে দেন। ১০০ জনে ছিল এক কোম্পানি। ওই ক্যাম্পে ট্রেনিং করান হাবিলদার ধন বাহাদুর সিং। কর্নেল তাহের আসার পর হায়ার ট্রেনিংয়ে আমাকে আর তুরাতে পাঠালেন না। উৎসাহ দিয়ে বললেন ‘গেরিলাদের কোনো ট্রেনিং নেই। যাবা, গুলি করবা, আবার চলে আসবা। হিট অ্যান্ড রান।’ মাহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে তিন কিলোমিটার সামনে এসে কামালপুর বিওপিতে ফায়ার করেই চলে যেতাম। একাত্তরে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়েছিল কামালপুরে। কোম্পানিগুলো মেইনলি কোম্পানি কমান্ডারের নামেই হতো। আমার হেলাল কোম্পানি ছাড়াও ওখানে ছিল নাসির, খায়রুল, বদি, পান্না কোম্পানি। কামালপুরে ১৮ বার অ্যাটাকের মধ্যে উপস্থিত ছিলাম ১৪ বার।
কর্নেল তাহের যেদিন আহত হয়েছিলেন ওইদিনই বীর-প্রতীক হেলালও স্পিন্টারে বিদ্ধ হয়েছিলেন। বললেন সেদিনের কথা ‘ফার্স্ট কমিশনের অফিসাররা বেশ কয়েকজন তখন জয়েন করেছেন। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজান আর বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক হাবিলদারকে দেওয়া হয় আমার সঙ্গে। ১৩ নভেম্বর ১৯৭১। কামালপুর অ্যাটাকের জন্য একটা কনফারেন্স হয় কমান্ডারদের নিয়ে। কর্নেল তাহের ব্রিফ করছেন। সমরে পাকিস্তানিদের অংশে ফার্স্ট লাইন, সেকেন্ড লাইন ও সেন্টার এই তিনটি ভাগ ছিল। রাতে পাকিস্তানি সেনারা সেন্টারে গিয়ে থাকছে। তাই সোলজার আজ কম। এটা ছিল কর্নেল তাহেরের ইনফরমেশন।’ তিনি আমাকে নির্দেশ দিলেন ‘তুই অ্যাটাক করে ফার্স্ট লাইন ও সেকেন্ড লাইন দখল করে ফেলবি। ওদের বাংকারেও ঢুকে যাবি, দখল নিয়ে থাকবি। সকালে আমি যাব। ওয়াকিটকি ভোর ৬টার আগে খোলা যাবে না। কোনো ফায়ারও ওপেন হবে না।’ আমরা তাই করি। ফার্স্ট লাইনের পাঁচটা বাংকার ফাঁকা পেয়ে পজিশনে চলে যাই। রাত তখন ১টা। মানে ১৪ নভেম্বর ১৯৭১। সেকেন্ড লাইন সার্চ করি। সেগুলোও খালি। দুটি বাংকারে পজিশন নিই। লে. মিজান বললেন ‘দখল তো হয়েই গেছে। এবার চলেন। সকালে এসে সেক্টর কমান্ডারকে নিয়ে ঢুকে পড়মু।’ আমি বলি, ‘স্যার তো বলেছেন দখল করে বসে থাকতে।’ তিনি বললেন ‘দখল তো হয়েই গেছে। আমরা বরং বানরোডে অপেক্ষা করি।’ হাবিলদারও আমাকে কনভিন্স করে বলেন ‘উনিও তো অফিসার। তার কমান্ডও শোনা দরকার।’ আমরা তখন বাংকারগুলো ছেড়ে চলে আসি বানরোডে। ভোরে কর্নেল তাহের ওয়াকিটকিতে কথা বলেন। তুই কোথায়? বললাম, ‘বানরোডে’। সঙ্গে সঙ্গে রেগে যান। বানরোডে কেন? বাংকার খালি ছিল না? আমি পুরো ঘটনা খুলে বলি। বলেন ‘সর্বনাশটা করছিস তুই।’
হেলাল বলে চলেন, কর্নেল তাহের এলেন সকাল ৯টার দিকে। সঙ্গে উনার গানম্যান, ভাই বাহার, সাঈদ, বেলাল, শ্যালক সাব্বির। ফায়ারও চলছিল তখন। তার মুখে সিগারেট। গোলাগুলি চলছে তুমুল। হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ হয়। টু-ইঞ্চি মর্টার এসে পড়ে তার পায়ের সামনে। দেখলাম স্পিন্টারের আঘাতে তার একটা পা চামড়ার সঙ্গে ঝুলে আছে কোনো রকমে। আমরা তখন ঘাবড়ে যাই। মিজানসহ কয়েকজনকে দিয়ে কর্নেল তাহেরকে পেছনে পাঠিয়ে দিই। তখনো ফুল সেন্স ছিল তার। পা উড়ে গেছে। তবু যাওয়ার সময় বলছেন ‘খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসতেছি। এ পথে তোদের নিয়েই ঢাকা যাব। সবচেয়ে আগেই যাব আমরা।’ এতটা কনফিডেন্ট ছিলেন এই সেক্টর কমান্ডার।
এবার নিজের কথা বলেন হেলাল, তখনো আমি রণাঙ্গনে। কর্নেল তাহের আহত হয়েছেন। ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না। প্রাণপণে লড়ছি। খানিক পরেই শেলের স্পিøন্টার এসে লাগে আমার ডান পায়ের রানে ও হাঁটুর নিচে। পিনপিন করে রক্ত বেরোতে থাকে। ক্যাম্পে ফিরেই ক্ষত স্থানের চিকিৎসা চলে। কর্নেল তাহেরের স্বপ্নটা শেষে বাস্তবায়িত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান আর্মিদের সহযোগিতায় আমার কামালপুরে পাকিস্তান সেনাদের সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছিলাম। একাত্তরের বীর সেনানী হেলাল কথা শেষ করেন আশাবাদ জাগিয়ে, এই প্রজন্মকে দেশ আইনা দিছি, ফ্ল্যাগ আইনা দিছি। এবার রক্ষা করুক তারা। রাজাকারদের কথাবার্তা শুনলে সহ্য করতে পারি না। এ প্রজন্মও সেটা পারে না। এটা আশার কথা। সেক্টর কমান্ডার ফোরামের ফাউন্ডার মেম্বার ছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সারা দেশ ঘুরেছি। প্রজন্মের ফিলিংসটা কাছ থেকে দেখেছি। ওরা পারবে। রিয়েল পেট্রিয়ট হওয়ার চেষ্টাটা প্রজন্মের আছে। তবে আমাদের উচিত তাদের গাইড করা, পাশে থাকা।
লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক দেশ রূপান্তরে, প্রকাশকাল: ১৮ নভেম্বর ২০২১
© 2021, https:.